আধুনিক বিশ্বে নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের বিষয়টি নতুন নয়-এটি একটি জটিল এবং বহুমুখী প্রক্রিয়া যা কয়েক শতাব্দী ধরে বিস্তৃত। বিশ্বের অনেক দেশে বিশেষ করে উন্নত দেশে ভোটাধিকার, শিক্ষা, কর্ম ইত্যাদি ক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। উনিশ শতকের শেষের দিকে এবং বিশ শতকের প্রথম দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মতো অনেক পশ্চিমা দেশে মহিলাদের ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলনের উত্থান হয়। যদিও ১৮৯৩ সালের আগে অন্যান্য কয়েকটি অঞ্চলে মহিলাদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়েছিল, নিউজিল্যান্ডকে ন্যায্যভাবে সব প্রাপ্তবয়স্ক মহিলার ভোট দেওয়ার জন্য প্রথম স্ব-শাসিত দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। দীর্ঘকাল ব্রিটিশ বলয়ে থাকাকালে ভারতীয় উপমহাদেশের নারীদের শুরুতে কোনো ভোটাধিকার ছিল না, নারীদের ভোটাধিকারের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯১৮ সালে সীমিত আকারে শুধু জমির মালিকানা আছে এমন মহিলাদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়। পরবর্তীতে, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ বলয় থেকে বেরিয়ে আসার পর এই উপমহাদেশের নারীদের পুরুষের পাশাপাশি ভোটাধিকার নিশ্চিত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর জাতীয় পর্যায়ে নারীদের এই ভোটাধিকার আরও বেগবান হয়।
বিশ্বব্যাপী, বিশ শতকজুড়ে এবং একুশ শতকের মধ্যে, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে অসংখ্য আইনি সংস্কার যেমন: কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা, সমান কাজের জন্য সমান বেতনের নিশ্চয়তা এবং পারিবারিক সহিংসতা এবং যৌন হয়রানি সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর সমাধান ইত্যাদি হয়েছে। বিশেষ করে, বিশ শতকে কর্মশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন বলে মনে করা হয়. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, বিশেষ করে, যুদ্ধের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার জন্য অনেক নারী শ্রমশক্তিতে প্রবেশ করেছিল। এটি নারীর ভূমিকা সম্পর্কে সামাজিক ধারণাকে পরিবর্তন করতে এবং বিভিন্ন পেশায় নারীদের প্রবেশাধিকার ধীরে ধীরে বৃদ্ধিতে অনেক অবদান রেখেছে। গত শতাব্দীতে নারীদের শিক্ষার সুযোগ নাটকীয়ভাবে উন্নত হয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, গত এক দশকে, বাংলাদেশ শিক্ষায় লিঙ্গ ব্যবধান কমানোর ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করেছে, বর্তমান শিক্ষার লিঙ্গ সমতার হার ৯৩.৬ শতাংশ। আজ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীরা প্রায়ই সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং শিক্ষাগত অর্জনে লিঙ্গ বৈষম্য যথেষ্ট সংকুচিত হয়েছে। জাতিসংঘের Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women (CEDAW) বিশ্বব্যাপী লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অনেক দেশ CEDAW অনুমোদন করেছে এবং এর নীতির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালে CEDAW এবং ২০০০ সালে ঐচ্ছিক প্রটোকল অনুমোদন করেছে।
উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও, লিঙ্গ বৈষম্য এখনো বিভিন্ন আকারে বিদ্যমান, যার মধ্যে রয়েছে নারী-পুরুষের বেতনের ব্যবধান, নেতৃত্বের পদে নারীদের কম উপস্থাপনা এবং নারীর প্রতি সহিংসতা। যা কিছু প্রশ্নের উদ্রেক করে যেমন: একরকম কাজ করেও কেন এই বেতনের ভিন্নতা! কেন উচ্চপর্যায়ে নারীদের নিয়োগে অনীহা! কেন পরিবার ও সমাজে নারীদের প্রতি সহিংসতা! এটা কি শুধুই সমান অধিকারের বিষয়?
