কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ০৭:৩৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
পূজা উদযাপন পরিষদের মতবিনিময়ে বক্তারা

নির্বাচনে সংখ্যালঘু নির্যাতন রোধে প্রতিশ্রুতি আদায় করা উচিত  

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের আয়োজনে সিরডাপ মিলনায়তনে ‘নির্বাচনে সহিংসতা : উত্তরণ’ পথ শীর্ষক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ছবি : কালবেলা
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের আয়োজনে সিরডাপ মিলনায়তনে ‘নির্বাচনে সহিংসতা : উত্তরণ’ পথ শীর্ষক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ছবি : কালবেলা

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন, আওয়ামী লীগ, বিএনপি থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সকল রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটবে না এমন প্রতিশ্রুতি আদায় করা উচিত বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা।

বৃহস্পতিবার (৩০ নভেম্বর) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে ‘নির্বাচনে সহিংসতা : উত্তরণের পথ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়ে বক্তারা এ কথা বলেন।

তারা বলেছেন- রাজনীতি ও নির্বাচনে ধর্ম-সাম্প্রদায়িতার ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হব। তাছাড়া রাষ্ট্রধর্ম দেশে সংখ্যালঘু তৈরি করেছে। ’৭২-এর সংবিধানে ফেরার ইস্যুতে রাষ্ট্র ওয়াদাভঙ্গকারী হিসেবে পরিণত হয়েছে। তাই উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি ঠেকাতে নির্বাচনে সামজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার রোধ, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ৬২টি এলাকায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ৩৬৫ দিন ২৪ ঘণ্টা সবাইকে নিরাপদ রাখা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। তাছাড়া রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না হলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে না। তা নিশ্চিত করতে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে সরকারকে সংখ্যালঘু নিরাপত্তায় বাধ্য করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয় উল্লেখ করে সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি জে এল ভৌমিক বলেন- সংখ্যালঘুদের সম অধিকার দূরে থাক, ভোটাধিকার প্রয়োগ করাও কঠিন। দেশবিরোধী শক্তির কাছে সঠিক কথা বলতে না পারার কারণেই তারা সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী অপকর্মে সাহস পায়।

বর্তমান সরকার প্রধান শেখ হাসিনা ছাড়া দেশ পাকিস্তান ও তালেবান হবে এমন শঙ্কার কথা তুলে ধরে বিচারপতি সামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোশকতায় ও খালেদা জিয়ার নির্দেশে দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পর নির্যাতন হয়। এতে অনেকেইে দেশ ছাড়ে। সেই আমলে পূর্ণিমা শীলের ধর্ষণের ঘটনা ছাড়া কোনোটির বিচার হয়নি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনকে বিএনপির সব অত্যাচার, সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচার দাবি জানালেও আপসের রাজনীতির কারণে তিনি তা করেননি। এখন বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ মন্তব্য করে মানিক বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার চাবিকাঠি নাড়ার পেছনে শতভাগ যুক্ত ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা মনে প্রাণে অসাম্প্রদায়িকতা থেকে দূরে। দেশে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অপরাধ শুধু হিন্দু-বৌদ্ধদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ওয়াজের ক্ষেত্রে নয়। অথচ সারা দেশে ওয়াজের নামে অন্য ধর্মের প্রতি সবচেয়ে বেশি বিদ্বেষ ছাড়ানো হচ্ছে। সারা দেশে ওয়াজের নামে এক শ্রেণির মানুষ সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে, তাই ওয়াজ ব্যবসা বন্ধের বিকল্প নেই।

