বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ভারত বিভাগের ফলে উপমহাদেশের জনগণ এক নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। দীর্ঘদিনের উপনিবেশমুক্ত হয়ে স্বাধীনতার নামে নতুন জাতীয়তাবাদের আড়ালে জড়িয়ে পড়ে দুই বাংলার জনগণ। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র গঠিত হলেও বাংলা এবং পাঞ্জাবের বিভক্তি ছিল এক বেদনাদায়ক অধ্যায়। শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে উভয় বাংলার লাখ লাখ মানুষের দেশত্যাগ (পশ্চিম বাংলা থেকে পূর্ব বাংলা, আবার পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম বাংলায়)- প্রিয় জন্মভূমি, চিরপরিচিত পরিবেশ যেমন পূর্বপুরুষের বাস্তভিটা ত্যাগ এমনকি কর্মস্থল ত্যাগ করে রাতারাতি এক অজানা ভবিষ্যতের পানে ছুটে যাওয়া তা বিশ্বের অন্য কোনো দেশে সংঘটিত হয়েছে কিনা সন্দেহ।
বিশেষ করে নতুন সীমারেখা অংকিত হওয়ার ফলে অনেককেই পাকিস্তান হতে ভারতে এবং ভারত থেকে পাকিস্তানে চলে আসতে হয়েছে। প্রচলিত আছে ভারতবর্ষের ম্যাপের ওপর পেনসিল দিয়ে দাগ টেনে ভাগ করার ফলে কারো বাড়ির রান্নাঘর চলে গেল পশ্চিম বাংলায়, বসা এবং শোয়ারঘর পড়ল পূর্ব বাংলায়। ১৯৪৭ সালে র্যাডক্লিফ কমিশনের বদৌলতে দুই বাংলার মধ্যকার যে সীমারেখা অংকিত হয় তাতে লাখ লাখ মানুষকে উদ্বাস্তু হতে হয়। বাংলা পিডিয়ার মতে, ‘ভারতের আদমশুমারি অনুযায়ী পূর্ব বাংলা থেকে ২.৫৫ মিলিয়ন হিন্দু ভারতে অভিবাসিত হয়। পরিবর্তে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার থেকে পূর্ব বাংলায় আসে ০.৭০ মিলিয়ন মুসলমান।’ এক গবেষণায় দেখা যায় ভারত বিভক্তির এক বছরের কম সময়ের মধ্যেই লাখ লাখ শরণার্থী (প্রায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ) ভারত বা পাকিস্তানে গমন করে। এটা ছিল ইতিহাসের জনসংখ্যার বৃহত্তম স্থানান্তর।
ইতিহাসের অমোঘ নিয়তিকে স্বীকার করে স্বাধীনতার আবেগ, উচ্ছ্বাস এবং উচ্চাশায় জনগণ এর জোড়ালো বিরোধিতা করেনি। কিন্তু পরবর্তীকালে এর দুঃখ-বেদনা মূর্ত হয়ে উঠেছে জীবনের প্রতিটি ক্ষণে, প্রতিটি অধ্যায়ে। জন্মভূমি ছেড়ে আসার আঘাতের রক্তক্ষরণ, বেদনার আখ্যান নিয়ে উপমহাদেশের প্রায় সব ভাষাতেই লেখা হয়েছে। সাহিত্যের সব শাখাতেই। বাংলা সাহিত্যের বড় বড় নামকরা লেখক যেমন মানিক বন্দোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শওকত ওসমান, হাসান আজিজুল হক প্রমুখ লেখকদের বাংলায় লেখা দেশভাগের কালজয়ী সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিফলিত হয়েছে পরবর্তী সময়ের স্মৃতিকথা, আর সাহিত্যে।
শুধু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে দেশত্যাগের ফলে সাধারণ জনগণের মধ্যে হতাশা ও হাহাকার নেমে আসে। কিন্তু সবগুলো তো জানা যায়নি। তবে অনেকেই পরবর্তীকালে তাদের স্মৃতিকথা লিখেছেন, যেখানে এই হতাশার চিত্র ফুটে উঠেছে। হামিদা খানম, শওকত ওসমান, আনিসুজ্জামান, হায়দার আকবর খান রনোসহ খ্যাতিমান অনেকেই জীবন স্মৃতি লিখেছেন। যেমন- হামিদা খানম লিখেছেন, “মাঝে মাঝে আমার মনে হতো এ কেমন জীবন হলো, জগৎটা হঠাৎ করে কেন এত ছোট হয়ে গেল। গন্ডি নিছক কয়টা জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কোথায় গেল সেই কাশ্মির থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া উন্মুক্ত আকাশ, ছেলেবেলা থেকে পরিচিত পরমাত্মীয়ের মতো মানুষ। হঠাৎ করে পরদেশি হয়ে গেল, হারিয়ে গেল তাদের ঠিকানা।”
পূর্ব বাংলায় যারা উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিলেন তাদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. কুদরাত-এ-খোদা, ড. আনিসুজ্জামান, হাসান আজিজুল হক, বর্ধমান, হায়াৎ মামুদ, বদরুদ্দীন উমর, শওকত ওসমান, শওকত আলী, ভাষাশহীদ বরকত, ভাষাশহীদ শফিউর আব্বাসউদ্দীন, কলিম শরাফি, কামরুল হাসান, মীজানুর রহমান, মাহমুদুল হক, কায়েস আহমেদ, এস ওয়াজেদ আলী, চলচ্চিত্র শিল্পী আব্দুর রাজ্জাক, হুমায়ুন চৌধুরী, লেখক আমানুল্লাহ খান প্রমুখ গুণীজনের কথা বলা যেতে পারে।
