

ত্রৈমাসিক বর্ষাবাসের পর ধর্মীয় শুদ্ধতা, সহমর্মিতা ও আত্মদানবোধ জাগিয়ে তুলতে রাজধানীর মেরুল বাড্ডার আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহারে আয়োজিত হলো ‘দানোত্তম শুভ কঠিন চীবর দান ও জাতীয় বৌদ্ধ ধর্মীয় মহাসম্মেলন–২০২৫’।
শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের আয়োজনে দিনব্যাপী এই মহোৎসব ছিল ধর্মীয় ভাবগম্ভীরতা, আন্তর্জাতিক মৈত্রী ও সামাজিক সম্প্রীতির এক অনন্য সমাবেশ।
সকাল থেকেই ভক্তদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে পুরো বিহার প্রাঙ্গণ। ধূপের গন্ধ, প্রার্থনার মৃদু ধ্বনি আর ধর্মীয় সংগীত মিলেমিশে যেন শান্তির আবহ তৈরি করে।
বৌদ্ধ ধর্মে বর্ষাবাস বা ‘বসবাস ঋতু’ এক বিশেষ সময়, যখন ভিক্ষুরা নির্দিষ্ট বিহারে অবস্থান করে ধ্যান, প্রার্থনা ও শিক্ষাচর্চায় নিয়োজিত থাকেন। এ সময়ের শেষে পূণ্যার্থীরা একদিনে তৈরি করেন ‘কঠিন চীবর’— অর্থাৎ তুলা থেকে সুতা, বয়ন, রঙ ও সেলাইয়ের সমস্ত ধাপ সম্পন্ন করে ভিক্ষুদের দান করা হয় এ বিশেষ বস্ত্র।
এ প্রক্রিয়াটি কেবল ধর্মীয় আচারের প্রতীক নয়; এটি ভক্তদের শ্রম, সময় ও আত্মনিবেদনকে একত্রে ধারণ করে। তাই একে বলা হয় ‘দানোত্তম’— সর্বোত্তম দান।
বুদ্ধের জীবদ্দশায় প্রথম এ চীবর দান প্রবর্তিত হয়। কিংবদন্তি অনুযায়ী, রাজগৃহের এক নারী ভিক্ষুসংঘের জন্য একদিনে চীবর তৈরি করে দান করেছিলেন। বুদ্ধ তার এই দানের প্রশংসা করেন এবং পরবর্তীকালে কঠিন চীবর দানের প্রথা প্রবর্তিত হয়। সেই ঐতিহ্যই আজও টিকে আছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ সমাজে, যার ধারাবাহিকতা রক্ষা করছে বাংলাদেশও।
সকাল ৬টা ১ মিনিটে আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহারের প্রাঙ্গণ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়, আর সঙ্গে চলে বিশ্বজুড়ে শান্তির জন্য প্রার্থনা। ধূপ, প্রদীপ ও প্রার্থনার মৃদু শব্দে ভরে ওঠে পুরো পরিবেশ। সকাল ৬টা ৩১ মিনিটে ভিক্ষুসংঘ প্রাতঃরাশ গ্রহণ করেন। বর্ষাবাস শেষে এই প্রাতঃরাশ তাদের শক্তি ও মনোযোগকে নতুন করে ভরিয়ে তোলে।
সকাল ৯টায় পূজনীয় ভিক্ষুসংঘ তাদের আসন গ্রহণ করেন। ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যেই উপস্থিত প্রাজ্ঞ ভিক্ষুসংঘ ধর্মদেশনা প্রদান করেন। তাদের বক্তব্যে দান, ধ্যান ও ভক্তির গুরুত্ব ফুটে ওঠে।১০টা নাগাদ শ্রীলঙ্কান দায়ক-দায়িকা শীলগ্রহণ করেন এবং অষ্টউপকরণসহ মহাসংঘদান সম্পন্ন হয়। এরপর ভদন্ত জ্ঞানানন্দ থের বুদ্ধপূজা উৎসর্গ করেন। ১১টা ১৫ মিনিটে ভিক্ষুসংঘ পিওগ্রহণ করেন।
দুপুরে অতিথিরা আপ্যায়িত হন। দুপুর ২টায় ভিক্ষুসংঘ মঞ্চে আসন গ্রহণ করে বরণ করা হয়। সঙ্গে শুরু হয় পবিত্র ত্রিপিটক থেকে মঙ্গলাচরণ। ২টা ১৫ মিনিটে মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করে কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠান আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়, সঙ্গে বাজে সূচনা সংগীত।
শুভ উদ্বোধক হিসেবে বক্তব্য রাখেন ভদন্ত ধর্মমিত্র মহাথের। স্বাগত ভাষণ দেন ভদন্ত বুদ্ধানন্দ মহাথের। পরে ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয় মহাথের ধর্মদেশনা প্রদান করেন। বিকেল ৩টা ৩০ মিনিটে উপাসক-উপাসিকারা পঞ্চশীল গ্রহণ করেন। ৩টা ৪০ মিনিটে পবিত্র চীবর পরিক্রমা হয়। ৩টা ৪৫ মিনিটে প্রধান ধর্মদেশক ধর্মদেশনা দেন। ৪টা ৫ মিনিটে বিশেষ অতিথি এবং প্রধান অতিথির বক্তব্য গ্রহণ করা হয়। ৪টা ৫০ মিনিটে স্বরূপানন্দ ভিক্ষু ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। শেষে বিকেল ৫টায় সভাপতি পবিত্র কঠিন চীবর ও কল্পতরু উৎসর্গ করেন এবং অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
