সিলেটের সাদাপাথর লুট নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ কয়েকটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন সিলেটের স্থানীয় প্রশাসন। কর্মকর্তারা বলছেন, গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তথ্য মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর। পাথর লুটপাটের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। দৈনিক কালবেলায় বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) ‘সিলেটের সাদাপাথর লুট, ৮০ কোটি টাকা কমিশন ডিসি-এসপির দপ্তরে’ শীর্ষক একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। ওই সংবাদে দুদক ও গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তথ্য উল্লেখ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে কর্মকর্তারা নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার বিকেলে এ বিষয়ে কথা হয় সিলেটের সদ্য সাবেক ডিসি মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পাথর লুটপাটে আমার কোনো যোগসাজশ বা প্রতিরোধে নিষ্ক্রিয়তা ছিল না। আমি ওখান থেকে কোনো অবৈধ সুবিধা নিইনি। বরং লুটপাট ঠেকাতে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি।’ সিলেট জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘পুলিশে চাকরির ১৯ বছরে কখনো ঘুষ নিইনি। আমার অবৈধ আয় নেই। যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর। এক বছর ধরে সিলেটের এসপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। সিলেটের মানুষ জানে আমি কেমন—প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে, সেটা আমার চরিত্র না। তিনি আরও বলেন, ‘ওই প্রতিবেদনের ফলে আমার সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে। কারা কী উদ্দেশ্যে এ কাজ করল, তা জানি না। আমি প্রচণ্ড রকম বিব্রত।’ কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট সার্কেলের এএসপি নোমান অভিযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তিনি বলেছেন, আমি এখানে নতুন এসেছি। আমি কিছু বলতে চাই না। আমাদের সেন্ট্রালি মিডিয়া কর্মকর্তা কথা বলবেন।’
সদ্য সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুন্নাহারও সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘আমি কিংবা জেলা প্রশাসনের লুটপাটের সঙ্গে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা নেই। আমরা নিষ্ক্রিয় ছিলাম না। আমাদের দিক থেকে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। ওখানে ২৪ ঘণ্টা মোবাইল কোর্ট বা টাস্কফোর্সের অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব নয়। আমরা যখনই ওখানে অভিযানে গিয়েছি; তখনই কিন্তু ওখান থেকে সব নৌকা সরিয়ে দিয়েছি। হাতের কাছে যেগুলো পেয়েছি, সেগুলো ভেঙে ধ্বংস করে দিয়েছি। জরিমানা করা হয়েছে, জেল দেওয়া হয়েছে। যখন ওখান থেকে চলে এসেছে, তখন আবার তারা পাথর লুটপাট করতে চলে এসেছে।
নিজের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করে সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবিদা সুলতানা কালবেলাকে বলেন, ‘এর সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। একদিন অভিযানে গিয়ে এসিল্যান্ডের ওপরও হামলা হয়েছে। তবে আমি অভিযান বন্ধ করিনি। সেদিনও রাতভর অভিযান চালিয়েছি। একদিন রাত সাড়ে ১২টায় সাদাপাথরে নেমে আমি ভোর ৬টা পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করেছি। সেদিন আমরা ১৩৬টি নৌকা জব্দসহ তিনজনকে আটকও করি। এ ছাড়া ওখানে আরএনবি ছিল। তারা ৫ আগস্টের পর চলে যায়। আমি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে তাদের আবার ফেরত আনি। তাদের থাকার জন্য অস্থায়ী ব্যবস্থা করি। আমার সময় আমি সম্ভবত তিনটি মামলাও করেছিলাম লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এখন যারা এ প্রতিবেদন দিয়েছে, তারাই প্রমাণ করুক। প্রমাণ করতে পারলে আমাদের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা মাথা পেতে নেব।
নিজের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করে সাবেক ইউএনও ঊর্মী রায় কালবেলাকে বলেন, ‘আমি অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলাম ছয় দিনের জন্য। ডিসেম্বরের ২৪ তারিখ যখন ইউএনও চলে যান, তখন ২৪ তারিখে দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। ৩০ তারিখে যখন নতুন একজন এসে দায়িত্ব নেন, তখন তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছি। আমি অন্য একটা উপজেলার দায়িত্বে। মাত্র ছয় দিনের অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলাম। ছয় দিনে আমি ওখানে যাইওনি। ওখানে আলাদা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, তারা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছেন।
এ বিষয়ে কোম্পানীগঞ্জের এসিল্যান্ড মো. আবুল হাসনাত বলেন, ইউএনও না থাকায় আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছি। অভিযোগের বিষয়ে দুদক কিছু জানতে চায়নি। প্রতিবেদন তৈরি বা তালিকার বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারত। তিনি বলেন, পাথর লুটপাটের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।
কোম্পানীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ উজায়ের আল মাহমুদ আদনানকে একাধিকবার ফোন ও মেসেজ দিয়েও পাওয়া যায়নি। গোয়াইনঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কবির হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘এসব অভিযোগের সঙ্গে আমাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। পাথর-বালু দেখে উপজেলা প্রশাসন। উপজেলা প্রশাসন অভিযানের সময় আমাদের সহায়তা চাইলে আমরা ফোর্স দিই। আর আমাদের পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব, তা করি।’
পুলিশ সুপারের প্রতিবাদ
এদিকে কালবেলায় ‘৮০ কোটি টাকা কমিশন ডিসি-এসপির দপ্তরে’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়েছেন সিলেটের পুলিশ সুপার। প্রতিবাদলিপিতে তিনি বলেন, প্রতিবেদনে পুলিশ সুপার, সিলেট ও সিলেট জেলা পুলিশের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, বস্তুনিষ্ঠতার ঘাটতিপূর্ণ এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
তিনি দাবি করেন, সিলেট জেলা পুলিশ সবসময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও অবৈধ কার্যক্রম প্রতিরোধে অঙ্গীকারবদ্ধ। পাথর উত্তোলন ও পরিবহনের ক্ষেত্রে সরকার ঘোষিত নীতিমালা ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে জেলা পুলিশ নিরলসভাবে কাজ করে আসছে।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেনি বলে তিনি মনে করেন। পুলিশ সুপার বলেছেন, এ ধরনের সংবাদ জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এবং পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে।
প্রতিবাদলিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে, আমরা স্পষ্ট করে জানাচ্ছি—সিলেট জেলা পুলিশ অবৈধ কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে আইনগত ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে যাচ্ছে।
মন্তব্য করুন