নতুন চ্যাটবট নিয়ে সমস্যা হলো, তারা বেশির ভাগ সময়েই মূর্খ ও অতিসরল। তবে যে সূক্ষ্মতা, বক্রাঘাত ও দ্বন্দ্বসমূহ দিয়ে মানুষের সংস্কৃতি আর যোগাযোগ গঠন করা হয় সেটা বোঝার মতো যথেষ্ট ‘মূর্খ’ বা 'অতিসরল' নয়। খারাপ অবস্থা হয় তখনি, যখন আমরা এদের বিশ্বাস করে এই স্থূলতায় নিমজ্জিত হই।
কোনো ব্যবহারকারীর প্রাথমিক অভিপ্রায় বুঝে পূর্বনির্ধারিত নিয়ম এবং তথ্য মেনে স্বাভাবিক ভাষায় কথোপকথন করার সক্ষমতাসম্পন্ন ‘চ্যাটবট’-এ নতুন কিছুই নেই। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চ্যাটবটের ক্ষমতা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি করায় বিষয়টি উদ্বেগ ও আতঙ্কের সূত্রপাত ঘটাচ্ছে।
ইদানীং এমন অনেক কথা বলা হচ্ছে যে, চ্যাটবট চিরায়ত শিক্ষাপদ্ধতির ইতি টেনে নতুন ভবিষ্যতের সূচনা করবে। যখন মানুষ চ্যাটবটের সঙ্গে আক্রমণাত্মক, যৌন উদ্দেশ্যমূলক অথবা বর্ণবাদী কথা বলবে এবং তার বিপরীতে চ্যাটবটের খারাপ কথাগুলো শুনতে চাইবে, তখন চ্যাটবটের উত্তর কেমন হবে সেটা গভীর মনোযোগের সঙ্গে ভাবার সময় এসে গেছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে যে তীব্রতা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে সেই তীব্রতাতেই কি (এআই)কে উত্তর দেওয়ার জন্য প্রোগ্রাম করা হবে?
আমরা যদি এবিষয়ে কিছু নিয়মকানুন তৈরির কথা চিন্তা করি, তাহলে কতটুকু পর্যন্ত সেন্সরশিপ কাজ করবে সেটা আগে ঠিক করতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে এতে করে কি রাজনৈতিকভাবে ‘আপত্তিকর’ বিবেচিত কথাবার্তা থামানো যাবে? পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের ব্যাপারে এআই-এর মতামত কী? অথবা ইসরায়েলকে বর্ণবাদী রাষ্ট্র বলে দাবি করা হলে (যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার শব্দটিকে তার বইয়ের টাইটেলে নামকরণ পর্যন্ত করেছিলেন), সেটা কি বর্ণবাদী বলে ব্লক করা হবে?
সমস্যার এখানেই শেষ নয়। লেখক এবং শিল্পী জেমস ব্রিডেল আমাদের সাবধান করে বলেছেন, ‘এআই আমাদের বিদ্যমান সংস্কৃতি পাইকারি দরে আত্মসাৎ করে নির্মাণ করা হয়েছে’। তিনি আরও বলেন, ‘এআই প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানসম্পন্ন অথবা অর্থপূর্ণ’- এই ধারণা সরাসরি ভয়াবহ। এ ছাড়া আমাদের এআই ইমেজ জেনারেটরের বিষয়ে খুবই সাবধান হতে হবে। ব্রিডেল মনে করেন, ‘এআই মানব জাতির ভিজ্যুয়াল ইতিহাসের সমগ্রতার প্রতিলিপি তৈরির চেষ্টা করে। তারা (এআই) আমাদের অন্ধকারতম ভয়গুলোকে জাগিয়ে তুলতে পারে। মূলত এটা একটা ইশারা যে, এআই সিস্টেম মানুষের চৈতন্যকে হীনভাবে অনুসরণ করতে পটু এবং এটা অস্তিত্বের গভীরে ওত পেতে থাকা আতঙ্ককে জাগিয়ে তোলে, যেখানে আছে- অশ্লীলতা, মৃত্যু ও দুর্নীতি।’
কিন্তু এআই মানুষের চেতনাকে কতটুক বুঝতে সক্ষম? সাম্প্রতিক সময়ের একটি পানীয়ের বিজ্ঞাপনের কথাই ধরা যাক , যেখানে শর্ত হিসেবে বলা হয়েছে- ‘দুইটি বিয়ারের দামে একটি বিয়ার কিনুন এবং দ্বিতীয় বিয়ারটি একদম ফ্রি নিয়ে যান!’ যেকোনো মানুষের কাছে এটা নিছক একটি রসিকতা। সেই চিরায়ত ‘একটা কিনলে একটা ফ্রি’ স্পেশাল অফারটি নতুন করে গঠিত হয়ে নিজেকেই বাতিল করেছে এখানে। এটা বিক্রি বাড়ানোর জন্য নিন্দনীয় একটি অভিব্যক্তি যা এক হাস্যকর সততা হিসেবে প্রণোদিত হবে। প্রশ্ন হলো চ্যাটবট কি এগুলোর একটাও তুলে নেবে?
