বাংলার তাঁতশিল্পের ঐতিহ্য হাজার বছরের। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আবহমান বাংলার ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক এই সুপ্রাচীন তাঁতশিল্প।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, সপ্তম শতকের বিখ্যাত চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাঙ ও ত্রয়োদশ শতকের মরক্কোর পরিব্রাজক ইবনে বতুতার ভ্রমণকাহিনিতে বাংলার টাঙ্গাইল-সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের সুনিপুণ বস্ত্র ও তাঁতশিল্পের উল্লেখ রয়েছে। প্রচলিত আছে, আদি বসাক সম্প্রদায়ের তন্তুবায়ী গোত্রের লোকেরা এ দেশের আদি তাঁতী।
দেশের বেশিরভাগ এলাকাজুড়ে বসবাস করা এই সম্প্রদায়ের লোকেরা একসময় বসাক সমিতি গড়ে তুলেছিলেন, যার মাধ্যমে কাপড়ের মান নিয়ন্ত্রণসহ অনভিজ্ঞ তাঁতীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হতো। বসাক শ্রেণির লোকেদের সংস্পর্শে এসে এদেশে বসবাসরত অন্যান্য সম্প্রদায়ও এ শিল্পে দক্ষ হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার তাঁতের সুনাম ছড়িয়ে রয়েছে বিশ্বজুড়ে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পূর্বকালে কেবল দেশেই নয় বহির্বাণিজ্যেও বিশেষ স্থান দখল করেছিল তাঁতশিল্প। জানা যায়, একসময় এই তাঁতবস্ত্র রপ্তানি হতো ইরাক, ইরান, ইতালি, চীনসহ বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশের শিল্প জগতে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তাঁতের ইতিহাস। প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশ যে কারণে পৃথিবীতে বিখ্যাত তাঁতশিল্প তার মধ্যে অন্যতম। মূলত বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো এবং বৃহত্তম শিল্প হলো তাঁতশিল্প।
তবে তাঁতশিল্পে স্বনির্ভর সেই স্বর্ণযুগের অবসান ঘটেছে। সাম্প্রতিককালে এ দেশের তাঁতশিল্পে ধ্বস নেমেছে। একসময় যে তাঁতিদের সুনাম বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল সে তাঁতিদের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। টাঙ্গাইল তাঁত শাড়ির রাজধানী হিসেবে খ্যাত জেলার দেলদুয়ার উপজেলার অন্তর্গত পাথরাইল, চন্ডি, বেলতা, পুটিয়াজানি। ‘তাঁতের রাজধানী’ শব্দদ্বয়ের ভার যেন আর বইতে পারছে না এই অঞ্চল। শুধু এ অঞ্চলগুলো নয়, পুরো দেশের তাঁতশিল্পের আকাশে জ্বলজ্বল করা চাঁদের আলো মিটিমিটি করে জ্বলছে। তাঁতের কাপড় বর্তমানে একেবারেই বিক্রি হচ্ছে না বলে জানান তাঁত মালিকরা। বিক্রি না থাকায় উৎপাদনেও ক্ষতি হচ্ছে তাদের। এ রকম পরিস্থিতি চলতে থাকলে বিলুপ্ত হয়ে যাবে হাতে বোনা এ তাঁতশিল্প।
সরেজমিনে দেখা যায়, পহেলা বৈশাখ ও ঈদ উপলক্ষে পাথরাইলের তাঁতিদের কোনো কর্মব্যস্ততা নেই। অথচ এই দুটি উৎসবের আগমুহূর্তে এই এলাকায় তাঁতের খটখট শব্দে কান পাতা যেত না। তাঁতি পরিমল বসাক জানান, ‘এ অঞ্চলে কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার মানুষ সরাসরি তাঁতশিল্পের সাথে জড়িত ছিল। কিন্তু বর্তমানে দুই হাজার জনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আয়ের সুযোগ অত্যন্ত কম হওয়ায় এতে নিয়োজিত শ্রমিকরা বেছে নিচ্ছে অন্য পেশা। এতে দক্ষ জনবল সংকটে পড়েছে এ অঞ্চলের তাঁতশিল্প। ফলে তাঁতমালিকরা নিরুপায় হয়ে ক্রমাগত আগ্রহ হারাচ্ছে।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তাঁত শুমারি-২০১৮-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে দেশে হস্তচালিত তাঁতের সংখ্যা কমেছে ২ লাখ ১৫ হাজারেরও বেশি।
শতাংশের হিসাবে এই দেড় দশক সময়ে তাঁত কমেছে প্রায় ৪২ শতাংশ। একই সময়ে তাঁত শিল্পে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা কমেছে ৫ লাখ ৭১ হাজার ৮০০ জন। শতাংশের হিসাবে তা প্রায় ৬৪ শতাংশ।
