নিজ ক্যাডার ও নিজ দপ্তর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) অবাঞ্চিত হলেন বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান। এনবিআরের সংস্কার নিয়ে লুকোচুরি, সরকারের ঊর্ধতন মহলে তথ্য আড়াল ও কর্মকর্তাদের আশ্বস্থ করেও রাতের আধারে অধ্যাদেশ জারি নিয়ে চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবি করেন সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারিরা।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে আন্দোলনের কর্মবিরতির মধ্যে সরকার আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে নেয়। এর মধ্যে আন্দোলনকারীদের অন্যতম দাবি এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণের জন্য আন্দোলনকারীর বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন।
বৃহস্পতিবার (২৯ মে) এনবিআর চেয়ারম্যান অপসারণ না হওয়ায় অপসারণের আগ পর্যন্ত অবাঞ্চিত ঘোষণা করে ঐক্য পরিষদ। যদিও আন্দোলনের তীব্রতা শুরু হওয়া থেকে এনবিআরে অফিস করেন না এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান। ইতোমধ্যে তিনি তার পিএস দিয়ে এনবিআরে থাকা নথিপত্র সচিবালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে নিয়ে গেছেন। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে আসার পর থেকে আব্দুর রহমান খান সংস্কার ইস্যুতে শুরু থেকে কর্মকর্তাদের নানাভাবে আশ্বস্থ করে আসছিলেন। সংস্কারের খসড়া অধ্যাদেশ অনুমোদনের পর থেকে আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, নিজের চেয়ার ধরে রাখতে এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন। এছাড়াও আন্দোলন দমন করতে উর্ধতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে জুনিয়র কর্মকর্তাদের উপর তার নির্দেশে চাপ তৈরি করা হয়েছে।
সর্বশেষ তার এলাকার দুই সমন্বয়ক নিয়ে এসে আন্দোলন বির্তকিত করার অপচেষ্টা চালিয়ে গেছেন বলেও অভিযোগ কর্মকর্তাদের। তারা বলছেন, এনবিআরে যোগ দিয়েই আব্দুর রহমান খান নিজের বলয় তৈরির চেষ্টা করেন। আয়কর বিভাগ ও কাস্টম বিভাগে নিজের পছন্দের কর্মকর্তাদের পদায়ন করেন। বিশেষ করে শুল্ক-ভ্যাটে তার এসব পদায়ন ছিল চোখে পড়ার মতো। তার পছন্দের ও এলাকার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতে দুই পদে চারজনকে পদোন্নতির ব্যবস্থা করেন। বিষয়টি এসএসবি থেকে পাশ করে নিয়ে আসেন। আর গণমাধ্যমে এমন খবর প্রকাশিত হওয়ার পর সরে আসেন। তবুও এনবিআরে সদস্যদের আটটি পদের বিপরীতে বর্তমানেও নয়জন কর্মকর্তা কাজ করবেন।
এছাড়া তার অঞ্চলের এক কর্মকর্তাকে ব্রাসেলসে মিনিস্টার (কাস্টম) পদে মনোনীত করেন। এছাড়া এনবিআর চেয়ারম্যানের বলয়ের কর্মকর্তাদের বিষয় এখন এনবিআরে ওপেন সিক্রেট। এসব কর্মকর্তাদের এনবিআরে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদায়ন করা হচ্ছে। আর তাদের বিগত দিনে কর্মকান্ড দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে অনুসন্ধানও চলছে। এমনকি বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা পাওয়া কর্মকর্তারাও তার আস্থায় ছিলেন। এছাড়াও মদ আমদানিতে এনবিআর চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত পছন্দের একটি ব্যবসায়ীর নামে মামলা করার কারণে তিনি এসব কর্মকর্তার নামে অনুসন্ধানের জন্য কমিটিও গঠন করেন। এছাড়াও চট্রগ্রামে জুলাই হত্যা মামলার আসামী সাবেক আওয়ামী লীগ নেতার পণ্য চালানেও রয়েছে, তার অন্য ধরণের সহযোগিতা। এর আগে ওই ব্যবসায়ীর অনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য