মনু মিয়া ছিলেন কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের আলগাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনি এখন ৬৭ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন। তিনি কবরের কারিগর। একজন সুদক্ষ গোরখোদক হিসেবে মনু মিয়ার সুনাম ইটনা, মিঠামইন, শাল্লা, আজমিরীগঞ্জসহ পাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল রাজধানীর বনানী কবরস্থানসহ দেশের নানা প্রান্তে তার কবর খোঁড়ার সুনাম আছে। শুধু কবর খনন করেই ক্ষান্ত হননি মনু মিয়া। দূরগাঁয়ে হয়তো কোথাও মাইকে বেজেছে মৃত্যুসংবাদ। অমনি তার বুকে ধকধক শব্দ ওঠে। এই সংবাদ শুনেই খুন্তি, কোদালসহ প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘোড়ায় করে ছুটে যান কবরস্থানে। মানুষের অন্তিম যাত্রায় তিনি বাড়িয়ে দেন তার আন্তরিকতার হাত। এভাবেই কবর খুঁড়ে যাচ্ছিলেন ৫০ বছর ধরে। এ জন্য নেন না কোনো পারিশ্রমিক। এভাবে নিঃস্বার্থ সেবার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। মনু মিয়ার ডায়েরির তথ্যানুযায়ী, এ পর্যন্ত তিনি কবর খুঁড়েছেন ৩ হাজার ৫৭টি। এ পর্যন্ত যাদের কবর খুঁড়েছেন, তাদের মৃত্যুর দিন-তারিখ সব লিখে রেখেছেন। তিনি সারা জীবন নিঃস্বার্থভাবে মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন।
ছোটবেলায় মনু মিয়া ছিলেন অত্যন্ত ডানপিটে ও দুরন্ত কৈশোরেই তার আবদার রক্ষা করতে বাবা আবদুল হেকিম মিয়াকে ঘোড়া পর্যন্ত কিনে দিতে হয়েছিল। হাসিখুশি আর হৈ-হল্লায় মেতে থাকা মনু মিয়ার জীবনে হঠাৎ করেই ঘটে ছন্দপতন। কারও মৃত্যুসংবাদ শুনলেই তার মানসপর্দায় ভেসে উঠত মায়ের কথা। অকৃত্রিম ভালোবাসার সেই মা মাটির ঘরের শেষ বিছানায়, কেমন কাটছে তার দিন? কেমন আছেন মা? মাকে নিয়ে এসব খুব ভাবাত মনু মিয়াকে। এভাবে যাওয়া-আসা থেকেই স্থানীয় গোরখোদকদের সঙ্গে মনু মিয়া একদিন কবর খননের কাজে অংশ নেন। ক্রমশ দক্ষতা অর্জন করে তিনি হয়ে ওঠেন কবর তৈরির দক্ষ ও নিপুণ কারিগর। পরে তার জীবনের বড় আদরের এ কাজটিকেই জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। একজন নিখুঁত সুদক্ষ গোরখোদক হিসেবে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
মনু মিয়ার উপলব্ধি মানুষের অন্তিম শয়নের কবরটি হতে হবে সুন্দর, নিখুঁত ও সৃষ্টিশীল। কারণ মৃত্যু হচ্ছে জীবনের শেষ ঠিকানা। জন্মের একমাত্র শর্ত হলো মৃত্যু। দুনিয়াদারিতে কত ক্ষমতা, ধন, সম্পদ। অন্তিম শয়ানে কিছুই দেওয়া যায় না। একমাত্র কাফনের কাপড় ছাড়া। তাইতো বিদায়বেলায় কোনো অযত্ন নয়। তাই কবর খুঁড়তে এবং সুন্দর করতে যতসব জিনিসপত্রের দরকার সবই আছে মনু মিয়ার কাছে। কবর খনন করার জন্য নিজের খরচায় তিনি কোদাল, দা, করাত, রামদা, হাতুড়ি, ছোট-বড় খুন্তিসহ সব প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তৈরি করে নিয়েছেন।
মনু মিয়া গরিব মানুষ। কিন্তু তার ছিল সাধ্যের অতিরিক্ত সাধ; ছিল গরিবের ঘোড়া রোগ। কবর খুঁড়তে দূরের যাত্রায় দ্রুত পৌঁছাতে নিজের ধানি জমি বিক্রি করে কয়েক বছর আগে একটি ঘোড়া কিনেছিলেন মনু মিয়া। ঘোড়াটি সচল রেখেছিল তাকে। জীবনভর কবর খোঁড়ার কাজ করতে গিয়ে নিজের দিকে খেয়াল হয়নি মনু মিয়ার। সম্প্রতি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন মনু মিয়া। বাড়িতে মনু মিয়া ও তার স্ত্রী রহিমা বেগমের অনুপস্থিতিতে অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ে ঘোড়াটি। এরই মধ্যে ঘটে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। ঘোড়াটিকে