শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫, ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
অরবিন্দ সুব্রামানিয়ান
প্রকাশ : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০২:০৬ পিএম
আপডেট : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:১৫ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
অরবিন্দ সুব্রামানিয়ান ও জশ ফেলম্যান

ভারতের কেন ব্রিকস থেকে বের হয়ে আসা উচিত?

নরেন্দ্র মোদি। ছবি: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
নরেন্দ্র মোদি। ছবি: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

দিল্লিতে খুব দ্রুতই জি২০ সম্মেলনে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নেতারা বৈঠকে বসবেন। ভারতের সভাপতিত্বের সমাপ্তি ঘোষণার মধ্য দিয়ে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকট কাটিয়ে ওঠায় কিছুটা সাফল্যের মুখ দেখলেও পরবর্তী সময়ে জি২০ থেকে খুব বেশি কিছু পাওয়া যায়নি। তবে ভারতের জন্য এ সম্মেলন দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথমত, জি২০ সম্মেলনে সভাপতিত্বের দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এটিকে বড় একটি স্থানীয় ইস্যু বানিয়ে পুরো ভারতকে এর প্রস্তুতিতে জড়িত করেছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে জি২০ বিষয়ক পোস্টার দেখা যাচ্ছে, যেখানে মোদির ছবি রয়েছে। এসব পোস্টারে বলা হয়েছে, কীভাবে মোদি ভারতকে বিশ্ব দরবারে ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে তুলে ধরবেন। ভারতীয়দের এটা যত বেশি বিশ্বাস করানো যাবে যে তাদের দেশ ‘বিশ্বগুরু’ (যিনি পৃথিবীকে শিক্ষাদান করেন) সরকারি দলের জন্য পরবর্তী প্রাদেশিক নির্বাচন এবং জাতীয় নির্বাচনে জেতার সুযোগও ততটাই বৃদ্ধি পাবে।

দ্বিতীয়ত, ব্রিকসের (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, সাউথ আফ্রিকা) কলেবর বৃদ্ধি করে সৌদি আরব, ইরান, ইথিওপিয়া, মিশর, আর্জেন্টিনা ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকেও দলে ভেড়ানোর পর ভারত এখন বড় একটি কৌশলগত সুযোগের মুখোমুখি। এর আগ পর্যন্ত, ব্রিকসের নকশা ছিল খাপছাড়া এবং প্রায়োগিক দিক থেকে অকার্যকর ও নিরীহ প্রকৃতির।

কিন্তু ব্রিকস+ রাজনৈতিকভাবে আরও কেন্দ্রীভূত, নেতৃত্বে আরও চীনকেন্দ্রিক এবং আচরণে আরও বেশি পশ্চিমাবিরোধী। ব্রিকসের বর্তমান গঠন এর চরিত্র নির্ধারণ করছে। ভারতের জন্য প্রশ্ন হলো- এখনো দেশটির এমন গ্রুপে থাকার কোনো অর্থবাচকতা রয়েছে কিনা।

এর উত্তর তিনটি কারণে ‘সম্ভবত না’। প্রথমত, অর্থনীতির কথা বিবেচনা করে। মূল ব্রিকসের আকর্ষণ (দক্ষিণ আফ্রিকা ২০১০ সালে যুক্ত হয়), এর সদস্য দেশগুলোর অর্থনৈতিক গতিধারার মধ্যে নিহিত। ২০০৪ সালে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন ব্যাপক উন্নতি লাভ করছিল। কিন্তু আজ ব্রিকস বিবর্ণ নক্ষত্রের সমষ্টিতে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এটা নিশ্চিত যে, ব্রিকসের অনেকের কাছেই এখনো প্রচুর সম্পদ রয়েছে। বিশেষ করে, চীন, রাশিয়া, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের এখনও দরিদ্র দেশগুলির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে এবং সাহায্য করার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ রয়েছে। কিন্তু শুধু সম্পদ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রভাবের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। জাপানের দিকে তাকান। উন্নয়নশীল এবং উদীয়মান অর্থনীতির দেশ তার সম্ভাব্য সঙ্গীর সুবর্ণ অতীতে আলাদা করে আগ্রহী হয় না বরং তারা ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির দেশগুলোর সঙ্গে যুক্ত হতে চায়।

২০২৩ সালের ব্রিকস যে দুই দশক আগেকার তুলনায় অনেক কম গতিশীল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সেদিন আজ অতীত, যখন চীন অনায়াসে শতকরা ১০ ভাগ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারত। যে অর্থনৈতিক মডেল এমন ফলাফলের পেছনে ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে তা এখন ভেঙে গেছে। যেমন, বেশির ভাগ বিশ্লেষক এখন ৩ শতাংশ নিরপেক্ষ প্রবৃদ্ধি আশা করছেন। এদিকে রাশিয়া বছরের পর বছর ধরে চরম পর্যায়ের পতনের মধ্যে রয়েছে এবং বর্তমানে তার আগ্রাসী যুদ্ধ দেশটিকে আরও দুর্বল করবে। যদিও ব্রাজিল পণ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্যে ভর করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ভোগ করছে, এটা দেখার বিষয় যে এ ভাগ্য তারা কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারে।