আমাদের মনে রাখতে হবে, নারী ও পুরুষ এক নয়। দুটি স্বতন্ত্র সত্তা-ভিন্নতা থাকতে পারে তাদের চরিত্রে, চলাফেরায়, কর্মে, পোশাকে, চিন্তাভাবনায়। ফলে, অধিকার বোধও হবে ভিন্ন। এমতবস্থায় যদি বলি, নারী ও পুরুষ এর সমঅধিকার কথাটি ঠিক নয়- তাহলে হয়তো অনেকেই আমার কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করবেন।
এই লেখাটিতে মূলতঃ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে এবং তুলে ধরা হয়েছে, নারী ও পুরুষের সমঅধিকার নয়, প্রাপ্য অধিকার দাও অর্থাৎ নারীকে নারীর ন্যায্য অধিকার দাও আর পুরুষকে পুরুষের ন্যায্য অধিকার দাও। আর এই অধিকার কেউ কাউকে দান করবে না, এটা প্রত্যেক নারী ও পুরুষের প্রাপ্য যেটা নিশ্চিত হওয়া উচিত পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে।
যুগে যুগে মায়েরা, মেয়েরা, এবং স্ত্রীরা বিভিন্নভাবে বঞ্চিত, নির্যাতিত ও অত্যাচারিত হতে হতে তাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে, পরিত্রাণ পেতে চেয়েছে এই অত্যাচার হতে। তার একটি মাধ্যম মনে করেছে, তথাকথিত ‘সমঅধিকার’ এর নামে আসলে ‘প্রাপ্য অধিকার’ নিশ্চিত করার প্রত্যয়। অথচ, ইসলামে নারীকে অর্থাৎ একজন মাকে, একজন মেয়েকে, বা একজন স্ত্রীকে যে সম্মান দেওয়া হয়েছে তা যদি বাস্তবায়ন হতো তাহলে হয়তো এত বঞ্চনার শিকার হতে হতো না এবং এত ক্ষোভেরও উৎপত্তি হতো না। ইসলামে একজন পুরুষের চারটে বিয়ে করার বিধান আছে, এই তথ্য আমি মনে করি, শতভাগ মানুষই জানে, কিন্তু এই চারজনের ভরণপোষণ বা দেখভাল কীভাবে করতে হবে, এ বিষয়টি কয়জন জানেন? আবার যদি পারিবারিক সম্পত্তি বণ্টনের ব্যাপারটা দেখি, পিতার সম্পত্তিতে ছেলেসন্তান দুই ভাগ এবং কন্যাসন্তান একভাগ পাবে কিন্তু এই একভাগ সম্পত্তি কন্যাসন্তানকে ঠিকমতো বুঝিয়ে দিচ্ছে কয়টা পরিবার! আর এটি নিয়ে মেয়েদের কী পরিমাণ ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে তা আমাদের অজানা নয়। এখানে সমঅধিকার থেকে প্রাপ্য অধিকারটাই বেশি প্রযোজ্য নয় কি!