আরও জানা যায়, তাঁত বন্ধ হওয়ার কারণ হিসেবে ৮৩ দশমিক ৫ শতাংশ তাঁতি বলেছেন মূলধনের অভাবের কথা। এ ছাড়া সুতার মূল্য বেড়ে যাওয়াকে ৫৫ দশমিক ১ শতাংশ, সুতার অভাবকে ৩৭ শতাংশ, বিপণনের সমস্যাকে ২৭ দশমিক ৭ শতাংশ, দক্ষ শ্রমিকের অভাবকে ২৯ দশমিক ২ শতাংশ, নকশার অভাবকে ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ, উন্নত প্রযুক্তির অভাবকে ২৩ দশমিক ২ শতাংশ এবং রং ও রাসায়নিকের দাম বেড়ে যাওয়াকে ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ তাঁতি তাঁত বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যা করোনা পরিস্থিতির পর আরও প্রকট হয়ে উঠেছে।
মূলত, উপরে যতধরণের সমস্যার কথা বলা হয়েছে করোনায় তার সব কঠিনভাবে জেঁকে বসেছে পাথরাইলের তাঁতশিল্পের ওপর। করোনা মহামারিতে শ্রমিক সংকট, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, বিপণন সমস্যা ও বিক্রি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছে তাঁতিরা। এ ছাড়াও বৈদ্যুতিক বা যান্ত্রিক তাঁতশিল্পের (পাওয়ার লুম) সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না হস্তচালিত তাঁতশিল্প (হ্যান্ডলুম)। পাওয়ার লুমে কম শ্রমিকে বেশি উৎপাদন, সময়ের অপচয় রোধ, নকশায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটায় হ্যান্ডলুম অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে।
পুরোনো ঐতিহ্য বজায় রাখতে গিয়ে তাঁতশিল্প বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। আর তাঁত বুনে তাঁতিরা যে টাকা উপার্জন করেন, তাতে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু তাঁতিরা পিতৃপুরুষের এ পেশা ছেড়ে দিতে রাজি নন, কারণ এ শুধু তাদের জীবিকা নয়, বরং ঐতিহ্য ও গৌরব।
এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে প্রধান পৃষ্ঠপোষক হতে হবে। হস্তচালিত তাঁতশিল্প উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও তাঁতীদের কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ হস্তচালিত তাঁত বোর্ড অধ্যাদেশ, ১৯৭৭ প্রণয়ন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে এই অধ্যাদেশ রহিত করে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত তাঁত বোর্ডের কার্যাবলি (ধারা ৬) বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। আইনে তাঁতি সমিতির মাধ্যমে প্রান্তিক তাঁতীদের সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করার কথা বলা থাকলেও মাঠপর্যায়ে দেখা যায় না কিছুই। করোনার সময়ে তাঁত মালিকদের সরকারি যে প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল তার খুব সামান্যই পৌঁছেছে তাঁতীদের কাছে। তাই তাদের দাবি, তাঁত বোর্ডের মাধ্যমে সরকারি যে কোনো সাহায্য সহযোগিতা সরাসরি তাঁতীদের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। অন্যথায়, ‘রাঘব বোয়াল’রা সব লুটে নিচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের।
বর্তমান সময়ে কাপড়ের নকশায় এক বিশাল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে পাওয়ার লুম। যান্ত্রিক তাঁতের মতো করে নকশা বানানো যায় না হস্তচালিত তাঁ তে৷ এ বিষয়ে তাঁতীদের দক্ষ করে তুলতে হবে। দেখা যায়, বিভিন্ন সংকটে পারিবারিক এ শিল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন অনেকে। ফলে বংশানুক্রমিকভাবে যে যোগ্যতা তাঁতী পরিবারগুলো অর্জন করে থাকে তার অভাব সৃষ্টি হচ্ছে৷ হাজার বছরের এ ঐতিহ্য সংরক্ষণে সরকারের বিশেষ নজর জরুরি।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ওপর কোভিড-১৯ এর প্রভাব ও সরকারের প্রণোদনার মূল্যায়ন শীর্ষক একটি গবেষণায় মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহকালে দেখা যায়, টাঙ্গাইলের পাথরাইলে তাঁতের একসময়ের স্বর্ণযুগ এখন আর নেই। তাঁতিরা ব্যবসা গুটিয়ে নিতে চেয়েও পারছেন না। বিক্রির চেয়ে উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় তারা বিপাকে পড়েছেন। এদিকে মূলধনের অভাবে ব্যবসা পরিবর্তন করতেও সাহস পাচ্ছেন না তাঁতীরা। তাঁতমালিক নিখিল বসাকের মোট ১২টি তাঁতের মধ্যে বর্তমানে খুঁড়িয়ে চলছে মাত্র একটি।