‘Fuck’ শব্দটিও একই ধরনের সমস্যার উদ্রেক করে। যদিও শব্দটি এমন একটি কাজের (সঙ্গম) অর্থবহন করে যে কাজটি মানুষের করতে ভালো লাগে। এ ছাড়া শব্দটি নেতিবাচক অর্থেও ব্যবহার করে যেতে পারে (যেমন ‘We’re fucked!’ ‘Go fuck yourself!’)। ভাষার বাস্তবতা খুবই এলোমেলো। এআই কি এ ধরনের পার্থক্য উপলব্ধি করতে সক্ষম?
জার্মান কবি হাইনরিক ভন ক্লাইস্ট ১৮০৫ সালে তার ‘বক্তব্যের বিনির্মাণে চিন্তার ক্রমিক স্তরবিন্যাস’ (মৃত্যুর পর প্রথম প্রকাশ ১৮৭৮ সালে) শীর্ষক প্রবন্ধে কেউ কথা বলার আগে উনি কী বলতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে বলে যে ধারণা আছে; সেটি উলটে দেন। ‘যদি কোনো চিন্তা এলোমেলোভাবে প্রকাশ করা হয়, তার মানে এই নয় যে চিন্তাটি বিভ্রান্ত অবস্থায় ধারণ করা হয়েছে। অপরদিকে, এটাই সত্যি যে আইডিয়াগুলো সবচেয়ে বিভ্রান্ত অবস্থায় প্রকাশ করা হয়েছে সেগুলো সবচেয়ে পরিষ্কারভাবে চিন্তা করা হয়েছে।’
ভাষা ও চিন্তার মধ্যকার সম্পর্ক বিশেষভাবে জটিল। ১৯৩০ এর দশকে স্ট্যালিন তার ভাষণের একটি অনুচ্ছেদে মন্তব্য করেছেন, ‘যৌথ মালিকানা ব্যবস্থার বিরোধিতার চিন্তা পর্যন্ত যারা করেছে তাদের সঙ্গে নির্দয়ভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। হ্যাঁ, আমি এটাই বলছি, আমাদের মানুষের চিন্তার বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করতে হবে’। যে কেউ সহজেই ধারণা করতে পারে যে অনুচ্ছেদটি আগে থেকে তৈরি করা ছিল না। কিন্তু তাৎক্ষণিকতা কাটিয়ে স্ট্যালিন বুঝতে পেরেছিলেন তিনি কী বলেছেন। কিন্তু তিনি ভাষণে বিঘ্ন ঘটাননি এবং এ হাইপারবোলটিকে তার বক্তব্য হিসেবে রেখেছেন।
পরবর্তীতে জ্যাক লাঁকা বিষয়টিকে- বিস্ময়ের ভেতর দিয়ে সত্যের ঘোষণা আসার মতো একটি ঘটনা হিসেবে ব্যাখা করেন। লুই আলথুসার অবাক হওয়া ও অবাক হওয়ার বিপরীত অনুভূতির ভেতর একধরনের পারস্পরিক বিস্ময়কর সম্পর্ক দেখেছেন। যখন কেউ হঠাৎ কোনো ‘আইডিয়া’ পায় তখন সে কী অর্জন করেছে- এটা ভেবে অবাক হয়। আবারও একই প্রশ্ন, এটা কি চ্যাটবট করতে পারে?
