ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এফডিসি থেকে পলাশী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক বাতিল করে পান্থকুঞ্জ ও হাতিরঝিল রক্ষার দাবিতে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন ১৫৭ জন বিশিষ্ট নাগরিক।
মঙ্গলবার (১৩ মে) ‘বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনের’ চলমান লাগাতার অবস্থান কর্মসূচির ১৫১তম দিনে সমর্থন জানিয়ে এ বিবৃতি দেন তারা।
বিবৃতিতে তারা বলেন, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি শুরু থেকেই দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং সমন্বয়হীনতার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। যা পরিবেশগত সংকট এবং জনদুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যমান পরিবেশ, জলাধার কিংবা প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষা নীতি ও আইন লঙ্ঘন করে এই প্রকল্পের মাধ্যমে হাতিরঝিলের জলাধার ভরাটের মাধ্যমে এর শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়েছে এবং পান্থকুঞ্জের প্রায় দুই হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। তথ্য অধিকার আইনের মাধ্যমে প্রাপ্ত নথি অনুযায়ী হাতিরঝিল ও পান্থকুঞ্জে নির্মাণকাজ পরিচালনা করার জন্য এই প্রকল্পের কোনো পরিবেশ ছাড়পত্র নেই।
তারা আরও বলেন, আমরা দেখছি গত ডিসেম্বর থেকেই একদল তরুণ এই উদ্যান ও জলাধার রক্ষায় আন্দোলন করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা পান্থকুঞ্জ রক্ষার আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছে বহু মানুষ এবং সংগঠন। অন্তর্বর্তী সরকারের তিন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা পান্থকুঞ্জ পার্কে এসে অঙ্গীকার করেছিলেন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বসবেন। কিন্তু পাঁচ মাসেও সেই সভা না হওয়াতে আমরা বিস্মিত। একটি পার্ক বাঁচাতে কিছু উদ্যমী তরুণ ১৫১ দিন ধরে পার্কেই অবস্থান করে অহিংস পরিবেশবান্ধব লড়াই করে যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে পান্থকুঞ্জ পার্ক রক্ষায় এখনো কোনো সুস্পষ্ট ঘোষণা না আসায় আমরা উদ্বিগ্ন এবং ক্ষুব্ধ। কারণ, এই উদ্যান ও জলাধার ঢাকাবাসীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
একই সঙ্গে তা পাখি ও কিছু টিকে থাকা বুনো প্রাণের আশ্রয়স্থল। এক্সপ্রেসওয়ের তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে পান্থকুঞ্জের মতো পরিবেশগত এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় অবদান রাখা এই জন-উদ্যানের পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যা সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যেখানে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করবেন।’ এ ছাড়া জলাধার ভরাট ও পান্থকুঞ্জ পার্কের গাছ কাটা পরিবেশ ও জলাধারসংক্রান্ত আইন ও নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
বিবৃতিতে বলা হয়, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রণয়নকৃত ‘থ্রি-জিরো তত্ত্বে’র ৩টি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যের মধ্যে অন্যতম জিরো নেট কার্বন নিঃসরণ। যেখানে বিশ্বজুড়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, সেখানে ঢাকা শহরের গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন না ঘটিয়ে মুষ্টিমেয় গাড়ি মালিকের ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলের সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই এমন পরিবেশ বিধ্বংসী ও জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প গ্রহণ করেছিল বিগত ফ্যাসিস্ট রেজিম। উন্নয়নের নামে দেশব্যাপী প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। শিক্ষার্থী-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত নতুন বাংলাদেশে উন্নয়নের নামে পরিবেশ ও জনস্বার্থ বিনাশী কোনো কর্মকাণ্ড চলতে পারে না। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে রাষ্ট্র সংস্কারের কর্মসূচি হিসেবে সব উন্নয়ন প্রকল্পকে পরিবেশগত ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। হাতিরঝিল ভরাট ও পান্থকুঞ্জ পার্ক ধ্বংস করে আমরা কোনো উন্নয়ন প্রকল্প চাই না।
প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তারা বলেন, আশা করি প্রধান উপদেষ্টা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেবেন এবং পান্থকুঞ্জ ও হাতিরঝিল বাঁচিয়ে কেবল একটি সংযোগ সড়ক বাতিল করে এক্সপ্রেসওয়ের কাজ গতিশীল করবেন। আমরা চাই জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে আসা অন্তর্বর্তী সরকার পরিবেশ ও গণস্বার্থবিরোধী প্রকল্প বাতিল করে বাংলাদেশের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। একই সঙ্গে আমরা আশা করব, রাষ্ট্রের যে সংস্কারের অঙ্গীকার এই সরকারের ভিত্তি, তার বিরুদ্ধে যায়। এমন কোনো কাজকে এই সরকার প্রশ্রয় দেবে না। ১৫১ দিন ধরে শীত, গ্রীষ্ম, বৃষ্টি, ইঁদুর, মশা, শব্দ, কালো ধোঁয়া সবকিছু সহ্য করে সাহসী তরুণ প্রজন্ম দেশের একটা পাবলিক সম্পদ জনগণের জন্য বাঁচাতে যে উদাহরণ তৈরি করেছে, আমরা চাই রাষ্ট্র অবিলম্বে তাদের সেই অবদানের স্বীকৃতি দিয়ে পান্থকুঞ্জ ও হাতিরঝিল রক্ষার দাবি মেনে নিক।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, আলোকচিত্রী ড. শহিদুল আলম, নাসির আলী মামুন, সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য ফিরোজ আহমেদ, লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শায়ের গফুরসহ ১৫৭ জন বিশিষ্ট নাগরিক এতে স্বাক্ষর করেন।
মন্তব্য করুন