মেজর (অব.) সিকদার আনিসুর রহমান। ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী। আসন্ন উপনির্বাচনে তার প্রার্থিতা ও জনপ্রতিনিধি হিসেবে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ নানা বিষয় নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা
কালবেলা: ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে আপনি জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন। আপনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত কেন নিলেন?
সিকদার আনিসুর রহমান: ঢাকা-১৭-এর বাসিন্দা আমি। আমার পরিবার, সন্তান, আত্মীয়স্বজন সবাই এখানকার ভোটার। আর জাতীয় পার্টিকে মন থেকে ধারণ করি। এসব কারণে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছি।
আমি জাতীয় পার্টির প্রার্থী হওয়া প্রসঙ্গে বলার আগে প্রথমে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। ক্যাডেট কলেজে লেখাপড়ার সময় থেকেই জাতীয় পার্টিকে ভালো লাগে। আমি দেখেছি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কীভাবে সারা বাংলাদেশে বিচরণ করেছেন। দেখেছি, ১৯৮৮ সালের বন্যায় তিনি কীভাবে নেতৃত্ব দিয়ে মানুষকে সহযোগিতা করেছেন। স্থানীয় সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ, উপজেলা করা, ঢাকাকে সারা বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত করাসহ তিনি যেসব প্রগ্রেসিভ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তাতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ উপকৃত হয়েছেন। সব মানুষকে তিনি সমান চোখে দেখেছেন। মসজিদ-মন্দিরের বিদ্যুৎ বিল মওকুফ করেছেন। এসব কারণে এরশাদ সাহেব আমাদের জন্য আইডল ছিলেন। তাকে ভালো লাগা থেকেই জাতীয় পার্টিকে ভালো লাগা।
কালবেলা: এটি একটি উপনির্বাচন যার মেয়াদ মাত্র পাঁচ-ছয় মাস। এই পাঁচ-ছয় মাসের জন্য নির্বাচনে কেন অংশগ্রহণ করলেন?
সিকদার আনিসুর রহমান: একটি রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে নির্বাচন আসলে তাকে অংশগ্রহণ করতে হবে। সেটা এক মাস বা পাঁচ মাসের জন্য হোক। তাই এই উপনির্বাচন এক মাস মেয়াদের জন্য হলেও আমি এখানে অংশগ্রহণ করতাম।
কালবেলা: নির্বাচিত হলে আপনি এলাকাবাসীর জন্য কী করতে চান?
সিকদার আনিসুর রহমান: একজন জনপ্রতিনিধি যদি তার এলাকাকে ভালোবাসেন, যদি তিনি মানুষের সঙ্গে কানেক্টেড হন তাহলে সরকারে না থাকলেও তিনি অনেক কিছু করতে পারেন। নির্বাচিত হলে তার অনেক দায়িত্ব চলে আসে। তিনি যদি সৎভাবে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে চান তাহলে তিনি সবসময়ই সরকারের সঙ্গে দরকষাকষিতে থাকবেন। আমি সেটাই চেষ্টা করব।
কালবেলা: ঢাকা-১৭ আসন ঢাকার অন্যতম বড় একটি আসন। এখানে অতিদরিদ্র এবং ধনী দুটি শ্রেণি রয়েছে। এই দুই শ্রেণির বৈষম্য দূরীকরণে আপনি কী করবেন?
সিকদার আনিসুর রহমান: বস্তি এলাকাগুলোয় নির্বাচন উপলক্ষে এখন ভিজিট করছি, এমন নয়। কড়াইল বস্তিতে আমি গিয়েছি, ভাষানটেক বস্তিতে আমি সবসময়ই যাই। আগে কর্মী হিসেবে গিয়েছি। তার আগে এলাকার মানুষ হিসেবে গিয়েছি। বস্তি এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা অনেক কঠিন। তাদের দিকে সরকারের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। তাদের জন্য সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন, তা হলো পুনর্বাসন। তাদের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারলে এখানে সরকারের জন্যও লাভ। তারা একটি বিশাল এলাকাজুড়ে বসবাস করে এবং অতি নিম্নমানের জীবনযাপন করছে। এই এলাকার অর্ধেক জায়গা তাদের পুনর্বাসনের জন্য ব্যবহার করা গেলে বাকি অর্ধেক জায়গা সরকার অন্য উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার করতে পারে। সরকার একেবারেই করছে না, তা না। তবে এক্ষেত্রে আরও তদারকি করা দরকার, যাতে সঠিক মানুষটি উপকারভোগী হয়।
দ্বিতীয়ত, গুলশান-বনানীতে যে শ্রেণিটা বসবাস করে তাদের জন্যও অ্যাটেনশনের প্রয়োজন রয়েছে। গুলশান-২ থেকে গুলশান-১-এ যেতে লাগে এক ঘণ্টা। এটা কোনো আবাসিক এলাকার চিত্র হতে পারে না। যানজট নিরসন, রাস্তাঘাটের ব্যাপার, সরকারি স্বাস্থ্য সুবিধার ব্যাপার—এগুলো কমন সমস্যা। এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারলে সব মানুষই সমানভাবে উপকৃত হবেন।
কালবেলা: নির্বাচনে জাতীয় পার্টি বলছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছাড়া এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। তাহলে এ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচন থেকে আপনারা কী আশা করছেন?