মেরে ফেলে দুর্বৃত্তরা। ১৬ মে সকালে পাশের মিঠামইন উপজেলার হাশিমপুর ছত্রিশ গ্রামের একটি মাদ্রাসার পাশে পানির মধ্যে ঘোড়াটির মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন এলাকাবাসী। ঘোড়াটির বুকে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল। ঘোড়াটি যে মনু মিয়ার তা বুঝতে সময় লাগেনি স্থানীয়দের। ঘোড়ার মৃত্যুর খবরে দলে দলে বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষ একনজর দেখতে আসেন ঘোড়াটিকে। তখনো ঘোড়াটির বুক থেকে রক্ত ঝরছিল আর সেই রক্ত মিশে লাল হয়ে ওঠে জমির পানি। এলাকাবাসী হতবাক হয়ে পড়েন।
সবখান থেকেই এই প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হয়েছে, ঘোড়াটি মারল কারা? ঘোড়ার শত্রু কারা? এর সুনির্দিষ্ট উত্তর না জানলেও কেউ কেউ এ উত্তর হিসেবে মন্তব্য করেছেন ‘অমানুষ’ শব্দটি। কেউ লিখেছেন, ‘মানুষ এত নৃশংস!’ আবার কেউবা লিখেছেন—‘মানুষ কেন মানুষ হয় না।’ এসবই পাঠকের মন্তব্য। পাঠকের মন্তব্য যদি ঠিক হয়, তাহলে মানুষের হৃদয় তো ঘোড়ার ক্ষুরের চেয়েও শক্ত, অনমনীয়। নির্দয়। অথচ জানি, মানুষ মানবিক জীব। যে মানুষ ফুল দেখে মুগ্ধ হয়, সে মানুষ কি ঘোড়ার মতো নির্বাক প্রাণী হত্যা করতে পারে!
ঘরের শত্রু বিভীষণ এই বাগধারা নিশ্চয়ই সবার জানা। বিভীষণ অর্থ অতিশয় বা ভীষণ ভয়ংকর। কিন্তু ঘোড়ার শত্রু কি বা কারা? এটা আমরা জানি না। হয়তো জানেন না দরিদ্র মনু মিয়াও। মনু মিয়া জীবনে কারও কোনো ক্ষতি করেননি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। কোনো দিন ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার (মধ্যবর্তীকে অতিক্রম করে কাজ করা) মতো কাজও করেননি। মানুষ তাঁকে ভালোবাসে। তিনিও মানুষকে ভালোবাসেন। নিজের ছোট্ট ঘর পেরিয়ে পুরো গ্রাম, দূর গ্রামকেও ঘর ভাবতেন তিনি। তাইতো মৃত্যুর খবর পেলেই ছুটে যেতেন কবর খুঁড়তে। ভালোবাসার আড়ালে তার এই বিশাল ঘরেই (গ্রামে) হত্যা করা হলো প্রিয় ঘোড়াটিকে। তাহলে তো বলা যায়, ঘরের শত্রু বিভীষণের মতো ঘোড়ার শত্রুও ভয়ংকর, বিভীষণ।
এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বিষয়টি ভাইরাল হওয়ার পর দেশি-বিদেশ থেকে অনেকেই মনু মিয়াকে দামি ঘোড়াসহ নানা সহযোগিতা করতে চান। কিন্তু মনু মিয়া কারও সহায়তা নিতে রাজি হননি। তিনি শুধু সবার কাছে তার সুস্থতার জন্য দোয়া চেয়েছিলেন, আবার যাতে অন্যের জন্য কবর খুঁড়তে পারেন। আত্মসম্মানবোধের কি অন্যন্য নজির! আত্মসম্মানবোধ কাকে বলে, ঠিক এই ভদ্রলোকটি দেখিয়ে গেলেন। কোনো পাঠক লিখেছেন, এ দেশে মানুষের পাশাপাশি প্রাণীদের জীবনের নিরাপত্তা নেই। তারা এই ঘোড়া হত্যার সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে বিচার দাবি করেছেন। তাদের এ দাবি পূরণ হোক। নির্বাক প্রাণী বলে যেন কাউকে বলতে না হয়, নো ওয়ান কিলড দ্য হর্স।
নির্দয় মানুষের খুব কাছে হৃদয়বান মানুষেরাও থাকে। মনু মিয়ার ঘোড়া নিয়ে ফেসবুক পেজের পোস্টে আসা মন্তব্য থেকে জানা গেছে, অনেকেই মনু মিয়াকে ঘোড়া কিনে দিতে চেয়েছেন। তাহলে যে মানুষ ঘোড়ার খুনি আর যে মানুষ মানুষের মৃত্যু বেদনায় মুষড়ে পড়ে—তাদের পাশেই আবার দেখা যাবে মনু মিয়াকে। গ্রামের আলপথে আবারও ঘোড়া ছুটিয়ে যাবেন তিনি। ঘোড়ার সেই হ্রেষাধ্বনি আগের মতোই মুগ্ধ করবে সবাইকে। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি, কারণ তিনি না ফেরার দেশে ফাড়ি দিয়েছেন।
