বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা আজ সোমবার। এই পবিত্র দিনে ভগবান বুদ্ধ ভিক্ষু সংঘকে বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখের জন্য দিকে দিকে সদ্ধর্মকে প্রচারের নির্দেশ দেন। আড়াই হাজার বছর আগে গৌতম বুদ্ধ ‘বুদ্ধত্ব’ লাভের পর আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা তিথি পর্যন্ত তিন মাস বর্ষাবাস সমাপনীতে প্রবারণা পূর্ণিমা উদযাপন করেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা। বৌদ্ধধর্মীয় গুরুরা সেই থেকে বর্ষাবাস শেষে দিবসটি পালন করে আসছেন। ভিক্ষুসংঘের ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত শেষে আসে এ প্রবারণা তিথি।
বৌদ্ধা বিশ্বাসে, প্রবারণা হলো আত্মশুদ্ধি ও অশুভকে বর্জন করে সত্য ও সুন্দরকে বরণের অনুষ্ঠান। প্রবারণা পূর্ণিমার পরদিন থেকে এক মাস দেশের প্রতিটি বৌদ্ধবিহারে শুরু হবে দানশ্রেষ্ঠ শুভ কঠিন চীবর দান উৎসব।
এই ‘প্রবারণা পূর্ণিমা ও কঠিন চীবর দান’ উপলক্ষে উৎসবের ছোঁয়া লেগেছে বৌদ্ধবিহারগুলোতে। দিবসটি আড়ম্বরপূর্ণ ও যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপনের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশন। সোমবার রাজধানীর মেরুল বাড্ডাস্থ আন্তর্জাতিক বৌদ্ধবিহারে দিনব্যাপী নানান অনুষ্ঠান হবে। সকাল সাড়ে ৬টায় জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ৭টা ১০ মিনিটে ভিক্ষু সংঘের প্রাতঃরাশ, সকাল সাড়ে ৯টায় শীল গ্রহণ ও বুদ্ধ পূজা, সকাল ১১টায় ভিক্ষু সংঘের পিণ্ডদান, বিকেলে সাড়ে ৪টায় ‘প্রবারণার তাৎপর্য ও বিশ্ব মানবতাবাদ’ শীর্ষক আলোচনা সভা এবং সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় আলোকসজ্জা ও বর্ণাঢ্য ফানুস উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেনের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
এদিকে রাজধানীর বাসাবোতে ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহারে গিয়ে দেখা যায়, দিবসটি উপলক্ষে মূল তোরণ ও ভেতরে সাজানো হয়েছে মরিচবাতি দিয়ে। বিহারের ভেতরে রঙিন কাগজের ঝালর দেওয়া হয়েছে। ভক্ত-দর্শনার্থীরা অনেকেই দেখতে আসছেন। কেউ আবার সেরে নিচ্ছেন প্রার্থনা।
অনুষ্ঠান উদযাপন কমিটির সভাপতি ধর্মানন্দ থের বলেন, আমাদের সিদ্ধার্থ গৌতম যখন বুদ্ধত্ব জ্ঞান লাভ করেছিলেন, তখন উনি আসলেই জ্ঞান লাভ করেছেন কি না সেটা পরীক্ষা করা হয়েছিল। সেই পরীক্ষাটা হয়েছিল কীভাবে? উনার চুলটা কেটে ভাসিয়ে দিয়েছিল। ভাসিয়ে দেওয়ার পর উনি বলেছিলেন—যদি আমি সত্যি জ্ঞান লাভ করি, তাহলে আমার চুল নিচে যাবে না, সেটা উপরে চলে যাবে। পরে সেগুলো স্বর্গে চলে যায়।
তিনি আরও বলেন, সেই চুলগুলোকে আমরা ধাতু বলি। আর গৌতমের সেই স্মৃতি স্মরণ করেই আমরা এই রীতি পালন করি। যেহেতু তার চুল স্বর্গে গিয়েছে, তাই আমরা ফানুস উড়িয়ে উদযাপন করি। সমগ্র বৌদ্ধপ্রধান দেশেই এই রীতি পালিত হয়।
