যদিও ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু চূড়ান্তভাবে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, তবু একথা বিশ্বাসে কারুরই দ্বিধা নেই, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণই একরকম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা। বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণের শেষে তিনি বলেছেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা। তিনি তার ঊনিশ মিনিটের এক্সটেম্পোর ভাষণে শুরুতে থেকে শেষ পর্যন্ত দেশের মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতাযুদ্ধের রূপরেখা সংক্ষেপে তুলে ধরেছেন।
এ নিবন্ধকার ১৯৭১ সালে ক্লাস ওয়ানের ছাত্র ছিলেন সিরাজগঞ্জের কাজিপুর থানার অন্তর্গত তারাকান্দি সরকারি প্রাইমারি স্কুলে। কিন্তু মার্চের উত্তাল তরঙ্গের সময় মানুষের মনে লেখাপড়া, বিদ্যাশিক্ষার চেয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীনের চিন্তা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। কীভাবে কত দ্রুত পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের হাত থেকে দেশকে স্বাধীন করা যায়, সেই চিন্তা চেতনা ছিল জাতির মগজে ও মননে। আমার পিতা তাই আমাকে স্কুলে পাঠাননি, পঁচিশে মার্চের পর থেকে। গৃহে বসেই ক্লাস ওয়ানের বই শেষ করি, পিতামাতার আঁচলস্থলে থেকে। মহান স্বাধীনতার পর সরাসরি আমি দ্বিতীয় শ্রেণিতে লেখাপড়া শুরু করি।
আমাদের গ্রামের নাম বিলদুয়ারিয়া। তারাকান্দি গ্রামের দক্ষিণের গ্রামের নাম ছিল বয়রাবাড়ি, উত্তরের গ্রামটির নাম ছিল ডিক্রি দোয়েল এবং ডিক্রি দোয়েলের উত্তরের গ্রামটিই ছিল বিলদুয়ারিয়া। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যেমন দেশের প্রতিটি গ্রামের উল্লেখ নেই, তেমনি আমাদের গ্রামেরও হয়তো তেমন উল্লেখ কোথাও মিলবে না। তবে, সিরাজগঞ্জ জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার মধ্যে আমার ছোট চাচা নূরুল ইসলাম এবং আমার পিতামহ শেখ রেফাজউদ্দিন বেপারির নাম রয়েছে, রয়েছে এ গ্রামের আরো অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার নাম। মূলত আমাদের গ্রামটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্জয় ঘাঁটি। গ্রামের সর্বপূর্বে মতি কাকাদের বাড়ি। এই বাড়ির সাথে লাগোয়া একটি বিশাল বাগানভিটা। ভিটায় বিশাল আকৃতির বেশ কয়েকটি আম গাছ, কাঁঠাল গাছ, তিন প্রকার বাঁশের ( তল্লা, মাকলা ও বড়বাশা জাতের) ঝাড় ছিল। আর ছিল একটি বড় কদম গাছ। এই কদম গাছের ফুল দিয়ে আমরা খেলনা সেমাই রেঁধে ওয়া ওয়া করে মিছেমিছি খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছি কত।
এপ্রিল মে মাসে তখন খুব ঝড় তুফান হতো। তখনো আমাদের গ্রামগুলোতে যুদ্ধ শুরু হয়নি। আমরা ছেলেমেয়েরা দিনের বেলায় এসময় ঝড় হলেই এই ভিটেতলা গিয়ে একত্রিত হতাম। সমস্বরে ছড়া কাটতাম, আম পড় পড়, কড়াইলা মাটির ঝড়। কাইলা জিরা বাইটা দিলাম তুফান আইসা পড়। তারপর অপেক্ষা করতাম কখন একটা সজোরে বাইকুরানি বাও আসে, আর গাছ থেকে কাঁচা আম পড়ে। সব ছেলেমেয়ে হুড়মুড় করে আম কুড়াতাম। আমাদের প্রত্যেকের হাফপ্যান্টের কোচরে থাকতো লবণ মেশানো শুকনো মরিচের গুঁড়ো। আর হাতে থাকতো চাকু। আম ছিলে কুচিকুচি করে কেটে এই গুঁড়ো মাখিয়ে খেতাম।
যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে দৃশ্যপট বদলে গেল। বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে ধীরে ধীরে গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে গেল সে যুদ্ধ। আমাদের গ্রামের ভিটাতলায় তখন আর আম কুড়ানোর ধূম নেই। গ্রামের মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করে এসে এই ভিটায় বসে জিরিয়ে নিতেন। মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব চাচা, আজমল চাচা গ্রামের নামকরা মুক্তিযোদ্ধা। আমার নিজের চাচা নুরুল ইসলাম আমাদের এলাকায় যুদ্ধ করেননি, তিনি ভারতের মানকার চরে ট্রেনিং নিয়ে সীমান্ত এলাকায় যুদ্ধরত ছিলেন। আমার পিতামহ রেফাজ বেপারি আমাদের চরের বাড়িতে তার শোবার ঘরে বিশাল বাংকার খনন করেন। মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিদিন যুদ্ধ শেষ করে তার কাছে এই বাংকারে অস্ত্র জমা রাখতেন। আমার দাদা এর উপর চাটাই তোশক-চাদর বিছিয়ে বিছানা করে শুয়ে থেকে অস্ত্র পাহারা দিতেন। এই ছিল মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসব্যাপী আমার দাদার কাজ। অন্যদিকে আমাদের বিলদুয়ারিয়া গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের মতি কাকার মায়ের ঘরে বন্দুক, রাইফেল, এসএল আর, মেশিনগান, এলএমজি ইত্যাদি অস্ত্র টিনের বেড়ার সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতেন। মতি কাকার মাকে আমরা বলতাম বদ্দাদি (বড় দাদি ) বলে, কেননা, তিনি আমার নিজের দাদির বড় জাঁ ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা চাচারা মুক্তিযুদ্ধে কীভাবে পাক মিলিটারিরা সারেন্ডার করল, কীভাবে কালভার্ট উড়িয়ে দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি মিলিটারি জিপ ধ্বংস করে দেওয়া হলো ইত্যাদি সাফল্য বর্ণনা করতেন আর আমরা এসব শুনে উদ্বেলিত হয়ে যেতাম। কোনো সময় বা মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব চাচা বলতেন, ক্যারেবা ভাইস্তা, যাও তোমার মাকে বলো আমাদের জন্য গুড়মুড়ি দিতে। এক দৌড়ে গিয়ে মাকে বললেই, মা বেতের খাদি বা বাঁশের ঝাঁকায় গুড়-মুড়ি দিয়ে দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। এসব এখন অহংকারের স্মৃতি।
বঙ্গবন্ধুকে আমি দেখিনি। তবে তার বজ্রকণ্ঠ সেসময়কার বালক-বালিকাদের ন্যায় আমিও শুনেছি। আমার মনে আছে, তারাকান্দি হাটে খাতা কলম বিক্রেতাদের কাছে যে সব খাতা পাওয়া যেত, তাতে বঙ্গবন্ধুর অঙুলি উঁচানো প্রতিকৃতি ছাপানো থাকতো। স্বাধীনতার আগেও বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার দাবি সংবলিত বঙ্গবন্ধুর ছবির পাশে লেখা থাকতো, ৬ দফা। সেই বয়সের অনেক স্মৃতির মতো এই স্মৃতিও জাগরুক।
স্বাধীনতার পর আমরা স্কুলে গেয়েছি আমাদের প্রিয় জাতীয় সংগীত আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। আমাদের একজন স্যার ছিল, জালাল স্যার। ওনার আরেকটি নাম ছিল ওমুল্লা স্যার। আমরা যখন স্কুলের মাঠে সমবেত হয়ে জাতীয় সংগীত গাইতাম, তখন তিনি প্রায়ই একটা সুর ধরিয়ে দিতেন অনেক আবেগঘন করে। কী শোভা কী ছায়া গো, কী স্নেহ কী মায়া গো... তিনি এত সুন্দর দরদ দিয়ে টান দিতেন, যে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের মনেও দেশের জন্য দরদ ভালোবাসা উথলে উঠতো। আমাদের স্কুলের একটি শপথবাক্য ছিল, যা আমরা অ্যাসেম্বলিতে মুষ্ঠিবদ্ধ সম্মুখপ্রসারিত হস্তে উচ্চারণ করতাম। পুরোটা মনে না থাকলেও এই শপথবাক্যে দেশপ্রেম, মানবপ্রেম এবং লেখাপড়া করে সচ্চরিত্রবান নাগরিক হওয়ার একটা শপথ ছিল।
