সম্প্রতি ৪৫তম ইউরোপিয়ান লেখক সম্মাননা পান বুকারজয়ী ভারতীয় লেখক অরুন্ধতী রায়। ১২ সেপ্টেম্বরে তার দেওয়া ভাষণটি প্রকাশিত হয়েছে ‘স্ক্রল ডট ইন’ নামের ভারতীয় একটি গণমাধ্যমে। কালবেলার পাঠকদের জন্য ভাষণটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন সরকার জারিফ। প্রথম পর্ব প্রকাশ হলো আজ-
ভাষণের শুরুতে অরুন্ধতী রায় বলেন, চার্লস ভিলিয়ন ফাউন্ডেশনকে ধন্যবাদ জানাই আমাকে ২০২৩ সালের ইউরোপিয়ান লেখক সম্মাননা প্রদানের জন্য। এখনই আমি কতটা আনন্দিত তা ঠিক বুঝতে পারছি না। এমনকি আমি উল্লসিত এটাও হতে পারে। আমাকে সবচেয়ে বেশি খুশি করছে যে বিষয়টি, তা হলো- পুরস্কারটি সাহিত্যের জন্য, শান্তি বা সংস্কৃতির জন্য নয়। এমন সব লেখার জন্য যা আমি গত ২৫ বছর ধরে লিখছি বা লিখে এসেছি।
প্রথমে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ এবং পরে পূর্ণ ফ্যাসিবাদের মাধ্যমে তারা ধাপে ধাপে ভারতের অবনমন (যদিও তারা এটিকে ঊর্ধ্বগমন দাবি করে) ঘটিয়েছে। হ্যাঁ, আমরা এখনো নির্বাচন করে চলেছি। নির্বাচনের সময়টা খুন, গণপিটুনি এবং নির্দিষ্ট ভোটারদের ওপর মিথ্যা অপবাদ চাপিয়ে নির্যাতন চালানোর মৌসুম।
শুধু নেতাদের ভয় পাব ব্যাপারটা আর এমন পর্যায়ে নেই বরং জনসংখ্যার একটা পুরো অংশকে ভয় পেতে হবে। অশুভ শক্তির অস্বাভাবিকতা ও এর স্বাভাবিকীকরণ এখন আমাদের সড়কে, শ্রেণিকক্ষে এবং জনসমাগম ঘটে এমন সব জায়গায় প্রকাশ পাচ্ছে। মূলধারার গণমাধ্যম এবং ২৪ ঘণ্টার সংবাদ চ্যানেলগুলো সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রচারে ব্যবহার করা হচ্ছে। ভারতের সংবিধানকে কার্যকরভাবে সরিয়ে রাখা হয়েছে। নতুন করে ইন্ডিয়ান পেনাল কোড লেখা হচ্ছে। যদি বর্তমান সরকার ২০২৪ সালে জিতে যায় তাহলে আমাদের নতুন সংবিধান দেখার সম্ভাবনা রয়েছে।
এটাকে ‘সীমা নির্দেশনা’ বলা হয়ে থাকে যেখানে নির্বাচনী এলাকার সীমানাকে নতুন করে সাজানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রে এ প্রক্রিয়াটিকে জেরিম্যান্ডারিং (সুবিধার জন্য নিয়ন্ত্রণ করা) বলা হয়ে থাকে। এ অনুযায়ী উত্তর ভারতের হিন্দিভাষী রাজ্যগুলোতে আরও বেশি আসন দেওয়া হবে, যেখানে বিজেপির সমর্থন রয়েছে। এতে দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে অসন্তোষ দেখা যাবে এবং ভারতজুড়ে বিভক্তির আশঙ্কাও রয়েছে। শুধু দুর্বল এবং অবহেলিত সুপ্রিম কোর্ট ছাড়া বর্তমানে কার্যত এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই।
আরেকবার আমাকে সম্মানীয় এ পুরস্কার দেওয়া এবং কাজের মর্যাদা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ দিতে দিন। যদিও এটা অবশ্যই উল্লেখ করা উচিত- এমন আজীবন সম্মাননা মানুষকে বয়স্ক ভাবাতে সাহায্য করে। আমারও এমন ভান করা বাদ দিতে হবে যে আমি বয়স্ক নই। মজার বিষয় হলো- আমরা যেসব বিষয়ে ২৫ বছর ধরে লেখালেখি করে আসছি এবং সাবধান করে আসছি তা এখনো মনোযোগ পায়নি। বরং নিজেদের যারা উদারপন্থি এবং ‘প্রগতিশীল’ বলে মনে করেন তারাও প্রায়ই আমাকে উপহাস ও সমালোচনা করে থাকেন।