ভারতের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ ১৯৩৭ সালের পর থেকেই প্রদেশগুলোর ক্ষমতায় আসে। বাংলাও তখন ছিল ভারতের অন্যতম একটি প্রদেশ। এই সময় মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে ভারতে মুসলমানদের জন্য পৃথক স্বতন্ত্র আবাসভূমির দাবি করা হয়। কিন্তু কংগ্রেস সেটা মানতে রাজি হয়নি। যদিও ১৯৪৬ সালে কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই পরিকল্পনায় ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রথায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কংগ্রেস তা মেনে নিতে চায়নি। এভাবে একের পর এক পরিকল্পনা হয়েছে এবং সেটা ব্যর্থও হয়েছে। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ একে অপরকে অবিশ্বাস করা শুরু করে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যায় যে ১৯৪৬ সালে ভয়াবহ দাঙ্গায় পড়তে হয় কলকাতা, নোয়াখালীসহ উপমহাদেশকে। এরই সর্বশেষ এবং অনিবার্য পরিণতি ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তি।
১৯৪৭ সালের এপ্রিল-মে দেশ বিভাগের প্রশ্নটি পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এ সময়ে বাংলার অনেক রাজনৈতিক নেতা বাংলা প্রদেশের বিভক্তি রোধ করার চেষ্টা করেছিলেন। নেতৃত্বে ছিলেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। বাংলার কতিপয় হিন্দু ও মুসলিম নেতা সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসুর প্রয়াসের সমর্থন জানিয়েছিলেন। এদের মধ্যে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ হলেন: কিরণশঙ্কর রায় (বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার কংগ্রেস সংসদীয় দলনেতা), সত্যরঞ্জন বখশী (শরৎ বসুর সচিব), আবুল হাশিম (বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক), ফজলুর রহমান (বাংলা প্রদেশের রাজস্ব মন্ত্রী), মুহম্মদ আলী (সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী) ও আরও অনেকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ প্রয়াস সফল হয়নি। জিন্নাহ এবং নেহেরু দুজনেই চেয়েছেন ক্ষমতা। এবং সেটাই শেষ পর্যন্ত হয়েছে। ক্ষমতার মোহে নেতারা এতটাই ব্যতিব্যস্ত ছিল বাংলা ভাগ করার দায়িত্ব ছিল স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের উপর। তার ভারতবর্ষ সম্পর্কে কোনো প্রত্যক্ষ জ্ঞানই ছিল না। তিনি গোঁজামিল দিয়ে বাংলা এবং পাঞ্জাব ভাগ করলেন।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের ঘটনায় বহুমাত্রিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। পরিবারের অতি ছোট শিশু থেকে শুরু করে সবাই এক নিদারুণ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। শুধু পরিবার পরিজন ছাড়া প্রতিবেশী এবং গ্রামবাসীও হঠাৎ করে বিপর্যস্ত হয়েছেন। প্রতিবেশী দুটি সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ছিন্ন হয়েছে।
রাঢ় বাংলায় জন্ম নেওয়া কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন নিজের লেখা চরিত্র চিত্রণের মধ্যে। তার লেখায় তিনি অনুসন্ধান করে চলেছেন জীবনের সত্যতা, তার উপন্যাসের মোদ্দাকথা দেশভাগ, বা নিজের ফেলে আসা রাঢ় অঞ্চলের যাপিত জীবন। উদ্বাস্তু জীবন দেশভাগ এই অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে লিখলেন সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, জীবন ঘষে আগুন, নামহীন গোত্রহীন, পাতালে হাসপাতালে, দেশভাগের গল্প, রাঢ়বঙ্গের গল্প, আগুন পাখি, সাবিত্রি উপাখ্যান প্রভৃতি। সৃষ্টি হলো কালজয়ী অমর কথাসাহিত্য।