এই লেখাটি মূলত সমঅধিকারের নামে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়েছে অর্থাৎ “একজন নারীকে সমঅধিকারের জন্য পুরুষের মতো হতে হবে, আবার পুরুষকেও সমধিকারের জন্য নারীর মতো হতে হবে”- তার বিরুদ্ধে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমি কয়েকটি বিষয় তুলে ধরছি:
১. অনেক কাজ আছে যা নারী-পুরুষ সবাই করতে পারে, আবার কিছু কাজ আছে যেটা নারী করতে পারে কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে হয়তো তা নারীর জন্য শোভনীয় নয়। একই কথা প্রযোজ্য পুরুষের ক্ষেত্রেও। এটা আমাদের মানতেই হবে। এক্ষেত্রে পোশাক একটা উদাহরণ হতে পারে। পুরুষের জন্য যেমন শাড়ি-চুড়ি পরিধান করা শোভনীয় নয়, তেমনি মেয়েদেরও পোশাকের শালীনতার বিষয় আছে। এগুলো আমাদের মাথায় রাখতেই হবে।
২. আরেকটি উদাহরণ যদি দেই, যেমন, একদিকে বলছি সমঅধিকার চাই, অন্যদিকে বলছি প্রতিটি বাসে মহিলাদের জন্য বসার জায়গা নির্দিষ্ট থাকা উচিত; যেটা আমার কাছে কিছুটা অবান্তর মনে হয়। আপনার মনে হতে পারে অবান্তর কেন? কারণ, সমঅধিকার বললে এই বসার জায়গাটা নির্দিষ্ট থাকার কথা না। তবে আমার মতে, প্রতিটি বাসে অবশ্যই মহিলাদের জন্য কিছু বসার জায়গা বরাদ্দ থাকা উচিত। কারণ, বাসের রেলিং ধরে একটা ছেলে যত সহজে বাসে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ভ্রমণ করতে পারে একটা মেয়ে তা করতে পারে না, আর বৃদ্ধ বা গর্ভবর্তী মা হলে তো নয়ই। আর ভিড়ের মধ্যে চাপাচাপি করে যাওয়াটা তো অবশই অস্বস্তিকর, বিশেষ করে মেয়েদের জন্য।
৩. চাকরিজীবী দম্পতিদের দিকে যদি আমরা একটু নজর দেই, দেখব স্ত্রীরা বাড়ির রান্না, ঘর গোছানো, সন্তান লালনপালন থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ করে যাচ্ছেন অফিসের পাশাপাশি, অন্যদিকে স্বামী বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শুধু অফিস করেই খ্যান্ত! এমনকি একই সাথে অফিস থেকে বাসায় ফিরে আসার পর সন্ধ্যার চা টা স্ত্রীকেই করতে হয়। এখানে সমঅধিকারের থেকে প্রাপ্য অধিকার বোধটাই হয়তো বেশি যায়।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ক্ষোভ থেকে এই 'প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করার প্রত্যয় শুরু হয়েছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দু-একটা ঘটনার সূত্র ধরে বলতে চাই ‘স্যার’ সম্বোধন করতে বলাটাও কিন্তু এমন একটি 'প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়। হয়তো অনেকদিন ধরে দ্বিমুখী আচরণ সহ্য করা থেকেই এমন অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ- যা অবশই আমাদের উদ্বেগের কারণ হওয়া উচিত।
আমরা জানি, বহির্বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশের মেয়েরা পুরুষের পাশাপাশি তাদের কর্মক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। প্রায় প্রতিটি পেশায়ই মেয়েরা সগর্বে নিজের যোগ্যতায় কাজ করে যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে নারীর অবদান অনেক যা অনধিকার্য। নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে ২০২১ সালের ৩২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ২০২২ সালে ৪২ দশমিক ৭ শতাংশ। আমাদের দেশে কর্মজীবী মহিলা জনসংখ্যার ৩৮ শতাংশ সক্রিয়ভাবে কর্মে নিযুক্ত, যেখানে ভারতে শুধু ২০ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ২২ শতাংশ। অন্যদিকে, টেক্সটাইল খাত যা আমাদের রপ্তানি খাতে ৮০ শতাংশের অধিক অবদান রাখে, সেখানে ৪ মিলিয়ন কর্মী নিয়োগ করে যার মধ্যে ৬৫ শতাংশ মহিলা। নারীর এই অগ্রযাত্রাকে ধরে রাখতে এবং বেগবান করতে নারীর প্রাপ্য অধিকারটুকু নিশ্চিত করার দায়িত্ব সবার। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র- প্রত্যেকে তার জায়গা থেকে নারীর এই প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করলে এবং তা প্রদানে প্রত্যয়ী হলেই পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র হবে সুন্দর এবং সার্বজনীন।
ড. জিন্নাত আরা: রিসার্চ ফেলো, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান
মন্তব্য করুন