তবে এখন সাবধান করার সময় শেষ। আমরা ইতিহাসের ভিন্ন একপর্যায়ে অবস্থান করছি। একজন লেখক হিসেবে আমি এটাই শুধু আশা করতে পারি, আমার লেখনী প্রত্যেকটি অন্ধকার অধ্যায়ের সাক্ষ্য বহন করবে এবং আমার দেশের জীবনের কাহিনি তুলে ধরবে। আশা করি, আমার কাজের মতো অন্যদের কাজও যেন টিকে থাক। এটা জানা থাকবে, যা ঘটছিল তার সঙ্গে সবাই একমত ছিল না।
আমার প্রথম গ্রন্থ ‘দ্য গড অব স্মল’ থিংস ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয়। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৫০তম বছর। স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার আট বছর পেরিয়েছে এবং আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধের ধ্বংস্তূপে সোভিয়েত কমিউনিজমের কবর দেওয়া হয়েছে। এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যে একক অক্ষবর্তী বিশ্বের শুরু যেখানে পুঁজিবাদ অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিজয়ী। ভারতও তখন নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্ত করে এবং করপোরেট পুঁজির কাছে তার বাজার মেলে ধরে।
বেসরকারি এবং কাঠামোগত সমন্বয় সাধন মুক্তবাজারের মূল সংগীতে পরিণত হয়। ভারত উঁচু টেবিলে তার জায়গা করে নিচ্ছিল। কিন্তু এরপর ১৯৯৮ সালে বিজেপির নেতৃত্বে সরকার ক্ষমতায় আসে। প্রথম যে কাজটি তারা করেন তা হলো, একের পর এক পারমাণবিক পরীক্ষা চালানো। সাধারণ মানুষ এ বিষয়টিকে সাধুবাদ জানিয়েছিল যাদের ভেতর, লেখক, শিল্পী ও সাংবাদিকরাও ছিলেন। তারা মারাত্মক ও অরাজক জাতীয়তাবাদী ভাষায় এ কাজটি করেছে। যেটা গণমানুষের কথা বলে বিবেচ্য ছিল তা হঠাৎ পালটে গেল।
তখন, আমার উপন্যাসের জন্য বুকার পুরস্কার পাওয়ার পর অসাবধানতাবশত নতুন ভারতের সাংস্কৃতিক দূতে পরিণত হলাম। প্রধান সব ম্যাগাজিনের কভারে আমার ছবি আসল। তখন আমি বুঝলাম যে আমি যদি এখন কিছু না বলি, তাহলে এটা ধরে নেওয়া হবে যে আমি সবকিছুর সাথে একমত। আমি তখন বুঝতে পারলাম চুপ থাকা কথা বলার মতোই রাজনৈতিক ব্যাপার। আমি বুঝতে পারলাম প্রতিবাদ করলে আমার রূপকথার রাজকুমারীর মতো সাহিত্য জগত থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তার চেয়েও বড় কথা, আমি বুঝতে পারলাম, আমি যদি যা নিজে বিশ্বাস করি তা না লিখতে পারি তাহলে আমিই আমার সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হবো এবং সম্ভবত আর কোনোদিন লিখব না।
তাই আমি আমার লেখকসত্ত্বাকে বাঁচানোর জন্য লেখা শুরু করলাম। দ্য অ্যান্ড অব ইমাজিনেশন বহুল প্রচারিত দুটি পত্রিকা আউটলুক ও ফ্রন্টলাইনে সমান্তরালে ছাপা শুরু হলো। আমি তখনই বিশ্বাসঘাতক ও দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত হলাম। এ অপমানগুলোকে আমি খ্যাতি হিসেবে গ্রহণ করতে শুরু করলাম যেগুলো কোনো অর্থেই বুকার পুরস্কারের চেয়ে কম সম্মানজনক ছিল না। এটা আমাকে লেখালেখির এক দীর্ঘযাত্রার সম্মুখীন করল যেখানে আমি বাঁধা, উৎপাটন, বর্ণপ্রথা, খনন, গৃহযুদ্ধ নিয়ে লেখালেখি করেছি। এ যাত্রা আমার বোঝাপড়াকে আরও গভীর করেছে এবং আমার ফিকশন ও ননফিকশনকে এমনভাবে জুড়ে দিয়েছে যে তা এখন আর আলাদা করা যায় না।
