এবিএম জুবায়ের
প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২৫, ০৮:১৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

ডাবলিন কনফারেন্স বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ বেগবান করবে

এবিএম জুবায়ের। ছবি : সৌজন্য
এবিএম জুবায়ের। ছবি : সৌজন্য

বিগত দুই দশকে বিশ্বব্যাপী প্রাপ্তবয়স্ক (১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব) জনগোষ্ঠীর মধ্যে তামাক ব্যবহারের প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ট্রেন্ডস ইন প্রিভেলেন্স অব টোব্যাকো ইউজ ২০০০-২০৩০’ অনুযায়ী, ২০০০ সালে যেখানে বিশ্বে প্রতি ০৩ জনে ১ জন (৩২.৭%) তামাক ব্যবহার করতেন, ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে প্রতি ৫ জনে ০১ জন (২০.৯%)। সার্বিকভাবে, এই সময়ে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা তুলনামূলক হ্রাস (রিলেটিভ রিডাকশন) পেয়েছে ৩৬ শতাংশ। মূলত তামাক নিয়ন্ত্রণের আন্তর্জাতিক চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) এর সুপারিশ অনুসরণ করে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের ফলেই এই গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশেও এই অগ্রগতির ধারা পরিলক্ষিত হয়েছে। সর্বশেষ প্রকাশিত গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭ অনুযায়ী, ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর (১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব) মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ১৮.৫ শতাংশ (রিলেটিভ রিডাকশন) হ্রাস পেয়েছে, যা সন্তোষজনক।

বিশ্বব্যাপী তামাক ব্যবহারজনিত মৃত্যু এখনো ব্যাপক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে ৮০ লাখেরও বেশি মানুষ তামাক ব্যবহারের কারণে মৃত্যুবরণ করেন এবং বাংলাদেশে এই সংখ্যা ১ লাখ ৬১ হাজার। ২০২৩ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী মৃত্যুঝুঁকির কারণ (রিস্ক ফ্যাক্টর) হিসেবে তামাকের অবস্থান ২য়, যা এর ভয়াবহতাকেই নির্দেশ করে। উদ্বেগের বিষয় হলো, বিশ্বের মোট ১.৩ বিলিয়ন তামাক ব্যবহারকারীর সিংহভাগ অর্থাৎ প্রায় ৮০ শতাংশই বাস করেন বাংলাদেশের মতো নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে, যা এ অঞ্চলের জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতির উপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করছে।

তামাকের মৃত্যুছোবল থেকে জনস্বাস্থ্যকে সুরক্ষা প্রদান করতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক উদ্যোগের সাথে সম্পৃক্ত শুরু থেকেই। ২০০৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে গৃহীত আন্তর্জাতিক চুক্তি ‘ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল’ (এফসিটিসি)-তে স্বাক্ষরকারী প্রথম দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। এই চুক্তির বিধানগুলো কার্যকর করতে বাংলাদেশ ২০০৫ সালে ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন’ প্রণয়ন করে এবং ২০১৩ সালে তা সংশোধন করে আরও যুগোপযোগী করে তোলে। ২০১৫ সালে এই আইনের অধীনে বিধিমালাও প্রণয়ন করা হয়। বর্তমানে এফসিটিসির সাথে অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটিকে আরও শক্তিশালীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত খসড়ায় পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহনে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান (ডিএসএ)’ বাতিল, বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্য বা প্যাকেট প্রদর্শন বন্ধ, ই-সিগারেট ও ভেপিং পণ্য নিষিদ্ধকরণ, তামাক কোম্পানির সিএসআর বন্ধ এবং খুচরা বা খোলা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধকরণসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আইন সংশোধনের খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই প্রস্তাবিত সংশোধনী অনুমোদিত ও বাস্তবায়িত হলে তা তামাক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থানকে নিঃসন্দেহে আরও সুদৃঢ় করবে।

বিশ্বব্যাপী তামাক ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে কর বৃদ্ধির মাধ্যমে তামাকপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি একটি পরীক্ষিত ও কার্যকর পদ্ধতি। বাংলাদেশে তামাক কর কাঠামোয় কিছু অগ্রগতি সাধিত হলেও বিদ্যমান জটিল কর ব্যবস্থা তামাকের ব্যবহার কার্যকরভাবে নিরুৎসাহিত করতে এবং সরকারের রাজস্ব আদায় কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নীত করতে পুরোপুরি সফল হয়নি।