তিনি জানান, সারাদিন কাজ করলে একটি তাঁতে সপ্তাহে দুটি শাড়ি তৈরি করা সম্ভব৷ উৎপাদন খরচ, শ্রমিকের মজুরি মিলিয়ে বিক্রির পর লাভ হয় না একদমই। শতাব্দীর পর শতাব্দী তাঁতের সাথে যুক্ত থেকেও আমাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
আরও জানা যায়, একসময় পাথরাইলের তাঁতশ্রমিকদের দিনব্যাপী কর্মব্যস্ত থাকতে হতো। অথচ এখন এই অঞ্চলে নেই কোনো আমেজ। এমনকি বিশেষ বিশেষ উৎসবেও কর্মহীন থাকতে হয় তাঁদের। অনেকে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন। তাঁতশ্রমিক অরুণ সাহা বলেন, করোনায় প্রায় শতভাগ তাঁতশ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছিল। এরপর এদের মধ্যে পঞ্চাশ ভাগ বিভিন্ন কর্মে যুক্ত হয়েছেন। তাদের পুনরায় তাঁতে ফিরে আসার সুযোগ দেওয়া হলেও তারা আর ফিরে আসতে রাজি নয়। এ কারণে মালিকেরা তাঁতঘরে থাকা তাঁতগুলো স্বল্পমূল্যে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন৷
তাঁত শ্রমিকরা বলছেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এখনই সময় তাদের দিকে সুনজর দেওয়ার। কেননা বিলুপ্তির পথ থেকে তাদের মুক্তি দিতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া অন্য কোনো উপায় দেখছেন না তারা।
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড আইন-২০১৩ তে উল্লেখিত হস্তচালিত তাঁতশিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টদের ঋণ সুবিধা সৃষ্টি, এর উন্নয়ন, তাঁতীদের বস্ত্র রসায়ন, খুচরা যন্ত্রাংশ, সুতা ন্যায্যমূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণ, উৎপাদিত পণ্য ক্রয় ও গুদামজাতের উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ, তাঁতপণ্য জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে প্রচারমূলক কার্যক্রম গ্রহণ, দেশ ও দেশের বিরে বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ, তাঁতশিল্পের সাথে সম্পৃক্তদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি জানান তাঁতিরা।
তবে সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটি দৃশ্যমান তা হলো আধুনিকতার ছোঁয়ায় এগিয়ে যেতে পারছে না হস্তচালিত তাঁতশিল্প। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত হবে, এই শিল্পের সাথে জড়িত তাঁতিদের উন্নত ও আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। যেহেতু পাওয়ার লুমে দৈনিক পাঁচ থেকে ছয়টি শাড়ি তৈরি হয় এবং উন্নত ও আধুনিক নকশার ক্ষেত্রেও এগিয়ে যান্ত্রিক এ পদ্ধতি, সেহেতু হ্যান্ডলুমে জড়িতদের আর্থিক সুবিধা তথা সহজ শর্তে ঋণ, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে দিয়ে পাওয়ারলুমের দিকে নিয়ে যাওয়া যায় কি না এটিও ভাবতে হবে। কেননা, তা নাহলে এর সাথে সংশ্লিষ্ট লাখ লাখ মানুষ পথে বসবে। অন্যদিকে, হ্যান্ডলুম যেহেতু একটি ঐতিহ্যের অংশ তাই এটিকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
মো. তানজিল হোসেন সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। এবং গবেষণা পরিচালক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এস.এম.ই.) এর উপরে কোভিড-১৯ এর প্রভাব এবং সরকারের প্রণোদনার মূল্যায়ন শীর্ষক গবেষণা প্রকল্প।
আহসান হাবীব রিয়াদ, আতোয়ার রহমান, মোরসালিন রহমান শিকর, আমিনুল ইসলাম নিরব।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এস.এম.ই.) এর উপরে কোভিড-১৯ এর প্রভাব এবং সরকারের প্রণোদনার মূল্যায়ন শীর্ষক গবেষণা প্রকল্পের সহকারী গবেষক এবং শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।
মন্তব্য করুন