অন্যদের কথা বলতে গেলে- আর্জেন্টিনা আবারো আর্থিক পতনের দ্বারপ্রান্তে, দক্ষিণ আফ্রিকা এখনো উচ্চ বেকারত্ব, প্রগাঢ় শাসন ও আর্থিক চ্যালেঞ্জে জর্জরিত। সামষ্টিক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি জন্য মিশরের আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে সাহায্য প্রয়োজন। এমনকি সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ধার করা সময়ে জীবন চালাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর কেন্দ্রীভূত সমন্বিত একটি চাপ হাইড্রোকার্বন সম্পদের দামকে অবমূল্যায়িত করার মাধ্যমে তাদেরকে আটকে রাখতে পারে।

সংক্ষেপে ব্রিকস একগুচ্ছ অর্থনৈতিক ‘অতীতে ছিল’ নিয়ে গঠিত। এখানে বড় ব্যতিক্রম হলো ভারত। দেশটি দ্রুত বেড়ে উঠছে এবং দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনার সঙ্গে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নতি করেছে। যেহেতু অন্যান্য ব্রিকস সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে এর খুব বেশি মিল নেই সেহেতু এটিকে ছেড়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করতে পারে ভারত। প্রতীকী এবং বাস্তবিক উভয় কারণেই ভারত এটা করতে পারে।

এটা আমাদের দ্বিতীয় বড় ইস্যুতে নিয়ে আসে, তা হলো: রাজনীতি। নতুন ব্রিকস+ আরও রাজনৈতিক হয়ে ওঠার সব আলামতই দেখাচ্ছে এবং তা এমন উপায়ে যা ভারতের জন্য গুরুতর সমস্যা তৈরি করবে। ব্রিকসের ক্রমবর্ধমান চীনকেন্দ্রিকতা এবং পাশ্চাত্যবিরোধী মনোভাব ভারতের অসংযুক্তি নীতির বিপরীতে অবস্থান করে। প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির কাছ থেকে সমদূরত্ব বজায় রাখা ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির মূল সুর। এমনকি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধেও ভারত এ বিষয়টি মেনে চলেছে।

মোদির ব্যাপক কল্যাণে ভারত এখন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের কাছে ভিড়তে পেরেছে এবং রাশিয়ার সঙ্গেও দেশটি সমানতালে সম্পর্ক চালিয়ে নিচ্ছে। এ ছাড়া ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে। মিশর, সৌদি আরব এবং বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গেও কৃত্রিম ভালো সম্পর্ক রয়েছে দেশটির। এখন প্রশ্ন হলো- ভারত কি এ সাফল্যকে শুধু বর্ধিত ব্রিকস+ এর সদস্য হওয়ার জন্য জলাঞ্জলি দেবে?

তাছাড়া, আর্জেন্টিনা ও ইথিওপিয়া ছাড়া নতুন সব সদস্য রাষ্ট্রই কর্তৃত্ববাদী। এ বিষয়টি পুরো গ্রুপকে আরও বেশি রাজনৈতিক করে তুলছে। ভারত কি সত্যিই এমন কর্তৃত্ববাদী গ্রুপের ভেতর ঢুকতে চায়? মোদির অধীনে নিজস্ব রাজনৈতিক পশ্চাদপসরণ সত্ত্বেও, এখনো আন্তর্জাতিক মহলে ভারত গণতন্ত্রকে তাসের দান হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।

ব্রিকস ছাড়ার তৃতীয় কারণ হবে বৈশ্বিক শাসন সংক্রান্ত। মার্কিন ও এর জি-৭ নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক ক্রম এ উদ্দেশ্যের জন্য অনুপযুক্ত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সর্বোপরি বহুপাক্ষিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিষয়টি যথেষ্ঠ আওয়াজ তুলতে পারে না। একতরফা সুরক্ষাবাদী পদক্ষেপের মাধ্যমে বহুপাক্ষিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করা হয়েছে। এতে নিজেদের প্রতি নির্ভরশীলতার নামে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তাকে সুসংহত করা হয়েছে।

কিন্তু ভারত যদি একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা বেছে নিতে চায় তবুও তার দৃষ্টিভঙ্গি চীন, রাশিয়া বা সৌদি আরবের সঙ্গে মিলবে না। অন্যান্য ব্রিকস সদস্যরা প্রভাবশালী মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলারকে বাদ দিতে চায় এবং দরিদ্র দেশগুলোকে সংকটের মুখোমুখি হলে বিকল্প উন্নয়নে ও জরুরি সাহায্য করার ইচ্ছা পোষণ করে। কিন্তু এসব ইচ্ছা অনুযায়ী- রেনমিনবি আধিপত্য, বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ ধরনের ঋণ ব্যবস্থা এবং দরিদ্র দেশগুলো সংকটে পড়লে সরকারি ঋণদাতাদের মধ্যে ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে অনীহার ওপর ভিত্তি করে একটি উন্নত বিশ্ব গঠিত হবে।