এক ঊর্ধতন কর্মকর্তাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করেন। আওয়ামীপন্থী ও সাবেক সরকারের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের কৌশলে সুবিধা দিতে প্রজ্ঞাপন বাতিলের উদ্যোগও নিয়েছিলেন তিনি। যদিও গণ্যমাধ্যমকর্মীদের জানাজানির পর তিনি এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। নিজের আয়কর নথিও নিজের হেফাজতে নিয়ে গেছেন বলেও নিশ্চিত করেছেন এনবিআরের আয়কর বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা। এই আন্দোলন শুরুর পর তিনি তার কর ফাইল নিজ হেফাজতে নেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে কথা বলতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কালবেলার পক্ষ থেকে আব্দুর রহমান খানের সঙ্গে বার বার চেষ্টা করেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে সন্ধ্যায় এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খানের অপসরাণ না হওয়া পর্যন্ত অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, জারিকৃত অধ্যাদেশের খসড়া প্রস্তুতির প্রক্রিয়ার শুরু থেকে প্রতিটি ধাপে এনবিআরের বর্তমান চেয়ারম্যান লুকোচুরির আশ্রয় নিয়েছেন ও চরম অসহযোগিতা করেছেন এবং সরকারকে ভবিষ্যৎ রাজস্ব কাঠামো নিয়ে এনবিআরের কর্মকর্তাদের আশা ও আকাঙ্ক্ষার কথা জানানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে সুবিধাভোগী প্রশাসনের এই কর্মকর্তা তার পূর্ববর্তী পদে থাকা অবস্থায় ব্যাংকিং খাতে বিশৃংখলা সৃষ্টিসহ জুলাই পরবর্তী সময়ে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে কর ফাঁকি বিষয়ে সহযোগিতা করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অডিট কার্যক্রম বন্ধ করেন।
এছাড়াও, নজিরবিহীনভাবে অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে অযৌক্তিক এবং অপরিকল্পিতভাবে ভ্যাট হ্রাস-বৃদ্ধির মাধ্যমে তিনি দেশের অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা তৈরী করেন। তিনি বিভিন্ন উপায়ে সরকারের সঙ্গে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের গঠনমূলক ও সার্থক আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের দাবিসমূহের বিষয়ে সরকারকে শুরু থেকেই বিভ্রান্ত করে সরকারের সাথে সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে দুরত্ব তৈরির অপচেষ্টা করে পরিকল্পিতভাবে পরিস্থিতিকে দীর্ঘায়িত ও জটিল করেছেন। তার অবস্থান অতি নেতিবাচক ও ষড়যন্ত্রমূলক না হলে এই সমস্যা অনেক আগেই সুরাহা হয়ে যেতো বলেও প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ইতোপূর্বে ঘোষিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে অপসারণের বিষয়ে সরকার চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত প্রদান করেনি। কিন্তু বিষয়টি সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন রয়েছে বলে আমরা আশ্বস্ত হয়েছি। সরকারের আন্তরিক হস্তক্ষেপে ইতোমধ্যে আমাদের ন্যায্য দাবীসমূহ আদায়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের যৌক্তিক এই দাবি বাস্তবায়নে প্রতি পদে পদে বাধা সৃষ্টিকারী, প্রসেস টেম্পারিং ও সবার অগোচরে রাষ্ট্রীয় রাজস্ব ব্যবস্হাপনার মূল কাঠামো ধ্বংসের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী এই চেয়ারম্যানের হাতে প্রকৃত সংস্কার কার্যক্রম হুমকির মুখে বিধায় আমরা আশা করছি সরকার অবিলম্বে এ বিষয়ে চূডান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
মন্তব্য করুন