

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে ২০১০ সালের মার্চে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সবশেষ ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার জুলাইয়ের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য পুনর্গঠন করে একই ট্রাইব্যুনাল। পুনর্গঠনের আগে ১৫ বছরের বেশি সময়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ৫৭টি মামলার রায় দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল ছয়জনের। এদের মধ্যে পাঁচজন জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতা এবং একজন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা।
২০১০ সালে গঠনের পর নানা আলোচনা এবং ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়। বেশ কয়েকবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী, আইনটিকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট, রায়কে ঘিরে স্কাইপ বিতর্ক এবং সাক্ষীদের নিয়ে বিতর্কসহ নানা ঘটনার জন্ম হয়েছিল সে সময়।
গত বছরের জুলাইয়ের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে প্রথম মামলার রায় এলো গতকাল সোমবার। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে এখন পর্যন্ত গত এক বছরে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১০টি। আর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্তত ৩৭টি মামলার তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্বাধীনতার ৩৯ বছর পরে ২০১০ সালের ২৫শে মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, তদন্ত সংস্থা এবং আইনজীবী প্যানেল গঠন করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ঢাকায় পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ শুরু হয়। ট্রাইব্যুনাল গঠনের বছরই জুলাই মাসে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর বেশ কয়েকজন নেতার বিচার হয় এই ট্রাইব্যুনালে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—আব্দুল কাদের মোল্লা, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মীর কাশেম আলী, আবুল কালাম আজাদ, এ টি এম আজহারুল ইসলাম প্রমুখ। একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড হয় আলবদর নেতা চৌধুরী মঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খানের। তবে পলাতক অবস্থায় এ মামলায় বিচার হয় তাদের। এ ছাড়া বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধেও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনে তদন্ত সংস্থা। জাতীয় পার্টির নেতা এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার, আওয়ামী লীগ নেতা মোবারক হোসেনের মানবতাবিরোধী অপরাধেরও বিচার হয়েছে একই ট্রাইব্যুনালে।
ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর আপিল বিচারাধীন থাকায় কয়েকজন দণ্ডিত আসামি কারাগারে থাকা অবস্থায় মারা গেছেন, যার মধ্যে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম অন্যতম, যিনি ৯০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ পেয়েছিলেন। সে সময়কার ৩০টি মামলা এখনো বিচারাধীন রয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের করা ৫০টিরও বেশি আপিল সর্বোচ্চ আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর রুকন আবুল কালাম আযাদ, যিনি বাচ্চু রাজাকার নামেও পরিচিত, তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়ই ছিলেও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া প্রথম রায়। ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি ওই মামলার রায় দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাকে গণহত্যা, ধর্ষণের মতো অপরাধে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন ট্রাইব্যুনাল। পরে নাটকীয়তা শেষে জনবিক্ষোভের মুখে সে বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পরিবর্তে তার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করে আপিল বিভাগ। দণ্ড কার্যকর নিয়ে নানা নাটকীয়তার পর সেই বছরের ১২ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
২০১১ সালের ৪ জুন অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনালে কামারুজ্জামানের বিচার শুরু হয়। বিচার শেষে ২০১৩ সালের ৯ মে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এটি ছিল ট্রাইব্যুনালের চতুর্থ রায়।
বিচার শেষে, ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। যদিও পরে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন তাকে।
এর আগে ২০১০ সালে জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত শুরু করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। ২০১২ সালে তার বিরুদ্ধে মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি আদালত তাকে কারাগারে পাঠান। এক বছরের বেশি সময় ধরে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক চলে। পরে ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই গোলাম যমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এই রায়ের বিরুদ্ধে তিনি সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করলেও কারাগারে থাকাবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধে ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর এ টি এম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দেন এই ট্রাইব্যুনাল। একাত্তরে তিনি ছিলেন জামায়াতের সেই সময়ের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের রংপুর জেলা কমিটির সভাপতি এবং পদাধিকার বলেই রংপুরের আলবদর বাহিনীর প্রধান। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় কারাগারে যাওয়ার পর আজহারুল দলটির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো মামলায় তিনিই প্রথম পুনর্বিবেচনার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিলে খালাস পেয়েছেন।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতে ইসলামীর আরেক শীর্ষস্থানীয় নেতা মীর কাশেম আলীকে ২০১৪ সালের নভেম্বরে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দেয়। পরে ২০১৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।
বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মানবতাবিরোধী অপরাধে ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। তিনিই প্রথম কোনো বিএনপি নেতা যার বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে ট্রাইবুনালে সাজার রায় আসে।
২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
মন্তব্য করুন