উল্লিখিত সমাধানগুলো চলমান অবস্থার চেয়ে ভালো নয়। ভারতের দিক থেকে চিন্তা করলে এগুলো বেশ খারাপ। ভারত কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়ে চীনা আধিপত্য থেকে লাভবান হবে? ব্রিকস+ কে ভারত তার শক্তি ধার দেওয়ার অর্থ হলো চীনের ভূরাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন দেওয়ায় ব্যাঘাত ঘটানো।

যেহেতু ভারত ইতোমধ্যে চীনকেন্দ্রিক আঞ্চলিক অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের সদস্যপদ ত্যাগ করেছে, একটি আপাত-রাজনৈতিক গ্রুপে চীনের সঙ্গে একই কাতারে দাঁড়ানোটা অদ্ভুত ব্যাপার হবে। এই অনুভূতিকে পারস্পররিক বলেই মনে হচ্ছে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিংপিং জি২০ সম্মেলনে যোগদান এড়িয়ে যেতে চান বলেই জানা গেছে।

এটি ভারতের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ করে তুলবে। জি-সেভেন পুরনো এবং ব্রিকস+ কোনো বিকল্প নয়। যতটা ক্লান্তিকর আর আনুষ্ঠানিকতায় পরিপূর্ণ হোক না কেন, জি২০ এর বহুপাক্ষিকতা এখনো বিশ্বের বিশৃঙ্খলার ভেতরে আশার আলো নিয়ে আসতে পারে।

নিজের উদীয়মান শক্তির পক্ষে অবস্থান নিয়ে হলেও ভারতের উচিত ব্রিকস থেকে বের হয়ে আসা। গঠনমূলক বিকল্পের প্রতি দেশটির অঙ্গীকারের সংকেত হিসেবে জি২০ কে সফল করে তোলার চেষ্টা করা উচিত।

অরবিন্দ সুব্রামানিয়ান : সিনিয়র ফেলো, পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনলাল ইকোনমিকস। জশ ফেলম্যান : জেএইচ কনসাল্টিং এর প্রিন্সিপাল। ভাষান্তর: সরকার জারিফ

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘টাঙ্গুয়ার হাওরে টুরিস্ট পুলিশের তথ্যসেবা কেন্দ্র করা হবে’

বিয়ের ৫ বছর পর একসঙ্গে ৪ সন্তানের জন্ম

চবিসাসের ক্রীড়া ও সংস্কৃতি সম্পাদক কালবেলার জাহিদুল

প্রশিক্ষণার্থী নারীকে অপদস্থের পর ক্ষমা চাইলেন সেই কৃষি কর্মকর্তা

জাবি শিক্ষার্থীদের তথ্য ফাঁস; নেপথ্যে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক

‘ফটোগ্রাফার রাফিদের স্মরণে ফটোগ্রাফি কনটেস্ট আয়োজন করা হবে’

তেলের ডিপোর ট্যাংকে আটকে শ্রমিকের মৃত্যু

অনির্বাচিত সরকার সব কিছুর সমাধান করতে পারে না : যুবদল সভাপতি

ব্যবসায়ীদের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে সচেষ্ট সরকার : আইসিটি সচিব

রাজউকের সার্ভারে ঢুকে ভবনের অনুমোদন করিয়ে নিয়েছিল হ্যাকার নিজেই

১০

সরাসরি গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পেলেন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউট ও তদন্তকারী কর্মকর্তারা

১১

জুলাই ঐক্যের বিক্ষোভে উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

১২

অধ্যাপক ইউনূস ‘পদত্যাগের বিষয়ে ভাবছেন’ : নাহিদ ইসলাম

১৩

এবার আসিফ ও মাহফুজের পদত্যাগ দাবি গণঅধিকার পরিষদের

১৪

শীতের শুরুতে স্থানীয় নির্বাচন চায় ইসলামী আন্দোলন

১৫

ডাকসুর রোডম্যাপ দাবিতে ৩২ ঘণ্টা ধরে অনশনে বিন ইয়ামিন

১৬

বই চুরির মামলায় অ্যাকাডেমিক সুপারভাইজার গ্রেপ্তার

১৭

বন্যা না আসতেই ধসে গেল নদী রক্ষা বাঁধ

১৮

বর্তমান পরিস্থিতিতে মির্জা গালিবের ৫ পরামর্শ

১৯

পাকিস্তানকে বিশাল বাঁধ নির্মাণ করে দিচ্ছে চীন

২০
X