সাম্প্রদায়িকতার আস্তানা মাদ্রাসাগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার দাবি জানিয়ে মানিক বলেন, ধর্মান্ধদের সাথে আপোস করার নীতি পরিহার করে কঠোর হতে হবে। সবাইকে একত্রিত না হলে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও মানসিকতা বদলানো কঠিন হবে। মানবাধিকার কর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, আমরা সবাই ৩৬৫দিন ২৪ ঘণ্টা নিরাপদে থাকতে চাই। সব নাগরিকের জন্য রাষ্ট্রকে সে ব্যবস্থা করতে হবে। নির্বাচন-পূজা বা উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা তীব্র হয়, কিন্তু প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথায় এ ধরনের সহিংসতা হচ্ছে। আমরা সহিংস সমাজে বাসবাস করছি মন্তব্য করে সুলতানা কামাল বলেন, এই সমাজে সব ধর্মের মানুষ কোনো না কোনোভাবে অত্যাচার, নির্যাতনের শিকার। কিন্তু দুর্বলের ওপর অত্যাচার করে পার পাওয়া যাবে, এমন মানসিকতা থেকেই সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হয়। মন্দের ভালো রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগকে মেনে নিয়ে ও নিরাপদ মনে করে প্রতিদিন শঙ্কার মধ্যে সবাই বসবাস করছি। নিজেকে নিরাপদ বোধ মনে করতে পারছি না।

প্রশ্ন রেখে আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে দেশ চলছে তবে সবার মধ্যে এত শঙ্কা কেন? যদি এই আদর্শ মেনে দেশ চলে তবে সংখ্যালঘুরা কেন নির্যাতিত হবে, শঙ্কায় থাকবে। এই পরিস্থিতে আওয়ামী লীগ বলুক আমরা মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দেশ চালাতে পারব না। মোনাফেকি ও মিথ্যাচার কেন করবে। তখন আমরা বাঁচার জন্য নিজেদের ইচ্ছামতো পথ বেছে নেব। সংখ্যালঘুদের স্বার্থে ইশতেহারে দেয়া দাবি পূরণ করেনি আওয়ামী লীগ। এজন্য তাদের লজ্জা নেই, ক্ষমাও চায়নি।

নির্বাচন বিষয়টি একটু দুষ্টু প্রক্রিয়া হয়ে গেছে মন্তব্য করে সুলতানা কামাল বলেন, এতে সবাই অংশ নিতে পারে। এজন্য সংখ্যালঘুসহ যে কোনো সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার নির্যাতনের প্রতিকার মিলে না। আপসকামিতার রাজনীতির কারণে আজ কোনো নির্যাতনের বিচার হয় না। এজন্য যারা ক্ষমতায় যায় তাদের কিভাবে বাধ্য করে দাবি আদায় করা যায় সে চিন্তা করা জরুরি। এটা একটা জাতীয় সমস্যা। এজন্য সবার এক হয়ে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া বিকল্প নেই। মহিলা পরিষদের সভাপতি ড. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, সরকার চেয়েছে বলেই গত দুই দুর্গোসবে কোনো সমস্যা হয়নি। তাই সরকার ও প্রশাসনের চাওয়ার ওপর এবারের নির্বাচনে কোনো সমস্যা হবে না বলে আমরা বিশ্বাস করি। আপসকামিতার রাজনীতির কারণে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আর কোনোদিন রাষ্ট্রধর্ম থেকে বের হওয়া সম্ভব হবে না মন্তব্য করে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রাপ্তদের মধ্যে অন্তত ১০ জন সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। দেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতির চরম ক্রান্তিকাল চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুক কাজে লাগিয়ে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা দেশে ঘটেছে। এজন্য নিরাপদ টেকনোলজি কীভাবে ব্যবহার করা যায় ভাবতে হবে।

নির্বাচন সামনে রেখে ফেসবুকের কারণে মিথ্যা, গুজব আরও ভয়াবহ মাত্রায় হবে এমন শঙ্কার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, গাছকাটার জন্য দেশে যে পরিমাণ লোক কাঁদে সংখ্যালঘুদের জন্য তা নেই। সংগঠিত হয়ে কিছু করতে না পারলে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো যাবে না বলেও মনে করেন তিনি। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস হয় উল্লেখ করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, সংবিধান দেশে সংখ্যালঘু বানিয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণায় ধর্মের ব্যবহার নির্বাচন কমিশন বন্ধ করতে পারে। ধর্মকে আক্রমন করে ওয়াজে বক্তব্য দিলে কেউ গ্রেপ্তার হয় না, অথচ প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কেউ কটূক্তি করলে গ্রেপ্তার করা হয়।