সম্মেলনে ধর্মীয় শিক্ষা বিস্তার, যুবসমাজের নৈতিক চেতনা জাগানো এবং আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ সংহতি বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। সন্ধ্যা ৬টায় অনুষ্ঠিত হয় প্রদীপ পূজা ও আলোকসজ্জা। উপস্থিত সবাই সমৃদ্ধি এবং বিশ্বশান্তি কামনায় প্রার্থনা করেন। প্রাঙ্গণ ভরে ওঠে দীপের আলোয়, যা শান্তি, মৈত্রী ও পূণ্যের বার্তা বহন করে।
অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন শামনমিত্র মহাথের। প্রধান ধর্মদেশক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভদন্ত সত্যপাল মহাথের, অধ্যক্ষ, গহিরা জেতবনারাম বৌদ্ধ বিহার, রাউজান, চট্টগ্রাম।
ধর্মদেশনায় ভদন্ত সত্যপাল মহাথের বলেন,“দান কেবল বস্তু প্রদানের নাম নয়; এটি অন্তরের পবিত্রতার প্রকাশ। কঠিন চীবর দান বৌদ্ধ জীবনে সেই আত্মশুদ্ধি ও সহানুভূতির অনুশীলন।”
উৎসবকে আন্তর্জাতিক মাত্রা দিয়েছে বিদেশি অতিথিদের অংশগ্রহণ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন—এইচ. ই. মিস থিতিপর্ন চিরাসাওয়াদি, থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত, এইচ. ই. মিস্টার ধর্মপালা উইরাক্কোডি, শ্রীলঙ্কার হাই কমিশনার,গোকুল ভিকে, বাংলাদেশের ঢাকায় অবস্থিত ভারতের হাইকমিশনের প্রথম সচিব।
তারা সবাই বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতি শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘বৌদ্ধ ধর্ম শুধু বিশ্বাস নয়, এটি একটি জীবনধারা— যা মৈত্রী ও শান্তির মাধ্যমে বিশ্বকে যুক্ত করে রাখে।’
দেশের বিভিন্ন বিহার থেকে আগত পূজনীয় ভিক্ষুসংঘরা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অংশ নেন। ভিক্ষুরা প্রার্থনা করেন, পূণ্যার্থীরা শ্রদ্ধার সঙ্গে তাদের হাতে চীবর অর্পণ করেন। প্রত্যেক ভক্তের মুখে দেখা যায় আনন্দ ও প্রশান্তি। কেউ প্রার্থনা করছেন নিভৃতে, কেউ ধূপ জ্বালিয়ে ধ্যান করছেন নীরবে।
এক প্রবীণ ভক্ত মহেন্দ্র চন্দ্র বলেন, ‘প্রতিবার কঠিন চীবর দান আমাদের জীবনে এক নতুন সূচনা এনে দেয়। মনে হয়, বুদ্ধের পথেই আমরা এক ধাপ এগিয়ে গেলাম।’
পুরো বিহার প্রাঙ্গণ দিনভর উৎসবমুখর ছিল। বৌদ্ধ ধর্মের মূল শিক্ষা হলো— দান, শীল, ধ্যান ও মৈত্রী। কঠিন চীবর দান এ চারটিরই সম্মিলন। এটি মানুষকে শেখায় ত্যাগ, শ্রম ও সহমর্মিতার গুরুত্ব। বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাস করা হয়— একদিনের মধ্যে তৈরি সেই চীবর ভিক্ষুকে দান করার মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় অসীম পূণ্যফল, যা জীবনের কল্যাণ ও পরকালীন শান্তির পথপ্রদর্শক।
সামাজিক দিক থেকে এটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ঐক্যের প্রতীক। এতে গ্রাম থেকে শহর— সর্বত্রের মানুষ একত্রিত হয়। নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু— সবাই অংশ নেয় সমান উৎসাহে।
১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশন দীর্ঘদিন ধরে দেশে বৌদ্ধ ধর্মীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। কঠিন চীবর দান, বুদ্ধপূর্ণিমা, সংঘদান ও শান্তি সম্মেলনের মাধ্যমে সংগঠনটি দেশে ধর্মীয় সহাবস্থান ও মানবকল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
প্রতি বছরই আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহারে কঠিন চীবর দান আয়োজন করে তারা, যা এখন জাতীয় পর্যায়ের ধর্মীয় ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।
অনুষ্ঠানের শেষভাগে ভিক্ষুসংঘের সম্মিলিত প্রার্থনায় উচ্চারিত হয়—‘সব প্রাণী সুখী হোক, সব প্রাণী শান্তিতে থাকুক।’
মন্তব্য করুন