জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে (বিএমইটি) অভিযান চালাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বৃহস্পতিবার (২৯ মে) দুদকের প্রধান কার্যালয়ের চার সদস্যের একটি টিম সকাল সাড়ে ১১টায় অভিযান শুরু করে। দুদকের একটি ঊর্ধ্বতন সূত্র কালবেলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
আভিযানিক দলে রয়েছেন সহকারী পরিচালক আবু বকর সিদ্দিক, সহকারী পরিচালক স্বপন কুমার রায়, সহকারী পরিচালক রাজু আহমেদ ও সহকারী পরিচালক মুবাশ্বিরা আতিয়া তমা।
এর আগে গত ২৬ মে দৈনিক কালবেলায় ‘রক্ষক বিএমইটিই ভক্ষক, গৃহকর্মীর আড়ালে কিশোরী পাচার’ শীর্ষক একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, পেটের দায়ে, পরিবারের মুখে একটু হাসি ফোটাতে দেশ ছাড়ছেন বাংলাদেশের বহু নারী। কিন্তু স্বপ্নের বিদেশে পা রেখেই বদলে যাচ্ছে সেই স্বপ্নের রূপ। তারা প্রতিনিয়ত শিকার হচ্ছেন যৌন নিপীড়ন, শারীরিক নির্যাতন আর নিঃস্ব করে ফেলা এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার। এরপর এসব নারীর কেউ কেউ বিদেশ থেকে ফিরছেন অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায়, কেউ বা সদ্যোজাত সন্তান কোলে নিয়ে। দেশে ফিরে পরিবার ও সমাজের তির্যক দৃষ্টির শিকার হচ্ছেন তারা, হারাচ্ছেন ঠাঁই, সম্ভ্রম ও স্বীকৃতি- সবকিছুই। অথচ এ নারীরাই জীবন বাজি রেখে দেশের রেমিট্যান্সের চাকা সচল রেখেছেন।
এই মানবিক বিপর্যয়ের পেছনে সক্রিয় রয়েছে একটি সুসংগঠিত পাচারকারী চক্র, যারা কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ভুয়া কাগজপত্রে কিশোরীদের বিদেশে পাঠাচ্ছে। দৈনিক কালবেলার দীর্ঘ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভয়াবহ সব তথ্য- চক্রটির সঙ্গে জড়িত অন্তত চারজন বিএমইটি (জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো) কর্মকর্তার সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে। জড়িত রয়েছে অর্ধশতাধিক রিক্রুটিং এজেন্সি। প্রশিক্ষণ ছাড়াই, ভুয়া পাসপোর্ট নম্বর ব্যবহার করে, প্রত্যাগত দেখিয়ে শত শত অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীকে পাঠানো হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে, যেখানে অনেকেই ঠাঁই পাচ্ছেন ডান্স বার, স্পা সেন্টার কিংবা গৃহকর্মীর ছদ্মবেশে নির্যাতনের ভেতরে।
পাচার হওয়া নারীদের প্রায় ৫০০টি পাসপোর্ট নম্বর এখন কালবেলার হাতে এসেছে। এ সংখ্যাই শেষ নয়- প্রতিদিনই গৃহকর্মীর আড়ালে নতুন নতুন কিশোরী পাড়ি দিচ্ছেন অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে। অভিবাসনের নামে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ভেতরে লুকিয়ে থাকা এই মানব পাচার এখনই না থামালে- গন্তব্যের নাম শুধুই অন্ধকার।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিএমইটিকেন্দ্রিক চক্রটির প্রধান পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মো. মাসুদ রানা। এ ছাড়া চক্রটিতে রয়েছেন বহির্গমন শাখার পরিচালক (উপসচিব) মামুন সরদার ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক আব্দুল হাই। আর পর্দার আড়ালে থেকে এসব কর্মকর্তাকে সহায়তা করেন মহাপরিচালক সালেহ আহমদ মোজাফফর।
