দেশের পুঁজিবাজার থেকে ক্রমেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) জুলাই মাসের তথ্য বলছে, গত দুই বছরে বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার) অ্যাকাউন্ট কমেছে সাড়ে ৬ লাখেরও বেশি। পুঁজিবাজারে লেনদেন করতে হলে একজন বিনিয়োগকারীর বিও অ্যাকাউন্ট থাকা অপরিহার্য। কারণ, এর মাধ্যমেই শেয়ার কেনাবেচা করেন বিনিয়োগকারীরা। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীর সংখ্যাও জানা যায় বিও অ্যাকাউন্টের মাধ্যমেই।
বিও অ্যাকাউন্ট কমার কারণ সম্পর্কে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে একটি বিষয়ে সবাই একমত, পুঁজিবাজারের প্রতি আস্থাহীনতার কারণেই বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। এই আস্থার সংকটের মূল কারণ বাজারে গ্রাহক-কেন্দ্রিক সেবার সক্ষমতা তৈরি না হওয়া। বিও অ্যাকাউন্ট খোলা থেকে শুরু করে লেনদেনের সব পর্যায়ে বিনিয়োগকারীর সহায়তা প্রয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে গ্রাহক-কেন্দ্রিক সেবা ও সহযোগিতা বিনিয়োগকারী বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
মন চাওয়া মাত্রই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। যদিও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো অর্থের পরিমাণ নির্দিষ্ট করা নেই; বিনিয়োগকারী তার আগ্রহ এবং সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে পুঁজিবাজারে লেনদেন করতে পারেন। তারপরও বিনিয়োগে আগ্রহী প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে পুরোপুরি খোঁজখবর নেওয়া বিনিয়োগকারীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠানটির বিগত বছরের লেনদেনের ইতিহাস, পূর্ণাঙ্গ আর্থিক বিবরণী, শেয়ার প্রতি লভ্যাংশ প্রদানের পরিমাণ ইত্যাদি খুঁটিনাটি বিষয়ের ওপর বিনিয়োগকারীর বিস্তারিত ধারণা থাকা দরকার।
একজন ব্যক্তির পক্ষে নিয়মিত এসব খোঁজখবর নেওয়া ও বিশ্লেষণ করা সহজসাধ্য নাও হতে পারে। সেজন্যই বিনিয়োগকারীকে সহায়তা করার জন্য ব্রোকারেজ হাউস গড়ে উঠেছে। বিনিয়োগকারীদের আর্থিক দক্ষতা বৃদ্ধি ও পুঁজিবাজার সম্পর্কিত সর্বশেষ খোঁজখবর প্রদান করার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীর কাজকে সহজ ও নিরবচ্ছিন্ন করছে ব্রোকারেজ হাউসগুলো।
প্রতিবেশী ভারতে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনেক সুবিধাজনক ও গ্রাহক-কেন্দ্রিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। সেখানে বিনিয়োগকারীরা যে কোনো জায়গা থেকে শেয়ার লেনদেন করতে পারেন। অ্যাপ বা ওয়েবসাইট থেকে খুব সহজেই জানতে পারেন পুঁজিবাজার ও লেনদেনবিষয়ক সর্বশেষ পরিস্থিতি। বাজার পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক বিশ্লেষণ করে থাকে ব্রোকারেজ হাউস ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞরা। বিনিয়োগকারীদের সুবিধার জন্য সাত দিন ২৪ ঘণ্টা সেবা দিয়ে থাকে ব্রোকারেজ হাউসের কাস্টমার কেয়ার সেন্টারগুলো।