সিকদার আনিসুর রহমান: ঢাকা-১৭ আসনের জনগণ দীর্ঘদিন ধরে এই আসনের কোনো জনপ্রতিনিধি পাননি। বিগত সময়ে প্রয়াত নায়ক ফারুক এই এলাকার এমপি ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ থাকায় তাকে এলাকার মানুষ খুব একটা দেখেনি। তার আগে যিনি ছিলেন তিনিও দূর থেকে এসেছিলেন এবং এই এলাকার অধিবাসী ছিলেন না। সুতরাং তিনিও এলাকার মানুষকে অতটা সময় দিতে পারেননি। জনগণ আমাকে চাচ্ছে কারণ আমি এই এলাকার মানুষ। আমি এখানে থাকি, এখানেই বিচরণ করি। আমি যদি নির্বাচনে এই এলাকার জনপ্রতিনিধি হিসেবে বিজয়ী হতে পারি তাহলে এলাকার মানুষ সব সময়ই আমাকে পাবেন।
কালবেলা: এই আসনের আগের নির্বাচনগুলোয় আপনাদের ফল খুব একটা ভালো না। এবার জেতার বিষয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?
সিকদার আনিসুর রহমান: আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। প্রথমত, আমি জনসংযোগ করে দেখেছি, আমরা যারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছি এবং রাজনীতিতে এসেছি, তাদের ওপর মানুষের আস্থার জায়গা রয়েছে। সেনাবাহিনীকে মানুষ বড় আস্থার জায়গায় রেখেছে। দ্বিতীয়ত, এই এলাকার মানুষ আমাকে পছন্দ করছেন। তৃতীয়ত, এই এলাকায় জাতীয় পার্টির কিছু একনিষ্ঠ কর্মী রয়েছেন যারা হয়তো আগে সঠিক নেতৃত্ব না পাওয়ায় নিজেদের জায়গাটাকে এক্সপ্লোর করতে পারেননি। সব মিলিয়ে মানুষ আমার ওপর আস্থা রাখছেন এবং বিশ্বাস করছেন। আমি যদি বিজয়ী হয়ে তাদের সেবা করতে পারি তাহলে আমি খুশি হবো।
কালবেলা: নির্বাচনে কেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে আপনি মনে করছেন?
সিকদার আনিসুর রহমান: আওয়ামী লীগ অনেক বড় দল। মাঠপর্যায়ে তাদের যে কর্মী বাহিনী রয়েছে তারা অনেক সুসংগঠিত। অন্য যে প্রার্থীরা রয়েছেন তাদের প্রতিও মানুষের সমর্থন রয়েছে। এই আসনের এলাকাটি অনেক স্পর্শকাতর একটা জায়গা। কারণ এখানে রয়েছে ডিপ্লোম্যাটিক জোন, এখানে রয়েছে ক্যান্টনমেন্ট। এখানে অনেক ধনী শ্রেণি বসবাস করেন। আবার অনেক গরিবও রয়েছেন। দেশ-বিদেশে নিজেকে উপস্থাপন করার বিষয় রয়েছে।
কালবেলা: আন্তর্জাতিকভাবে এই নির্বাচনের অনেক গুরুত্ব রয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আপনারা কীভাবে এগোতে চান?