সচ্চরিত্রবান দেশপ্রেমিক নাগরিক হওয়ার শপথের কথার সাথে আমি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানের কথা মিলিয়ে দেখি। বঙ্গবন্ধুর অনেক ভাষণই এখন ইউটিউবের কল্যাণে পাওয়া যাচ্ছে, যা আগে আমরা পেতাম না। তিনি তার মাত্র সাড়ে তিন বছরের সময় পেয়েছিলেন দেশ পরিচালনার জন্য। এরই মধ্যে তিনি এমন কোনো সেক্টর নেই, যে সেদিকে তিনি হাত দেননি। কৃষি, পরিকল্পনা, পররাষ্ট্রনীতি, নৌচলাচল, স্থল-জল ও সমুদ্র বন্দর, শিল্প-বাণিজ্য, যোগাযোগ, স্বাস্থ্যসেবা, অবকাঠামো, ধর্ম, শিক্ষাব্যবস্থা, নারী ও শিশু, পরিবেশ, গাছ লাগানো ইত্যাদি সব দিকে মনোযোগ দিয়েছেন, মৌলিক কাজ করে গেছেন। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় দুষ্টচক্রের হাতে অকালে শাহাদাত বরণ করতে না হলে বাংলাদেশ বহু আগেই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতো বলে জ্ঞানীজনরা মনে করেন। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, আপনারা বাংলার কৃষক, শ্রমিক মজুররা সরকারি কর্মচারীদের ভাই, বাবা, মা-বোন হিসেবে দেখবেন। তিনি বলেছেন, অফিসার সাব, অমুক সাব, তমুক সাব হলে চলবে না। তিনি বলেছেন, কাদের টাকায় আপনারা অফিসার সাব? ওই কৃষক শ্রমিকের টাকায় আপনারা বেতন পান, এই কথা তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু আরো বলেছেন, আমার কৃষকরা শ্রমিকরা ঘুস খায় না, ঘুস খায়, দুর্নীতি করে অফিসার কর্মচারীরা। তিনি সরকারি কর্মচারীদের মানবিক, সৎ ও দেশপ্রেমিক সরকারি কর্মচারী হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের নামে রাজপথে স্লোগান দেওয়া, মুখে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলা আর বাস্তবে মুজিবাদর্শের অনুসরণ করার মধ্যে যোজন যোজন ফারাক আছে। আপনি কোন্ মুখে বঙ্গবন্ধুর কথা বলবেন, যখন আপনি খাদ্যে ভেজাল দেবেন, কোন্ মুখে মুজিবাদর্শের নামে স্লোগান দেবেন যখন আপনি চাঁদাবাজি তোলাবাজি করবেন, অপরকে ঠকাবেন, অন্যের জমি জবর দখল করবেন? যে সরকারি কর্মচারি ঘুস খাবে দুর্নীতি করবে, তার কি ন্যূনতম অধিকার আছে, বঙ্গবন্ধুর নামোচ্চারণ করার? যে রাজনীতিবিদ, যে পেশাজীবী, যে ব্যবসায়ী, যে সাংবাদিক ব্যক্তিজীবনে দুর্নীতিগ্রস্ত, যে মুখ দিয়ে খারাপ কথা উচ্চারণ করতে পারে, যে অন্যের অধিকারকে নষ্ট করে তার অধিকার নেই বঙ্গবন্ধুর নামোচ্চারণ করার। এবারের জাতীয় শোকদিবসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এসব বিষয় ওঠে এসেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় পত্রিকায় এসব সুন্দর সুন্দর কথা আসেনি।
অন্নদা শঙ্কর রায় সত্যি বলেছেন, যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরি যমুনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে হলে তাই আমাদের প্রতিনিয়ত শপথে উজ্জীবিত হতে হবে, কীভাবে ন্যায়পরায়ণতার সাথে দেশের জন্য কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধু এদেশকে স্বাধীন করেছিলেন, একটি সত্যিকার সোনার বাংলায় রূপান্তরের জন্য, যেখানে দেশের প্রতিটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, কেউ শোষণ জুলুমের শিকার হবে না। সামাজিক বৈষম্য হ্রাস পাবে। দেশের মানুষ কর্ম করে সুন্দরভাবে চলতে পারবে, শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে রাত্রিযাপন করতে পারবে। সংবাদপত্রের বাক স্বাধীনতা থাকবে, কিন্তু কোনো সাংবাদিক অসদুদ্দেশ্যে সংবাদ পরিবেশন করবে না, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা দেশের উন্নয়নে, দেশের মানুষের সেবায় নিরপেক্ষতার সাথে কাজ করে যাবে। তবেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন হবে, অন্যথায় নয়।
শরীফ শেখ: লেখক, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
মন্তব্য করুন