আমাদের দেশের পুঁজিবাজারের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। এখনও অনেকে শেয়ার লেনদেন করতে ভিড় করেন ব্রোকারেজ হাউসে। হাউসগুলোও অনেক সময় গ্রাহক-কেন্দ্রিক সেবা নিশ্চিত করতে পারে না। কিছু কিছু ব্রোকারেজ হাউস বিনিয়োগকারীর প্রয়োজনের ওপর গুরুত্ব না দিয়ে কত বেশি টাকা লেনদেন করা হচ্ছে তার ওপর জোর দিয়ে থাকে। কেউ কেউ বিনিয়োগকারীর অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দেয় না। ব্রোকারেজ হাউসগুলো গ্রাহক-কেন্দ্রিক সেবা নিশ্চিত করতে না পারলে বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, এটাই স্বাভাবিক। যাহোক, এই প্রবণতা পুঁজিবাজার তো বটেই অর্থনীতির জন্যও ক্ষতিকর।
এই সমস্যার সমাধানে নানামুখী উদ্যোগ প্রয়োজন। বিশেষ করে পুঁজিবাজার ও ব্রোকারেজ হাউসগুলোর আধুনিকায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করা জরুরি। উৎসাহের বিষয়, আমাদের দেশেও পুঁজিবাজারের আধুনিকায়নে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে।
ব্রোকারেজ হাউসগুলোর নিজস্ব অর্ডার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ওএমএস) তেমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। এতে বিনিয়োগকারীরা দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে যে কোনো সময় লেনদেন করার সুযোগ পাবেন। ফলে একদিকে যেমন বিনিয়োগকারীদের সময় ও শ্রম বাঁচবে, অন্যদিকে পুঁজিবাজার সম্পর্কে আরও বেশি খোঁজখবর নেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। নিজস্ব ওএমএস ব্যবহারের মাধ্যমে ব্রোকারেজ হাউসগুলো বিনিয়োগসংক্রান্ত সমস্ত প্রক্রিয়া ও সেবা আরও সহজ ও নিরবচ্ছিন্ন করতে পারবে। সর্বোপরি, ব্রোকারেজ হাউসগুলো বিনিয়োগকারীর সামগ্রিক অভিজ্ঞতাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সুযোগ পাবে। স্মার্ট ব্রোকারেজ হাউস হিসেবে গড়ে ওঠার পূর্বশর্তই হচ্ছে নিজস্ব ওএমএস। আর বিনিয়োগকারীবান্ধব আধুনিক এই ব্যবস্থার ইতিবাচক প্রভাব অবশ্যই পড়বে দেশের পুঁজিবাজারে।
এনবিএল সিকিউরিটিজের মতো আধুনিক ব্রোকারেজ হাউসগুলোতে নিজস্ব ওএমএসের পাশাপাশি ব্যাক-অফিস সুবিধা রয়েছে, যাতে করে লেনদেন পরে সব প্রক্রিয়া সহজ ও নির্ভুলভাবে সম্পাদন করা যায়। স্বয়ংক্রিয় এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্রোকারেজ হাউসগুলো বিনিয়োগকারীদের জন্য পার্সোনালাইজড ও উন্নত গ্রাহকসেবা নিশ্চিত করতে পারে। একই সাথে, বিনিয়োগকারীর প্রয়োজন আরও কার্যকরভাবে পূরণ করা সম্ভব হয়।
আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্রোকারেজ হাউসগুলো বিনিয়োগকারীদের আগের চেয়ে নির্ভুলভাবে পরামর্শ দিতে পারবে; ব্রোকারেজ হাউসের কর্মীরা বিনিয়োগকারীর প্রয়োজন মেটাতে আরও বেশি সময় দেওয়ার সুযোগ পাবে, যা গ্রাহকের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করবে। বিনিয়োগকারীর লেনদেনের অভিজ্ঞতা আরও সমৃদ্ধ করতে ব্রোকারেজ হাউসগুলোতে ফিনটেক প্রযুক্তি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই।
দেশের পুঁজিবাজারের লেনদেন গতিশীল করতে এবং পুঁজিবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে সবার আগে গ্রাহক-সন্তুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। আমি মনে করি এনবিএল সিকিউরিটিজের মতো আধুনিক ব্রোকারেজ হাউসগুলো সে কাজটি ভালোভাবে করতে পারে। গ্রাহক-কেন্দ্রিক সুযোগ-সুবিধার বিকাশ ও প্রয়োগের মধ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারের দিকে আগ্রহী করতে ব্রোকারেজ হাউসগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।
জোবায়েদ আল মামুন হাসান : ম্যানেজিং ডিরেক্টর, এনবিএল সিকিউরিটিজ লিমিটেড
মন্তব্য করুন