সন্ধ্যা নামতেই চট্টগ্রামের আকাশ এক অদ্ভুত রূপে রঙিন হয়ে ওঠে। একের পর এক ফানুস উড়ে যায় দূরের নীলিমায়, আলোর ক্ষুদ্র জ্যোৎস্না যেন পুরো শহরকে জাদুর ঝলকানি দিয়ে আলোকিত করছে।
সোমবার (৬ অক্টোবর) প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে এ দৃশ্যের সাক্ষী হন হাজার হাজার নারী-পুরুষ।
নন্দনকানন বৌদ্ধ বিহার সংলগ্ন চার রাস্তার মোড় থেকে শুরু করে কাতালগঞ্জ নব পণ্ডিত বিহার— প্রতিটি বিহারে ছিল উৎসবমুখর আকাশ, যেখানে ফানুস ওড়ানোই ছিল প্রধান আকর্ষণ। সন্ধ্যার মুহূর্তে কীর্তনের সুর আর ঢোল, কাঁসর, মন্দিরার তাল মিলানো গর্জন যেন আকাশকে আরও উজ্জ্বল করেছে।
ফানুসের আলোয় উদ্ভাসিত আকাশে ভেসে যাচ্ছিল ধর্মীয় মন্ত্রের সুর। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, এই আকাশে ফানুস ওড়ানো কেবল আনন্দের নয়, বরং এটি বুদ্ধের উপদেশ ও প্রার্থনার এক অনন্য প্রকাশ। উপস্থিত ভক্তরা ফুল, ফলাদি, ধুপ-বাতি নিয়ে হাজির হয়ে সমস্বরে মন্ত্রপাঠ ও পূজা উৎসর্গ করেছেন।
চট্টগ্রামের সংগঠন মহাবর্গের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অপুর্ব বড়ুয়া বলেন, বুদ্ধ পূর্ণিমার পর এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। এক মাস ধরে আমরা ১৪টি ফানুস বানিয়েছি, যা জীবের মুক্তি ও আত্মশুদ্ধির জন্য আকাশে উড়িয়ে দেওয়া হবে।
সম্যক সংগঠনের সভাপতি শুভ বড়ুয়া কালবেলাকে বলেন, চট্টগ্রামের ৭১টি বৌদ্ধ সংগঠন আজ এখানে একত্রিত হয়েছে। প্রায় ৫০০টির বেশি ফানুস আকাশে ওড়ানো হচ্ছে। এটি কেবল আনন্দের উৎসব নয়, বরং আমাদের ধর্মীয় ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার এক পথ।
সন্ধ্যায় সরেজমিনে দেখা গেছে, অনুষ্ঠানের উদ্বোধক চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন এবং প্রধান অতিথি বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী নিজ হাতে ফানুস উড়ান, যা উৎসবের আনন্দকে আরও দ্বিগুণ করে।
এ ছাড়া আরও উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের ড. মহাস্থবির, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব নাজিমুর রহমান। সম্মিলিত প্রবণ পূর্ণিমা উদ্যাপন পরিষদের আয়োজনে সভাপতিত্ব করেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষা অফিসার লিটন কুমার বড়ুয়া।
আরও দেখা গেছে, নগরীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সকাল থেকে বিহার ও আশেপাশের এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ সূত্র জানায়, সিএমপি ট্র্যাফিক-দক্ষিণ বিভাগ বিশেষ ট্রাফিক ব্যবস্থার মাধ্যমে যানজট নিয়ন্ত্রণ করেছে। ডিসি হিল মোড়, নিউ আরোহণ সংঘ মোড়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় রোড ডাইভারশন কার্যকর ছিল।
ফানুস উৎসবের পাশাপাশি কৌজাগরী পূর্ণিমাকে ঘিরে নগরীর বাজারগুলোও ছিল ব্যস্ত। চকবাজার, হাজারী লেইন, টেরিবাজার ও বকশিরহাট বাজারে দেখা যায় নারী-পুরুষের উপচে পড়া ভিড়। ফুল, বেলপাতা, তুলসী, ধানের গোছা, মিঠাই— সবই ছিল কৌজাগরী পূর্ণিমার প্রয়োজনীয় উপকরণ। বিশেষ করে বিবাহিত নারীরা সক্রিয়ভাবে বাজারের প্রতিটি কোণ ঘুরে পূজার সামগ্রী সংগ্রহ করছিলেন।
উৎসবের আনন্দে মেতেছে সব বয়সী মানুষ। এক বৃদ্ধ ভিক্ষু বলেন, প্রবারণা পূর্ণিমা আমাদের জন্য শুধু ধর্মীয় নয়, এটি আমাদের সম্প্রদায়ের ঐক্য ও শান্তির প্রতীক।
চবি পালি বিভাগের শিক্ষার্থী তরুণ বড়ুয়া বলেন, ফানুস উড়ানো, কীর্তন আর মন্ত্রপাঠ এটি এক অনন্য অনুভূতি, যা হৃদয়ে চিরস্থায়ী হয়ে থাকে।
চট্টগ্রামে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত প্রবারণা পূর্ণিমা শহরকে একটি উৎসবমুখর রূপ দেয়। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা, ফানুস উড়ানো, আতশবাজি, কীর্তন— সব মিলিয়ে একে শহরের আকাশে ছড়িয়ে দেয় এক চিরস্মরণীয় আলো।
মন্তব্য করুন