কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:১২ এএম
আপডেট : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:২০ এএম
অনলাইন সংস্করণ

রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আইএইএর ৮৫ পাতার গোপন প্রতিবেদন

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

পর্যবেক্ষণ শেষে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে ৮৫ পৃষ্ঠার একটি গোপন প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)। প্রতিবেদনে রূপপুরের নিরাপত্তা ঘাটতিগুলো এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যা উদ্বেগজনক।

সংস্থাটির দাবি, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অপূর্ণতা, জরুরি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ায় ভঙ্গুর বন্দোবস্ত, বিকিরণ নিয়ন্ত্রণের আয়োজনে ফাঁকফোকর, প্রশিক্ষণে ঘাটতি এবং ব্যবস্থাপনায় চরম অব্যবস্থাপনা রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তার যাবতীয় আয়োজন সম্পূর্ণ না করে পূর্বনির্ধারিত তারিখে (৬ নভেম্বর) ফুয়েল লোডিং শুরু হলে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছে আইএইএ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইএইএর সতর্কতা আমলে না নিয়ে তড়িঘড়ি কার্যক্রম শুরু করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটলে শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই নন, পুরো রূপপুরের বাসিন্দাদের চূড়ান্ত সর্বনাশ ঘটে যেতে পারে। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ভয় রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, আইএইএর একটি বিশেষজ্ঞ দল গত ১০-২৭ আগস্ট রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে মিশন পরিচালনা করে। এরপর সংস্থাটি নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রেস নোট প্রকাশ করে। যেখানে ‘কমিটমেন্ট, ইমপ্রুভমেন্ট, ইনহ্যান্সমেন্ট’ জাতীয় শব্দগুলো বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। রূপপুর কর্তৃপক্ষ এ নোটটিকে প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার প্রমাণপত্র হিসেবে প্রচার করছে। অথচ ওই নোটে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে—নিরাপত্তার মানদণ্ডে ঘাটতি রয়েছে এবং তা কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

আইএইএর ৮৫ পাতার গোপন প্রতিবেদনটি সম্প্রতি কালবেলার হাতে পৌঁছেছে। প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আইএইএ মিশনের পর্যালোচনা অনুযায়ী রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যথেষ্ট অনিরাপদ ও ভয়াবহ। ওই প্রতিবেদনের তথ্য সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে কালবেলার নিজস্ব অনুসন্ধানেও জানা গেছে রূপপুরের কার্যক্রমের নানা জোড়াতালি ও অসংগতির চিত্র।

আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার নিরাপত্তা নির্দেশিকা অনুসারে কোনো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কমিশনিং কার্যক্রমের শুরুতেই ‘নন-নিউক্লিয়ার টেস্ট’ (non newcleare test) সম্পন্ন করা বাধ্যতামূলক। এর মধ্য দিয়ে নিউক্লিয়ার ফুয়েল (জ্বালানি) ব্যবহার না করেই কেন্দ্রের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং কার্যপ্রণালি যাচাই করা হয়। কিন্তু রূপপুর প্রকল্পে এসব পরীক্ষা যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়নি। প্রকল্পের নকশা অনুযায়ী পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরীক্ষা করতে হবে Primary Circuit, Containment, Biological Shielding, Fuel Pellet ও Fuel Rod Cladding। এ ছাড়া সাপোর্ট সিস্টেম যেমন Compressed Air, Nitrogen-Oxygen Generation, Water Collection ও Purification, Standby Power এবং Water Intake System-এর কমিশনিংও বাধ্যতামূলক। HVAC সিস্টেমের কার্যকারিতা, যন্ত্রপাতির অবস্থান ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণও পরীক্ষা করে চালু রাখতে হয়। যার অর্থ, রূপপুরে এখনো বহু সাপোর্ট সিস্টেম ইনস্টল ও পরীক্ষা হয়নি। Instrumentation and Control System, Acoustic Leak Detection, Humidity Leak Monitoring, Loose Part Detection, In-Core Monitoring, Neutron Flux Monitoring, Engineering Safety Feature Actuation, Radiation Monitoring, Fire Detection ও Protection System-সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ সিস্টেমের ইনস্টলেশন অসম্পূর্ণ। এ ছাড়া হাজার হাজার সেন্সর, ভেন্টিলেশন সিস্টেম, কন্ট্রোল ভালভ, পাম্প ও কম্প্রেসর, ওয়াটার ইন্টেক চ্যানেল, ফ্লো কন্ট্রোল উপাদান এবং পাওয়ার সাপ্লাই এখনো ঠিকঠাক ইনস্টল হয়নি।