জানা যায়, নির্যাতিত ও নিপীড়িত হওয়া নারীদের সঠিক সংখ্যা কারও কাছে নেই। তবে নির্যাতিত হয়ে ফেরা নারীদের একটা হিসাব রাখে অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম বা ওকাপ। বিদেশ থেকে দেশে ফিরে যেসব নারী সহায়তা চান বেসরকারি ওই সংস্থাটির কাছে, শুধু তাদের হিসাবই রয়েছে। সে হিসেবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সংস্থাটি প্রায় ৫ হাজারেরও বেশি বিদেশফেরত নারীকে সহায়তা করেছে। সংস্থাটি বিমানবন্দরে ৪০ জন অসুস্থ নারীকে সহায়তা দিয়েছে। এর মধ্যে ৭ জনের অবস্থা ছিল গুরুতর। এ ছাড়া মানসিক সাপোর্ট ৩০৪ জনকে, রেইস প্রকল্পের আওতায় ৪ হাজার ৮৭৮ নারীকে আর্থসামাজিক সহায়তা, ১৭৮ নারীকে আশ্রয় প্রদান, ১৫০ জনকে স্বাস্থ্য সহায়তা ও ৪৬ জনকে আইনি সহায়তা দিয়েছে অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম।
তথ্য বলছে, বাংলাদেশ থেকে কোনো নারীকে বিদেশে পাঠানোর একটি নীতিমালা রয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের শাখা-৫ থেকে ২০০৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি এ সংক্রান্ত একটি পরিপত্র জারি করা হয়। পরিপত্রে মোট ১৯টি নির্দেশনা রয়েছে। এর মধ্যে ৭ নম্বর নির্দেশনায় বলা হয়েছে, গৃহকর্মী হিসেবে গমনেচ্ছু মহিলাদের বয়স ন্যূনতম ২৫ বছর হতে হবে। ৯ নম্বরে ন্যূনতম ১৫ দিন প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে কেউ পূর্বে গৃহকর্মী হিসেবে বিদেশে থাকলে অর্থাৎ প্রত্যাগত হলে তার বেলায় ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ লাগবে না। তবে অনুসন্ধানে কালবেলার হাতে এমন শত শত পাসপোর্ট এসেছে যাদের বয়স ২৫ হয়নি, কোনো কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণও নেননি আর বিদেশফেরতও নন; তবুও বিএমইটির ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট পেয়েছেন। বিএমইটির এমন অন্তত ৫ শতাধিক ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট কালবেলার হাতে রয়েছে। আরও ভয়ংকর তথ্য হলো—অনেক ক্ষেত্রে নামে নামে মিল এমন ভুয়া পাসপোর্ট নম্বর বসিয়ে প্রত্যাগত দেখিয়েও নেওয়া হয়েছে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটির ক্লিয়ারেন্স। কোথাও আবার চালাকি করে ‘হাউস ওয়ার্কারের’ জায়গায় লেখা হয়েছে শুধু ‘ওয়ার্কার’। বেশিরভাগ নারীর বয়সই ১৮ পেরোয়নি। বয়স বাড়িয়ে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে বানানো হয়েছে পাসপোর্ট। এ ছাড়া পাসপোর্টের ইমার্জেন্সি কন্ট্রাক্টে সাধারণত পরিবারের নম্বর দেওয়ার কথা। তবে শত শত পাসপোর্টের ইমার্জেন্সি কন্ট্রাক্টে ফোন দিয়ে দেখা যায়, তার প্রায় সবই ভুয়া। বিএমইটির ক্লিয়ারেন্স দেওয়া ফোন নম্বর বেশিরভাগই বিভিন্ন দালালের। ফলে এসব নারী বিদেশে গিয়ে প্রতারণার শিকার হলে দূতাবাসের পক্ষে তাদের ট্রেস করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রশিক্ষণের জন্য ট্রেনিং সেন্টারে পাঠানো হলে এসব কিশোরীর বয়সের বিষয়টি ধরা পড়ে যেতে পারে। যে কারণে প্রশিক্ষণ ছাড়াই নামে নামে মিল এমন ভুয়া পাসপোর্ট নম্বর বসিয়ে দেখানো হয়েছে প্রত্যাগত। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ছাড়া সাধারণ মানুষের পক্ষে সরকারি পাসপোর্ট ভান্ডারের তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়। এমন প্রায় তিনশ পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছে কালবেলা। তাতে দেখা গেছে, বিদেশে পাঠানো কিশোরীর নাম মিললেও বাবা-মা এমনকি ঠিকানা মেলেনি। মেলেনি জন্ম তারিখও। এ ছাড়া প্রত্যাগত পাসপোর্টের ছবির সঙ্গেও চলতি পাসপোর্টের ছবির কোনো মিল পাওয়া যায়নি। এসব নারীর বয়স পাসপোর্টে ২৫-এর আশপাশে দেখানোয় তাদের পক্ষে বিদেশফেরত হওয়াও সম্ভব নয়। কারণ সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী ২৫ বছরের আগে কোনো নারী গৃহকর্মীর ভিসায় বিদেশ যেতে পারেন না।
মন্তব্য করুন