সিকদার আনিসুর রহমান: জাতীয় পার্টি এখন বিরোধী দল। তবে বিএনপি অবশ্যই বৃহত্তর দল। মানুষ যদি এই এসেসমেন্ট ধারণ করে থাকেন যে, নির্বাচনে মানুষের অংশগ্রহণ নেই এবং নির্বাচনের ওপর মানুষের আস্থা নেই; পক্ষান্তরে ঢাকা-১৭ আসনের নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হয়, এই নির্বাচন যদি বায়াসড না হয় তাহলে পৃথিবীর মানুষ দুটি চিত্র দেখতে পাবে। একটি চিত্র হলো—নির্বাচনের পরিবেশ নেই, নির্বাচনের ওপর মানুষের আস্থা নেই। দ্বিতীয় চিত্রটি হলো—সরকার চাইলে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারে। সুতরাং এখান থেকে বাংলাদেশের বাইরের দেশগুলো দুটি চিত্র দেখতে পাবে। বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশের একটা ভালো চিত্র তুলে ধরা যাবে। সরকার এই নির্বাচনকে উদাহরণস্বরূপ দেখাতে পারে যে, তাদের অধীনে ভালো নির্বাচন সম্ভব এবং তারা আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করবে।
কালবেলা: নির্বাচিত হলে এই সময়ের মধ্যে জনগণের জন্য আপনি কী করতে চান?
সিকদার আনিসুর রহমান: আমি যে জিনিসগুলো করতে চাই তার পরিকল্পনা আমি ঠিক করেছি। আমার প্রথম কাজ হবে— জনগণের জন্য সরকারের যে বাজেট আছে তা যাতে জনগণের কাছে যাতে পৌঁছায়, সেটা নিশ্চিত করা। যেমন, শিক্ষা খাতের বাজেট, স্বাস্থ্য খাতের বাজেট। হাজার হাজার কোটি টাকার বাজেট ঠিকভাবে জনগণের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছলে তাদের ভাগ্যোন্নয়ন করা সম্ভব। ব্যক্তিগতভাবে এ ব্যাপারটাতে সিরিয়াস হবো। ঢাকা-১৭ আসন বাংলাদেশের মধ্যে একটি আইকন। সেই আইকন হিসেবে এটাকে তৈরি করার জন্য যা প্রয়োজন তার সবই আমি করব। এ আসনকে আমি স্মার্ট হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।
কালবেলা: বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্বাচনের ক্ষেত্রে অর্থ একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা-১৭ আসনে আপনার অভিজ্ঞতা কী?
সিকদার আনিসুর রহমান: আমি নিয়মের প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল। ঢাকা-১৭ আসনের জন্য নির্বাচনের বাজেট ২৫ লাখ টাকা। সরকার যেটা ভেবেছে অনেক চিন্তাভাবনা করে ঠিক করেছে। এটি দেখার দায়িত্ব সরকারের। নির্বাচনের বাজেট অনুসরণ করা হয় না, সেটা সবাই জানে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলছে না। যেভাবে টাকা ছড়ানো হচ্ছে—যে তিন লাখ বা পাঁচ লাখ বস্তিবাসী তাদের প্রত্যেককে ১০০ টাকা করে দিলেও কত টাকা হয়! শুধু এটুকুই নয়, বিরিয়ানি খাওয়ানো হচ্ছে, দিনরাত মাইক বাজানো হচ্ছে, এমনকি বস্তি এলাকার ক্ষমতাশালীরা অন্যদের জিম্মি করে রাখছে। এভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না।
আমি ২৫ লাখ টাকা বণ্টন করে দেখেছি। ব্যানার, পোস্টার, জনগণের সঙ্গে হাত মেলানো, তাদের কাছে দোয়া চাওয়া আর কর্মীদের চা-নাশতা খাওয়াতে হয়। সব মিলিয়ে আমি দেখেছি, নির্বাচনের জন্য নির্ধারিত বাজেট ২৫ লাখ টাকার মধ্যে থাকা খুবই কঠিন। তাহলে এই টাকায় কীভাবে আমি একটি বস্তির ৫ লাখ লোককে এন্টারটেইন করব। যারা এটি করছেন, তারা অবশ্যই অন্যায় করছেন। তারা সরকারের রুলস এবং রেগুলেশন ভায়োলেন্স করছেন। এটিকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমি নির্বাচন কমিশনের কাছে এবং পুলিশ প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করেছি। প্রশাসন আমাকে আস্থা জানিয়েছে যে, তারা এগুলো দেখবে। আমি আশা করব, তারা কথা রাখবে। যদি না করে তাহলে সঠিক নেতৃত্ব কখনোই প্রকাশিত হবে না।
মন্তব্য করুন