IAEA-এর স্টেজ বা সাব-স্টেজ প্রোগ্রাম অনুযায়ী, A0 থেকে D ধাপ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে পরীক্ষা চালানো বাধ্যতামূলক; কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। A0 সাব-স্টেজে ৩৯ মাসে ৫৫৯টি SAW (Startup and Adjustment Work) সম্পন্ন হওয়ার কথা, বাস্তবে শেষ হয়েছে মাত্র ১৬টি। A1 সাব-স্টেজের ১১৮৭টি কাজের মধ্যে মাত্র ৯৯টি সম্পন্ন হয়েছে, যেখানে নির্ধারিত সময় ৯ মাস, প্রকৃত সময় লেগেছে ২৪ মাস। A3 এবং A4 সাব-স্টেজে কার্যক্রম এখনো স্থবির। ফিজিক্যাল স্টার্টআপের আগে মোট ১৭৪৬টি SAW-এর মধ্যে ১৭১টি কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এই ধাক্কাধাক্কি এবং কার্যক্রমের বিলম্ব পুরো কমিশনিং প্রক্রিয়াকে সংকটাপন্ন করছে।

আইএইএর ৫৩ নম্বর পৃষ্ঠার নবম অধ্যায় অনুযায়ী, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জরুরি পরিকল্পনা ও প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত। সংস্থা পর্যবেক্ষণ করেছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের এলাকায় থাকা প্রধান জরুরি সুবিধাগুলো এখনো নির্মাণাধীন এবং যে কোনো দুর্ঘটনা বা জরুরি পরিস্থিতিতে কার্যকর প্রতিক্রিয়া জানাতে সক্ষম নয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডিজেল জেনারেটর, ফিল্টারযুক্ত ভেন্টিলেশন সিস্টেম, পানি সরবরাহ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো স্থাপনাধীন। প্ল্যান্ট বা জরুরি কর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও যথাযথভাবে বিতরণ করা হয়নি। উপরন্তু, প্ল্যান্টের অন-কল ডিউটি সংস্থা সবসময় পুরোপুরি প্রস্তুত জরুরি প্রতিক্রিয়া দল (Emergency Response Force) নিশ্চিত করতে অক্ষম। আইএইএ ৫৪-৫৬ পাতায় পর্যালোচনা শেষে স্পষ্ট জানিয়েছে, ‘যথাযথভাবে বাস্তবায়িত জরুরি প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রটি জনসাধারণ এবং কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারবে না।’

প্রতিবেদনের ৫৯ নম্বর পৃষ্ঠার দশম অধ্যায় অনুযায়ী, দুর্ঘটনা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও ভয়ংকর অব্যবস্থা বিরাজ করছে। যদিও আংশিকভাবে টেবিল-টপ অনুশীলন ও সাইট-ড্রিলের মাধ্যমে জরুরি ব্যবস্থাপনা পরীক্ষা করা হয়েছে, প্ল্যান্ট কর্মীরা কোনো পূর্ণাঙ্গ ড্রিল চালাননি। ফলে শিফট হস্তান্তর, দলগুলোর মধ্যে তথ্য হস্তান্তর এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা জেলা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের কার্যকারিতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। আইএইএ সতর্ক করেছে, এই অব্যবস্থা যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তাকে গুরুতর হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