বর্তমানে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ‘ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস’ যেমন ই-সিগারেট, ভ্যাপিং, হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট ইত্যাদি। তামাক কোম্পানিগুলো মূলত তরুণ এবং শিশুদের লক্ষ্য করে উদ্ভাবনী কৌশল, সুগন্ধি ব্যবহার এবং আকর্ষণীয় ডিজাইনের মাধ্যমে এসব পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করছে, যার ফলে কিশোর ও তরুণদের মাঝে এর জনপ্রিয়তা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর পাশাপাশি, তামাক কোম্পানির অপতৎপরতাও একটি বড় বাধা। ২০২৩ সালের বৈশ্বিক তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সূচক প্রতিবেদনে ৭২ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একেবারে তলানিতে। এটি প্রমাণ করে যে, এফসিটিসি আর্টিকেল ৫.৩ অনুযায়ী জনস্বাস্থ্য নীতিতে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ বন্ধে বাংলাদেশ তেমন অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি। তবে সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং এর অধীনস্থ অধিদপ্তর, দপ্তর ও সংস্থার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসি আর্টিকেল ৫.৩ গাইডলাইন প্রণয়ন করা হয়েছে, যা আশাব্যঞ্জক। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পথ অনুসরণ করে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জন্য একটি গাইডলাইন প্রণয়ন অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশে এখনো ৩৫.৩% প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। বিশেষ করে দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের প্রবণতা অনেক বেশি। এছাড়া, নারীদের মধ্যে ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের উচ্চহারও একটি বড় উদ্বেগের কারণ। এই প্রেক্ষাপটে, আগামী ২৩-২৫ জুন ২০২৫ আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে ‘ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স অন টোব্যাকো কন্ট্রোল ২০২৫’ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস এর সহায়তায় দি ইউনিয়ন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই সম্মেলনটিতে বিশ্বের প্রতিথযশা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, সরকারি কর্মকর্তা এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের অগ্রগতি, বিদ্যমান অবস্থা এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের বৈশ্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য একত্রিত হবেন। বাংলাদেশের জন্যও এই সম্মেলন বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ তামাক নিয়ন্ত্রণের আন্তর্জাতিক সর্বোত্তম নীতি সম্পর্কে জানার এবং পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ের এক বিশাল সুযোগ তৈরি করবে। ডাবলিন সম্মেলন থেকে অর্জিত জ্ঞান ও কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে একটি তামাকমুক্ত, সুস্থ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথ সুগম হবে।

লেখক : এবিএম জুবায়ের, নির্বাহী পরিচালক, প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান)

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দুই উপদেষ্টার গাড়ি আটকে বিক্ষোভ, মামলায় আসামি ১৫৯

ইসরায়েলের হামলায় ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দাপ্রধান নিহত

দাউ দাউ করে জ্বলছে ইসরায়েল

ইসরায়েলের বিমানবন্দরে আঘাত হানল ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র

নেতানিয়াহুর বাসভবন এলাকায় ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

এবার ইসরায়েলিদের ফিলিস্তিনের অধিকৃত অঞ্চল ছাড়তে বলল ইরান

মুসিয়ালা ম্যাজিক! অকল্যান্ডকে ১০-০তে গুঁড়িয়ে দিল বায়ার্ন

ইসরায়েলিদের পালাতে বলল সেনাবাহিনী

ইরানের হাইপারসনিক ইসরায়েলের হাইফা তেল আবিব ও নেগেভ বিমানঘাঁটিতে আঘাত করেছে

কী কথা বললেন এরদোয়ান-ট্রাম্প?

১০

ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ছাত্রের হাত ভেঙে দিলেন মাদ্রাসা শিক্ষক

১১

কোল্ড স্টোরেজে ভাড়া বৃদ্ধি প্রতিবাদে আলু চাষিদের বিক্ষোভ

১২

নরসিংদীতে বিএনপির দুগ্রুপের সংঘর্ষ, ওসিসহ আহত ৪

১৩

জনগণই বিএনপির মূল শক্তি : খোকন

১৪

পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত হবে আন্তর্জাতিক টুরিস্ট স্পট : চসিক মেয়র

১৫

দুই উপদেষ্টার গাড়ি আটকে বিক্ষোভ, যুবদল নেতাকে বহিষ্কার

১৬

সিলেট ওসমানী মেডিকেলে কর্মবিরতিতে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা

১৭

‘৫ আগস্ট স্বৈরাচার হাসিনার পলায়ন বাংলাদেশের বিপ্লবের ইতিহাসের স্বর্ণালী দিন’

১৮

খামেনির ওপর হামলার বিষয়ে যে অবস্থান নিলেন ট্রাম্প

১৯

এবার এইচএসসি পরীক্ষায় আসনের দূরত্ব বাড়ছে

২০
X