আমার আজাদি নামের বই থেকে একটি অংশ এখন উদ্ধৃতি দিচ্ছি যেখানে লেখাগুলো কীভাবে জগতে বেঁচে থাকে তা নিয়ে বলা হয়েছে। লেখাটির শিরোনাম ‘সাহিত্যের ভাষা।’
যখন প্রথমবারের মতো প্রবন্ধগুলো ছাপা হচ্ছিল (প্রথমে বহুল প্রচারিত ম্যাগাজিন, এরপর ইন্টারনেট এবং চূড়ান্তভাবে বই আকারে) তা সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছিল। অন্তত কিছু জায়গায় এমনকিছু মানুষ এগুলোর বিরোধিতা শুরু করল, যারা প্রচলিত রাজনীতির সঙ্গে দ্বিমত করেনি। লেখাগুলো এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গিতে পৌঁছালো যা সাহিত্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বাজে রকমের অমঙ্গলসূচক আচরণকে বোধগম্য প্রতিক্রিয়া ধরে নেওয়া গেলেও যাদের শ্রেণি বিন্যাসে ঝোঁক রয়েছে তারা ঠিক করতে পারছিলেন না আমার লেখাগুলোকে তারা কোনো কাতারে ফেলবেন। এটি কী পুস্তিকা বা বিতর্কমূলক প্রাতিষ্ঠানিক, সাংবাদিকতা বা ভ্রমণবিষয়ক কোনো লেখা নাকি সাহিত্যিক দুঃসাহসিকতা তা নিয়ে তারা দ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন।
কারও কাছে এটাকে লেখা হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে না। তারা বলত, আরে তুমি লেখা বন্ধ করে দিলে কেন? আমরা তোমার পরবর্তী বইয়ের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষ করছি। অন্যরা ভাবত আমি হয়তো ভাড়া করা একটি কেলমমাত্র। আমার কাছে বিভিন্ন ধরনের লেখার আহ্বান আসত। কেউ এসে বলতো, ‘তোমার বাঁধ নিয়ে লেখাটা খুব ভালো লেগেছে। তুমি কি আমাকে শিশুদের ওপর নির্যাতন নিয়ে একটি লেখা দিতে পারবে (এটা আসলেই ঘটেছিল)? আমাকে এ বিষয়ে কঠোরভাবে লেকচার দেওয়া হয়েছে (বেশিরভাগই উচ্চ বর্ণের মানুষ)। তারা আমাকে কীভাবে লিখতে হবে এবং কী বিষয়ে লিখতে হবে এবং কেমন স্বরে লিখতে হবে তা বলে দিতে চাইতেন।
কিন্তু অন্যান্য জায়গায়, যেগুলোকে আমি হাইওয়ে বলে থাকি- আমার প্রবন্ধগুলো খুব দ্রুত বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ করা হতো এবং পুস্তিকা হিসেবে প্রকাশ করা হতো। এ ছাড়া এগুলো বন ও নদীর অববাহিকায় বিনামূল্যে বিতরণ করা হতো। যেসব গ্রামে হামলা চালানো হয়েছে এবং যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিথ্যা শুনতে শুনতে ক্লান্ত তাদের কাছে এই লেখাগুলো পৌঁছে দেওয়া হচ্ছিল।
আমি এগুলো এখানে উল্লেখ করছি কারণ এটা আমাকে এ শিক্ষা দিয়েছে যে সাহিত্যের জায়গাটা লেখক এবং পাঠকদের দ্বারা গঠিত হয়। বিভিন্নভাবে এটা বেশ দুর্বল জায়গা কিন্তু এটি অবিনশ্বর। যখন এটা ভেঙে যায় আমরা এটাকে পুনঃর্নির্মাণ করি কারণ আমাদের আশ্রয় দরকার। আমার সাহিত্যের এ ধারণাটা ভালো লাগে। যে সাহিত্য আশ্রয় দেয়, সব রকমের আশ্রয়। (চলবে)
অরুন্ধতী রায় : বুকারজয়ী ঔপন্যাসিক, রাজনীতি বিষয়ক লেখক।
মন্তব্য করুন