আরও পড়ুন: নোয়াম চমস্কি/ চ্যাটজিপিটির মিথ্যা প্রতিশ্রুতি
এটা সমস্যা না যে চ্যাটবট মূর্খ, বরং চ্যাটবট যথেষ্ট মূর্খ না- এটা একটা সমস্যা। সমস্যাটা এমন না যে তারা সরল (বক্রাঘাত এবং আত্মপ্রতিফলন নেই); সমস্যা এটা যে তারা যথেষ্ট সরল নয় (সারল্য থাকে না যখন স্বচ্ছতাকে ঢেকে রাখা হয়)। মানুষ চ্যাটবটকে ‘সত্যিকারের মানুষ’ ভাববে এটা প্রকৃত সমস্যা নয়। সত্যিকারের সমস্যা হলো- মানুষ চ্যাটবটের সঙ্গে কথা বলতে বলতে নিজেরাই চ্যাটবটের মতো হয়ে যাবে। তখন তাদের ভেতর সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পার্থক্য করা বক্রাঘাত থাকবে না, তারা শুধু সেটাই ঠিকঠাকভাবে বলবেন যেটা তারা বলতে চান।
স্লাভয় জিজেক। ছবি : লেখকের টুইটার থেকে
আমি যখন ছোট ছিলাম তখন ভয়াবহ একটি ঘটনার রেশ ধরে আমার এক বন্ধুকে মানসিক রোগের চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। রোগীদের কাছ থেকে মানসিক রোগের চিকিৎসকরা কেমন সাহায্য আশা করে থাকেন- এ নিয়ে ওই বন্ধুর ভাবনা ক্লিশে ছিল। এ কারণে আমার বন্ধু প্রথম সেশনের পর ওই চিকিৎসককে ‘মিথ্যা সহযোগিতা’ দিয়েছে। সে বানিয়ে বলেছে- কীভাবে সে তার পিতাকে ঘৃণা করে এবং তার মৃত্যু চায়। ওই চিকিৎসকও উদ্ভাবনী মেজাজে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তিনি ‘প্রাক-ফ্রয়েডিয়ান’ এক অবস্থান নেন এবং আমার বন্ধুকে পুনরায় তার বাবাকে সম্মান করতে অনুরোধ করেন। (তিনি বলেন, ‘তুমি আজ যা, এর পেছনে যে মানুষটির অবদান সবচেয়ে বেশি, কীভাবে যে তুমি সেই ব্যক্তিকে নিয়ে এমন কথা বলো?’)- এই ধরনের ছলনাপূর্ণ সারল্য চিকিৎসকের পক্ষ থেকে আসলে একটি বার্তাই পরিষ্কারভাবে দেয়- আমি তোমার ‘মিথ্যা সহযোগিতা’ চাই না। একটি চ্যাটবট কি এই অবস্থাটা বুঝবে?
তার না বোঝার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা এটা রোয়ান উইলিয়ামসের দস্তয়েভস্কির ‘দ্য ইডিওট’ উপন্যাসের প্রিন্স মিশকিন চরিত্রটির ব্যাখার মতো। স্বাভাবিক পাঠ অনুযায়ী মিশকিন বা ‘দ্য ইডিওট’ যারপরনাই একজন ঋষিতুল্য ভালো-চমৎকার মানুষ যে রূঢ় হিংস্রতা এবং বাস্তব জীবনের কড়াঘাতে ভিন্ন ধরনের পাগলামিতে নিমজ্জিত হয়। তবে উইলিয়ামের মৌলিক পুনর্পাঠে মিশকিনকে আরও বিতর্কিত চরিত্র মনে হয়। তার ভেতর ভালোত্ব আর দেবত্ব থাকতে পারে কিন্তু তার দ্বারাই ব্যাপক ধ্বংসের ও মৃত্যুর শুরু হয় এবং তার আশপাশের জটিল সব সম্পর্কের কাছে সে মুখাপেক্ষী হয়ে ওঠে।
বিষয়টা এমন না যে মিশকিন একজন দুর্বল চরিত্র। মিশকিনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এমন - নির্দিষ্ট কিছু নির্বুদ্ধিতা অন্যের ওপর তার ধ্বংসাত্মক প্রভাব সমন্ধে তাকে কিছুই জানতে দেয় না। সে একেবারেই সরল একজন মানুষ যে চ্যাটবটের মতো কথা বলে। তার ‘ভালোত্ব’ চ্যাটবটের মতোই। সে তার কাছে আসা চ্যালেঞ্জকে কোনো প্রকার বক্রোক্তি ছাড়া গ্রহণ করে। যেখানে তার আত্মপ্রতিফলন দেখানোর কথা, সে সেখানে বিচ্ছিন্ন নমনীয়তা দেখায়। সে সবকিছুকে সত্যিকার অর্থে নেয় এবং প্রকৃত চিন্তা গঠন না করে এক ধরনের স্বয়ংক্রিয়-পূর্ণতা আরোপ করে। এ কারণে, নতুন চ্যাটবটগুলো -যারা 'Woke', জাতীয়তাবাদী 'Maga' (ট্রাম্প সমর্থক) এবং যারা ঘুমিয়েই কাটাতে চায় এমন সব ধরনের মতাদর্শের মানুষের সঙ্গেই সহাবস্থানে থাকতে পারে।
মূললেখা : স্লাভয় জিজেক, ইউরোপিয়ান গ্র্যাজুয়েট স্কুলের দর্শনের অধ্যাপক। আন্তর্জাতিক বিষয়ক পরিচালক, বার্বেক ইনস্টিটিউট ফর দ্য হিউম্যানিটিজ, ইউনিভার্সিটি অবই লন্ডন। তার নতুন গ্রন্থ- হ্যাভেন ইন ডিজর্ডার (২০২১)।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে ভাষান্তর : সরকার জারিফ
মন্তব্য করুন