নোবেলজয়ী মার্কিন লেখক জন স্টেইনবেক বলেছেন, ‘ঘোড়ায় আরোহী একজন মানুষ আধ্যাত্মিকভাবে, শারীরিকভাবেও, পায়ে হেঁটে চলা একজন মানুষের চেয়ে বড়।’ মনু মিয়া আর সব মানুষের চেয়ে হৃদয়ের দিক দিয়ে হয়তো সত্যিই বড় ছিলেন।
এই জগত সংসারে এমন মানুষের দেখা পাওয়াও সৌভাগ্যের। সত্যি সত্যিই মনু মিয়ারা আসল হিরো। মানুষ চিরকাল বেঁচে থাকে না, কিন্তু তার কর্ম রয়ে যায় চিরকাল। গোরখোদক মনু মিয়া আজ বেঁচে নেই। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মনে সে এখন মহানায়ক।
মনু মিয়া মনের গহিনের পরম দরদ আর অপার ভালোবাসা দিয়ে সৃষ্টিশীল শিল্পীর মতো তৈরি করেন শেষ ঠিকানা কবর। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, দূর থেকে দূরান্তরে কারও মৃত্যুসংবাদ কানে আসা মাত্রই ছুটে যান তিনি। সেই ঘোড়াটিই হয়ে ওঠে তার সহচর—যেটা নিয়ে দিনের আলো হোক কিংবা রাতের অন্ধকার, মানুষের মৃত্যুর সংবাদ পেলেই টগবগ করে ছুটে যেতেন। চোখে নির্ভীক নিষ্ঠা। মানুষের অন্তিম যাত্রায় একান্ত সহযাত্রীর মতো তিনি বাড়িয়ে দেন দুহাত। এভাবেই কবর খননের কাজ করে তিনি পার করে দিয়েছেন তার ৬৭ বছরের জীবনের সুদীর্ঘ ৪৯টি বছর। কোনো ধরনের পারিশ্রমিক কিংবা বকশিশ না নিয়ে এ পর্য্যন্ত খনন করেছেন ৩ হাজার ৫৭টি কবর।
তিনি মনে করতেন, তার কোনো শত্রু নেই। তিনিও কখনো মনে করতেন না, কেউ তার ক্ষতি করতে পারেন। তিনি সবাইকে আপন মনে করতেন। এ জন্যই তিনি ছুটে যেতেন সবার করব খুঁড়তে। যদি রাতে খাওয়ার পরে শোনেন কাল কোথায় কবর খুঁড়তে যেতে হবে। পরে তিনি আর কিছুই খেতে পারতেন না। পরের দিন করব দেওয়া শেষ হলে সন্ধ্যায় এসে বাড়িতে খেতেন। মৃত্যুবাড়িতে তিনি কিছু খেতেন না। এমনকি কোনো টাকাও কোনো দিন নিতেন না। খাবারের অনিয়ম করতেন। মানুষের পাশে থাকাটাই তার কাছে ছিল প্রথম।
এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে কেউ কেউ কান্না আটকে রাখতে পারেননি। কেউ বলেছেন, মনু চাচার ঘোড়াটির মতো এমন প্রাণী আর আসবে না। আঘাত শুধু ঘোড়াটিকে করা হয়নি বরং মনু চাচাকে আঘাত করা হয়েছে। প্রাণীটির মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমে আসে এলাকাজুড়ে। আফসোস ও আক্ষেপের পাশাপাশি ঘোড়াটির হত্যাকারীদের শনাক্ত এবং শাস্তির দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। ঘোড়া হারিয়ে তিনি কষ্ট পাননি, এমনটা নয়। কিন্তু তার ভাষায়, ‘যার আছে, তারই যায়। কপালে লেখা ছিল, তাই গেছে। কে মারল, দেখিনি, কাকে দোষ দেব?’ এমন ভাবনার মানুষ সমাজে আজ বিরল।
মনু মিয়ারাই সমাজের প্রকৃত নায়ক। এমন মানুষের কথা শুনলে জটিলতায় ভরা দুনিয়া অনেকটাই সহজ হয়ে আসে। মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি তারা নিঃস্বার্থভাবে আলাদা দায় অনুভব করেন। যা আমাদের এই সমাজে সবার জন্য অনুসরণীয়। মনু মিয়াই আমাদের এক উজ্জ্বল আদর্শ হয়ে উঠেছেন। মনু মিয়া নায়ক হতে চাননি। তার মহৎ কাজ তাকে আমাদের নায়ক করে তুলেছে। এই দিশাহীন সমাজে তার মতো খাঁটি সোনার মানুষের বড্ড অভাব।
মনু মিয়ার জীবনকাহিনি মানবিকতা, আত্মসম্মান ও সমাজসেবার এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি, যা আমাদের সবাইকে ভাবায়, অনুপ্রাণিত করে একটি সুন্দর সমাজ গড়ার। তিনি ছিলেন সাধারণে অসাধারণ। হয়তোবা বড় বড় লোকদের ভিড়ে ইতিহাসে তার নাম লেখা রবে না?
লেখক : ড. মো. আনোয়ার হোসেন (প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, কথাসাহিত্যিক, প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি অ্যালকোহল।)
মন্তব্য করুন