আইএইএর প্রতিবেদনের ৪৪ নম্বর পৃষ্ঠার ৭ নম্বর অধ্যায় অনুযায়ী, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ সুরক্ষা ব্যবস্থা গুরুতর ঘাটতি বহন করছে। সংস্থা সতর্ক করেছে, রেডিওলজিক্যাল নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কর্মস্থল পর্যবেক্ষণ কর্মসূচি অর্ধেক রকমই কার্যকর, এবং নতুন জ্বালানি ভবনের জন্য প্রণীত পর্যবেক্ষণ কর্মসূচি ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে কর্মীদের বিকিরণ সুরক্ষা এবং স্থাপনার নিরাপত্তা উল্লেখযোগ্য ঝুঁকির মুখে। প্রতিবেদনের ৭ দশমিক ৫ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, রেডিওলজিক্যাল নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রবেশের ব্যবস্থা ও সংশ্লিষ্ট সুবিধাগুলো কার্যকরভাবে দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ নিশ্চিত করতে অক্ষম।

আইএইএর রিপোর্টের সত্যতা মেলে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের নথিপত্রেও। তথ্য বলছে, রূপপুরে Non-Nuclear Test-এর ধাপও অসম্পূর্ণ। Cold Run এবং Hot Run পরীক্ষা, যা প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি সার্কিট, রিঅ্যাক্টর কুলেন্ট পাম্প এবং প্রেশারাইজারের কার্যকারিতা নির্ণয় করে সম্পূর্ণ হয়নি। স্টিম উৎপাদন ও তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ ডাটা সংগ্রহের কাজও সীমিত। ফলে Nuclear Fuel লোড করার আগে সেফটি সিস্টেম কনফিগারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত অসম্পূর্ণ।

পরমাণু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন ভঙ্গুর অবস্থায় রূপপুরকে নির্ভরযোগ্যভাবে চালু করা বা Physical Start-up করা বিপজ্জনক হতে পারে। স্টেজ প্রোগ্রামে নির্ধারিত কাজের অনেকাংশ বাকি রেখে সরাসরি ফুয়েল লোডের চেষ্টা, Radiological পরিস্থিতি জটিল করবে এবং নিউক্লিয়ার অপারেশনে সরাসরি ঝুঁকি তৈরি করবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ভক্তদের চমকে দিলেন আলিয়া! 

গাজায় ইসরায়েলের বৃষ্টি বোমা, পালাচ্ছে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি 

মা হতে চলেছেন ক্যাটরিনা কাইফ

আফগানিস্তানকে হারানোর পর নতুন সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ

চট্টগ্রামে সিলিন্ডারের গুদামে বিস্ফোরণে দগ্ধ ১০

তপশিলের আগেই ৭০% প্রার্থী ঘোষণার প্রস্তুতি, যাদের সুযোগ দেওয়ার পরিকল্পনা

চাকসু নির্বাচন : ২৭ হাজার ভোটারের বিপরীতে প্রার্থী ১০৮৮ 

ইসরায়েলের কাছে নতি স্বীকার করল সিরিয়া

বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর? সচেতন হোন

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিল কানাডা

১০

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার ভয়ে ফিলিস্তিনিকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না জাপান 

১১

সকালে ঘুম ভাঙতেই কোমর ব্যথা? জানুন সহজ সমাধান

১২

আজ থেকে রেকর্ড দামে স্বর্ণ বিক্রি শুরু, ভরি কত?

১৩

সাড়ে ১৩ ঘণ্টা পর সচল রংপুরের রেল যোগাযোগ

১৪

বিএনপি নেতাকে না পেয়ে স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যা

১৫

১৭ সেপ্টেম্বর : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৬

ব্র্যাক ব্যাংকে চাকরি, দ্রুত আবেদন করুন

১৭

ফুটবল থেকে ইসরায়েলকে বয়কটের তোড়জোড়

১৮

রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আইএইএর ৮৫ পাতার গোপন প্রতিবেদন

১৯

শরণার্থীবোঝাই নৌকায় আগুনে পুড়ে নিহত ৫০

২০
X