ষাটের দশকে আবির্ভূত এই কথাসাহিত্যিক তার সুঠাম গদ্য এবং মর্মস্পর্শী বর্ণনাভঙ্গির জন্য প্রসিদ্ধ। জীবনসংগ্রামে লিপ্ত মানুষের কথকতা তার গল্প-উপন্যাসের প্রধানতম অনুষঙ্গ। রাঢ়বঙ্গ তার অনেক গল্পের পটভূমি। যেমন 'আত্মজা একটি করবী গাছ' গল্পে বলতে চেয়েছেন দেশভাগের ছিন্নভিন্ন জীবন মানুষকে জীর্ণশীর্ণ করে তোলে আর কান্নাজড়িত চোখে ভাসে নিজের ফেলে আসা জীবনের কথা... ইনাম, ফেকু আর সুহাস নাপিতের জীবনেরই এক নির্দয় অভিজ্ঞতাকে লেখক তুলে ধরেছেন এই গল্পে। তার বিখ্যাত আগুনপাখি উপন্যাসের সংলাপে তাইতো তিনি তুলে ধরলেন-
“একই দ্যাশ, একইরকম মানুষ, একইরকম কথা, শুধু ধম্মো আলেদা, সেই লেগে একটি দ্যাশ একটানা যেতে যেতে একটো জায়গা থেকে আলেদা আর একটো দ্যাশ হয়ে গেল, ই কি কুনোদিন হয়? এক লাগোয়া মাটি, ইদিকে একটি আমগাছ, একটি তালগাছ! তারা দুটো আলেদা দ্যাশের হয়ে গেল? কই ঐখানটোয় আসমান তো দুরকম লয়।"
এটি যে কেবল হাসান আজিজুল হকের নিজের অভিজ্ঞতা, তা কিন্তু নয়। প্রায় সকলেই যারা ওপার থেকে এসেছিলেন প্রায় সবার লেখনীতেই একই রকমের মর্মস্পর্শী যন্ত্রণার বিবরণ পাওয়া যায়। যেমন- হামিদা খানম তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “ মাঝে মাঝে আমার মনে হতো এ কেমন জীবন হলো, জগৎটা হঠাৎ করে কেন এতো ছোট হয়ে গেল। গন্ডি নিছক কয়টা জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কোথায় গেল সেই কাশ্মির থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া উন্মুক্ত আকাশ, ছেলেবেলা থেকে পরিচিত পরমাত্মীয়ের মতো মানুষগুলো। হঠাৎ করে পরদেশী হয়ে গেল, হারিয়ে গেল তাদের ঠিকানা।’
শুধুমাত্র রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে দেশত্যাগের ফলে সাধারণ জনগণের মধ্যে হতাশা ও হাহাকার নেমে আসে। কিন্তু সবগুলো তো জানা যায় না। হাসান আজিজুল হকের আক্ষেপ, "চারাগাছ এক জয়গায় থেকে আর জায়গায় লাগাইলে হয়, এক দ্যাশ থেকে আর দ্যাশে লাগাইলেও বোধায় হয়, কিন্তুক গাছ বুড়িয়ে গেলে আর কিছুতেই ভিন্ মাটিতে বাঁচে না।"
আমরা নব্বইয়ের দশকে হাসান আজিজুল হককে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। দর্শন বিভাগের আমার সতীর্থ বন্ধুদের কাছে স্যারের অনেক গল্প শুনতাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আমাদের সংগঠন রাজশাহী ইউনিভার্সিটি ড্রামা অ্যাসোসিয়েশন (রুডা) এর উপদেষ্টা ছিলেন হাসান আজিজুল হক স্যার। তাপস দা, ফারুক ভাই, পিরু ভাইয়ের সঙ্গে কখনো কখনো মমতাজ উদ্দিন কলাভবনে স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গেছি। আলাপে উঠে আসতো সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন, রাজনীতি সমস্ত কিছুই। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম স্যারের কথা। কালজয়ী কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। বাংলাদেশ সরকার তাকে ১৯৯৯ সালে একুশে পদকে ও ২০১৯ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে। এই অসামান্য গদ্যশিল্পী তার সার্বজৈবনিক সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে “সাহিত্যরত্ন” উপাধি লাভ করেন।
হাসান আজিজুল হক ছিলেন দেশ হারানো মানুষ। তিনি কি সত্যি সত্যি দেশের ঠিকানা পেয়েছিলেন। ঠিক যেন কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতার মতো, “ তারপর, সমস্ত পথ একটাও কোনো কথা না বলে আমরা হাঁটতে থাকি, হেঁটে যেতে থাকি/ এক দেশ থেকে অন্য দেশে” । কবি হাসান আজিজুল হকও রাঢ় বাংলার স্মৃতি আঁকড়ে রেখেছে সারা জীবন। যার সবটুকু উজাড় করে দিয়েছেন তার লেখা গল্প উপন্যাসে। ১৫ নভেম্বর ছির তার মৃত্যুবার্ষিকী, রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।
ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন