ড. আশরাফ সিদ্দিকীর চতুর্থ প্রয়াণ দিবস আজ মঙ্গলবার (১৯ মার্চ)। তিনি জন্মেছিলেন ১৯২৭ সালের এই দিনে টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতি উপজেলার নাগবাড়ি গ্রামে।
তিনি একধারে ছিলেন কবি, লোক বিজ্ঞানি, ছোট গল্প লেখক এবং শিশু সাহিত্যিক। শান্তি নিকেতন হতে বিএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলায় এমএ করেন। এমএ ও ফোকলোর বিষয়ে পিএইচডি করেন ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় আমেরিকা হতে।
১৯৫১ সালে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন রাজশাহী সরকারি কলেজে। সে বছরেই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে গবেষণার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। তিনি রাজশাহী কলেজ, ঢাকা কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজসহ বিভিন্ন সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেন।
পরে তিনি ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়ার এ প্রধান সহকারী সম্পাদক, তদানীন্তন কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক, ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়ার এর প্রধান সম্পাদক এবং বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮৩ সালে জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মজীবন থেকে অবসর নেন। তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) এবং প্রেস ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান সহ নজরুল একাডেমী এবং নজরুল ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন।
তার বিখ্যাত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে তালেব মাষ্টার ও অন্যান্য কবিতা (১৯৫০), বিষকন্যা (১৯৫৫), ভোম্বল দাস দ্য আংকেল অফ লায়ন (১৯৫৮), রাবেয়া আপা (১৩৬২), লোক সাহিত্য প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড (১৯৬৩), রবীন্দ্রনাথের শান্তি নিকেতন (১৯৭৪), ফোকলরিক বাংলাদেশ, প্যারিস সুন্দরী (১৯৭৫), তিরিশ বসন্তের ফুল (১৯৭৬), বাণিজ্যেতে যাবো আমি (১৯৭৭), বাংলাদেশের রূপকথা (১৯৯১), আরশী নগর, গুনীন (১৯৮৯) ইত্যাদি।
একুশে পদক (১৯৮৮), শিশু সাহিত্যে বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৪), ইউনেস্কো পুরস্কারসহ তিনি আরও বহু পদকে ভূষিত হয়েছেন। বাংলা একাডেমিতে একুশে বই মেলা আয়োজন এবং জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের সমাধিস্থল নির্ধারণে তিনি নিয়ামক ভূমিকায় ছিলেন। বাংলার লোকায়ত মৌখিক সংস্কৃতির অনেকটাই লিখিত রূপে আনার জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
বিবাহ সূত্রে তিনি আবদ্ধ ছিলেন সাঈদা সিদ্দিকীর সঙ্গে। ভাষা আন্দোলনে প্রথম নারীদের প্রতিবাদ ঘটেছিলো সাঈদার নেতৃত্বে যিনি আজীবন আজিমপুর গালর্স হাই স্কুলে শিক্ষকতায় ব্রতী ছিলেন।
আশরাফ সিদ্দিকীর প্রয়াণ দিবসে তার স্বরণে কবিতা লিখেছেন সন্তান সায়ীদ সিদ্দিকী। বাবাকে শ্রদ্ধা করে লেখা সায়ীদ সিদ্দিকীর দুইটি কবিতা এখানে তুলে ধরা হল।
আমি একজন কবি বলছি -- সায়ীদ সিদ্দিকী
তোমরা যারা আমার জানাজায় এলে আমার অভিবাদন গ্রহণ করো আমার জন্য তোমাদের প্রাণ ঢালা প্রার্থনা সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয় আমলে নেবেন
মৃত্যুকে নিয়ে বেশি ভেবোনা মৃত্যু হলো বাড়ির দরজা খুলে বিশাল পৃথিবীতে নুতুন কিছু ঠিকানার খোঁজে অজানার পথে হারিয়ে যাওয়া এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে অজস্র গন্তব্য সারা জীবন কি তুমি আর আমি এর খোঁজে হন্নে হয়ে ঘুরি নি? গন্তব্যে পৌঁছনোর পথ ভিন্ন ভিন্ন
আমাকে প্রকৃতি কবির মন দিয়ে তৈরী করেছিল তাই আমার ঠিকানা ছিল বিমূর্ততার মাঝে সেখানে আমি তালেব মাস্টার , রাবেয়া আপা গলির ধারের ওই ছেলেটা , আর মায়াবতী নার্স দেড় সান্নিধ্য পেয়েছি ওদের কথা তোমাদের বলেছি মনে করোনা ওরা কল্পনা প্রসুত চোখ খুলে দেখো , এমন শত শত জীবন তোমাদের মাঝে গল্প হয়ে আছে ওদের একজন দুজনকে খুঁজে বার করো ওদের গল্প বল , তুমি ও কবি বলে পরিচিত হবে
আমাকে যেথায় শেষবারের মতো শেষের ঠিকানায় রেখে এসেছো , সেখানে তোমাদের বার বার যাবার প্রয়োজন নেই যদি আমাকে মনে করতে চাও যে লেখা গুলো তোমাদের উপহার হিসেবে দিয়ে এলাম চোখ বুলিও পাতা গুলোয় আমার জন্য চোখের জল ফেলো না অশ্রু ফেলো গলির ধারের সেই ছেলেটার জন্য রাবেয়া অপার অস্ফুট চাপা ব্যথার জন্য তালেব মাস্টার এর কন্যার না খেয়ে জীবন অবসানের জন্য চেষ্টা করো তোমাদের আশপাশের তালেব মাস্টারদের ভাগ্য উন্নয়নে তাহলেই তোমাদের এই কবি নিজেকে সার্থক ভাববে
তাঁর সম্মুকে যখন দাঁড়াবো , বলবো হে ঈশ্বর , আমি সাম্যের কথা বলেছি আমি লালনের গান গেয়েছি আমি রবীন্দ্র নাথের কথা বিলিয়ে বেরিয়েছি ঘোষণা করেছি নজরুলের প্রতিবাদ
আমি চিরতরে চলে যাই নি যদি একজনকে ও অনুপ্রাণিত করতে পেরেছি আমি তার মাঝে বেঁচে রইবো তোমরা যারা আমাকে ভালোবেসেছো আমি তোমাদের মাঝে বেঁচে রইবো
তোমারা যদি আমাকে কবি বলে জানো জেনো , কবিরদের মৃত্যু অন্যরকম বাণীর মাঝে আমরা রই , ভালোবাসার পাত্র হয়ে
আমার সময় ফুরালো -- সায়ীদ সিদ্দিকী
আমার সময় ফুরালো নটে গাছটি মুরোলো
তোমরা হাসপাতালে আমার বিছানা ঘিরে দাঁড়িয়ে। এক এক করে আমি সবাইকে দেখছি। তোমরা যারা আমার নাভিশ্বাস ওঠা দেখে কষ্ট পাচ্ছো, খোদার কাছে অবিরাম প্রার্থনা করে যাচ্ছ, আমি তোমাদের বলছি, তিনি নিশ্চয় তা শুনছেন। তিনি দয়ালু , এ কথা নিশ্চয় সত্য। তোমাদের সবার জন্য রেখে যাচ্ছি আশীর্বাদ। মানুষের জীবনের শেষ মুহূর্তে যে যে ধাপ গুলো পেরতে হয় , তোমাদের কাছে তা দেখতে মৃত্যু যন্ত্রনা মনে হয়। দেহ আর আত্মার ৯৫ বছর ধরে সহ অবস্থান, খাঁচা ছেড়ে চিরতরে আলাদা হবার প্রক্রিয়া একটু কঠিন হওয়া টা স্বাভাবিক বটে।
আমার নাম আশরাফ সিদ্দিকী। তোমরা বাংলার মানুষেরা আমাকে কবি বলে যে সম্মান আজীবন দিয়েছো, আমি তোমাদের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমার জন্য আফসোস করো না. আমি লম্বা আয়ু পেয়েছি. কত অজানার জানালেন তিনি “কত ঘরে দিলেন ঠাই”...কত বন্ধু, কত শুভাকাঙ্ক্ষী আছে আমা ।
ওপারে রয়েছেন আমার স্নেহময়ী মা, আমার পুণ্যবান বাবা, আমার ছোট বোন চপল (সৃষ্টি কর্তা তাকে ভালোবেসে অল্প বয়সে কাছে নিয়ে গেলেন) আমার বড় ভাই, বোন, নানা জান, সুরতির মা, কত ভালোবাসার মানুষ গুলো।
আমি চলে গেলে তোমরা কাঁদবে জানি, কিন্তু নিশ্চয় জেনো আমি হারিয়ে যাবো না। তোমাদের মাঝে আমি রইবো, যত দিন আমাকে মনে রাখবে, ততদিন । আমার প্রিয়তমা স্ত্রী অলি, বহু বছর আগে গেলো চলে। আজ পর্দার ওপারে আবার নব বধূর সাজে রয়েছে অপেক্ষায়। তোমরা মায়া ছাড়লেই আমি যেতে পারি।
মন্তব্য করুন