পৃথক সংখ্যালঘু সমন্ত্রণালয়ের দাবি জানিয়ে শাহরিয়ার কবির বলেন, আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ দেশের কোথাও কেউ অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হলে ইসি দায়ি থাকবে। এজন্য দেশের ৬২টি হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা যেখানে ১২ থেকে ৪৫ ভাগ সংখ্যালঘু ভোটার আছে সবখানে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে হবে। তাছাড়া আমরা যাদের ভোট দেব তাদের বাধ্য করতে হবে বিজয়ী হওয়ার পর প্রতিশ্রুতি যেন পূরণ করে।

মতবিনিময় সভায় মূল প্রবন্ধে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার পাঁচদফা দাবি তুলে ধরে বলেন, গণতান্ত্রিক ধারাকে শক্তিশালী করতে রাজনীতি এবং নির্বাচনে ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতার ব্যবহার সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ করা করতে হবে। ঘৃণা বক্তব্য বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অন্য ধর্মের মানুষকে হেয় করে বক্তব্য দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। সমাজে সাম্প্রদায়িকতার চর্চা ও মুক্তবুদ্ধির বিকাশে রাজনৈতিক, বুদ্ধিজীবী ও ধর্মবেত্তাদের ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।

এ ছাড়া রাজনৈতিক কৌশলের নামে রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী, নারী নির্যাতনকারী, সাম্প্রদায়িক ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকারী জায়গা-জমি ও মন্দির দখলকারীদের মনোনয়ন না দেওয়া, নির্বাচনকালে এবং নির্বাচন পরবর্তী সময়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সভায় বক্তব্য রাখেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি অধ্যাপক ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক, সাংবাদিক সোহরাব হাসান, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী, ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল প্রমুখ।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সাবেক এমপি ফারুক চৌধুরীর ‘বডিগার্ড’ গ্রেপ্তার

পাকিস্তানকে পানি ও ভাতে মারবে ভারত

কুয়াকাটায় জমি নিয়ে দুপক্ষের সংঘর্ষ, আহত ১০

দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবে : হাসনাত আব্দুল্লাহ

ভারত-পাকিস্তান সংঘাত, ফেনী সীমান্তে বিজিবির টহল জোরদার

জুলাইয়ের নতুন সংগঠন ‘আপ বাংলাদেশ’-এর আত্মপ্রকাশ

রাজধানীর ৫ হাজার শিক্ষার্থীকে পুরস্কার দিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র

আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে শাহবাগ অবরোধ

আ.লীগ নিষিদ্ধে কী আইন আছে, জানালেন আসিফ নজরুল

মেগা প্রকল্পের নামে লুটপাট হয়েছে : উপদেষ্টা ফাওজুল কবির

১০

সরকারি আদেশে ভারতে বন্ধ ‘দ্য ওয়ার’ নিউজ সাইট

১১

রাতে ৬০ কিমি বেগে বজ্রবৃষ্টির পূর্বাভাস

১২

চুয়াডাঙ্গায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা, গরমে হাঁসফাঁস

১৩

পাকিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ভিডিও প্রকাশ

১৪

আ.লীগ নিষিদ্ধের সমাবেশে স্প্রে ক্যানন দিয়ে ছিটানো হচ্ছে পানি

১৫

কলা বাগান থেকে ২২ ককটেল উদ্ধার

১৬

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নতুন দাবি

১৭

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ভর্তি পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন

১৮

মানবতার শত্রু আ.লীগকে দ্রুত নিষিদ্ধ ও বিচার করতে হবে : হেফাজতে ইসলাম

১৯

আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে সমাবেশ চলছে

২০
X