ধর্মানন্দ থের বলেন, বৌদ্ধদের মধ্যে যারা ভিক্ষু আছেন, তারা যে গেরুয়া বসন পরে থাকেন, ভক্তরা বছরের মধ্যে একবার তাদের সে গেরুয়া বসন বা চীবর দেওয়ার সুযোগ পান। প্রত্যেক বিহারের মধ্যে যখন ভিক্ষু বা সন্ন্যাসীরা অধিষ্ঠিত হবেন, সে বিহারের মধ্যে যারা তাদের ভক্ত আছেন, তারা ওইদিন ভিক্ষুদের আনুষ্ঠানিকভাবে কাপড় বা চীবর দেন। সবসময়ই এটা দেওয়া যায়। কিন্তু, ওইদিন আনুষ্ঠানিকভাবে একটা নিয়মের মধ্যে দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠান উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব ধর্মাংকুর বড়ুয়া বলেন, এরই মধ্যে আমাদের সাজানোর মূল কাজ শেষ। রোববার চূড়ান্ত পর্ব শেষ হচ্ছে। সন্ধ্যা ৬টার পর বিহারে কীর্তন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি বলেন, আগামীকাল (সোমবার) সন্ধ্যায় হবে ফানুস উৎসব। সেখানে সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে। আর কঠিন চীবর দান উৎসব হবে নভেম্বর মাসের ৩ এবং ৪ তারিখে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতাদের শুভেচ্ছা বিনিময়
শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন বৌদ্ধধর্মীয় নেতাদের প্রতিনিধিদল। রোববার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এই শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বৌদ্ধধর্মীয় নেতারা প্রবারণা পূর্ণিমার মাহাত্ম্য বর্ণনা করে প্রধান উপদেষ্টাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। তারা প্রধান উপদেষ্টাকে বিহার পরিদর্শনেরও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
এ সময় রাজধানীর উত্তরায় বৌদ্ধদের শেষকৃত্যের জন্য জায়গা বরাদ্দ দেওয়ায় প্রধান উপদেষ্টাকে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানান বৌদ্ধ নেতারা। তারা বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিষয়টি অবহিত করার পর ১০ দিনের মধ্যে শ্মশানের জন্য স্থান বরাদ্দ করে দেওয়া হয়েছে। এটা ইতিহাসে অনন্য। ঢাকায় বৌদ্ধধর্মের কেউ মারা গেলে শেষকৃত্যের জন্য বহু পথ পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রামে যেতে হতো। এখন মৃত্যুর পরে একটা জায়গা হলো।
বৈঠকে এ বছর কঠিন চীবর দান উদযাপনের প্রস্তুতি সম্পর্কেও প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করা হয়েছে। এ ছাড়া সার্বক্ষণিক সহযোগিতার জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয় ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতারা। পাশাপাশি, তীর্থযাত্রার জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনা, বৌদ্ধ পণ্ডিত, ধর্মগুরু ও দার্শনিক অতীশ দীপঙ্করের নামে সরকারিভাবে একটি জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র গড়ে তোলাসহ বিভিন্ন দাবির বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করেন বৌদ্ধ নেতারা।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহারের অধ্যক্ষ বুদ্ধপ্রিয় মহাথের, বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয়, পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের ভিক্ষু কল্যাণ জ্যোতি, বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান ভবেশ চাকমা, বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতির ঢাকা অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদক স্বপন বড়ুয়া চৌধুরী, বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব জয় দত্ত বড়ুয়া এবং বৌদ্ধধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রফেসর ড. সুকোমল বড়ুয়া, মং হলা চিং, সুশীল চন্দ্র বড়ুয়া, অধ্যাপক ববি বড়ুয়া, রুবেল বড়ুয়া ও রাজীব কান্তি বড়ুয়া। পাশাপাশি ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
মন্তব্য করুন