ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পর গত জানুয়ারিতে জর্ডান সীমান্তে মার্কিন ঘাঁটিতে ড্রোন হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের তিন সেনা নিহত হয়। ইরান-সমর্থিত হুথিরা লোহিত সাগরে মার্কিন জাহাজ ও তেলের ট্যাঙ্কারে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে যাচ্ছে নিয়মিত। লেবানন থেকে উত্তর ইসরায়েলে রকেট ছুঁড়ছে ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ।এসব রকেট ও ড্রোন ইরানের তৈরি বলে দাবি ইসরায়েল ও আমেরিকার। দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে পশ্চিমাদের সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে অনেকটা বিচ্ছিন্ন ইরান। নিষেধাজ্ঞাসহ নানামুখী চাপ ও অবরোধে অনেকটা পর্যুদস্ত দেশটি। তা সত্ত্বেও আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে ইরান তার অবস্থান ধরে রেখেছে। একইসঙ্গে দেশটি তার অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার দিকে মনোযোগ দিয়েছে এবং সামরিক খাতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটিয়েছে।
ইসরায়েল এবং আমেরিকার সঙ্গে টক্কর দিয়ে ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেকে একজন শক্তিশালী খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে ইরান। বিশ্বরাজনীতিতেও ইরান একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। প্রতিবেশী দেশগুলোতে নিজের প্রভাব ও অবস্থান ধরে রাখতে অরাষ্ট্রীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে ব্যবহার করার কৌশল তৈরি করেছে দেশটি।
ইরানের কুদস বাহিনী হামাস, হিজবুল্লাহ এবং হুথিসহ এই অঞ্চলের বিভিন্ন গোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ, অর্থায়ন এবং অস্ত্র সহায়তা প্রদান করেছে। একইসঙ্গে এসব বাহিনীকে শক্তিশালী রাজনৈতিক চরিত্রে রূপান্তরিত করেছে দেশটি। এই কৌশলটি ইরানের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়েছে।
হামাস:
মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি শাখা হিসাবে ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় হামাস। ১৯৯০ দশকের গোড়ার দিকে হামাস ইরানের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম ইন্তিফাদার সময় প্রধান্য অর্জন করে সংগঠনটি। ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় ইরান হামাসকে আর্থিক ও অস্ত্র সহায়তা প্রদান করে। ২০০৫ সালে গাজা থেকে ইসরায়েল তার সৈন্য প্রত্যাহার করে। পরের বছর নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে হামাস অঞ্চলটির উপর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।
হামাসের অধীনে ইসরায়েল বিরোধী সশস্ত্র ফিলিস্তিনিদের একত্র করার সুযোগ পায় ইরান। এর মাধ্যমে ইসরাইলকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম হয় তেহরান। একটি পারস্য ও শিয়া মুসলিম দেশ হয়েও আরব অঞ্চলের এবং সুন্নি মুসলিম প্রধান উপদ্বীপে নিজের ব্যাপক প্রভাব তৈরি করা ইরানের জন্য বড় একটি সাফল্য। সরাসরি প্রতিবেশী না হয়েও ফিলিস্তিনে ইরানের এই কূটনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব অভাবনীয়।
৭ অক্টোবর:
আরব রাষ্ট্রগুলো যেখানে নিষ্ক্রিয় সেখানে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা এবং হামাসকে সমর্থনে সবসময় সরব থেকেছে ইরান। ইসরায়েলের সঙ্গে আরব রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিকরণ প্রক্রিয়ার প্রতিবাদে ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি ভূখণ্ডে অতর্কিত হামলা চালায় হামাস। এর পরিপ্রেক্ষিতে গাজায় ইসরায়েলের নৃশংস বোমা হামলায় প্রায় ৪০ হাজার ফিলিস্তিনি মৃত্যুবরণ করেছে। এখনো গাজায় হামলা চালানো অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল।
ইসরায়েলের চলমান হামলার মধ্যে হামাসের প্রতি তার সমর্থন প্রকাশ করেছে ইরান। ইরান এবং হামাসের মধ্যে সম্পর্ক মূলত ইসরায়েল এবং পশ্চিমা বিরোধিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং হামাস তুরস্ক, কাতার এবং অন্যান্য উৎস থেকেও আর্থিক সহায়তা লাভ করে।
হিজবুল্লাহ:
ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অ-রাষ্ট্রীয় মিত্র হিসাবে দেখা হয় হিজবুল্লাহকে। লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময় ১৯৮২ সালে একটি শিয়া মিলিশিয়া হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় হিজবুল্লাহ। হিজবুল্লাহর রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সামরিক সদস্য। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল এবং পশ্চিমা বাহিনীকে চাপে রাখতে হিজবুল্লাহ ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র। সাম্প্রতিক সংঘাতের সূত্রপাতের পর থেকে, হিজবুল্লাহ উত্তর ইসরায়েলে শত শত ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে।
অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক রাখতে ইরানের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হিজবুল্লাহ। হিজবুল্লাহ ঐতিহাসিকভাবে লেবানন ও সিরিয়ায় হামাস যোদ্ধাদেরকে অস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে। লেবাননের রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিজবুল্লাহ। ২০১৮ সালের নির্বাচনে হিজবুল্লাহ-নেতৃত্বাধীন জোট লেবাননের সংসদীয় আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ফলে লেবাননের রাজনীতিতে ইরানের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
সিরিয়া ও ইরাকে ইরানের অদৃশ্য সাম্রাজ্য:
২০১১ সালে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইরান তার দীর্ঘদিনের মিত্র প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। বাশার আল আসাদকে অস্ত্র, মিলিশিয়া বাহিনী ও লজিস্টিক সহায়তা দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে সহায়তা করেছে ইরান। ইরানের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ইসলামিক স্টেট (আইএসআইএস) ও পশ্চিমাপন্থি শক্তির বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছেন বাশার আল-আসাদ।
সিরিয়ায় আসাদ সরকারের অবস্থান স্থিতিশীল হওয়ার সাথে সাথে ইরান তার অনুগত মিলিশিয়া গ্রুপগুলোকে সিরিয়ার সশস্ত্র বাহিনীতে একীভূত করার চেষ্টা করেছে। এটি সিরিয়ায় ইরানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়াতে সহায়তা করেছে এবং রাশিয়ার প্রভাবকে ছাপিয়েও সেখানে ইরানের শক্তিশালী অবস্থানকে আরও পাকাপোক্ত করেছে। গাজায় ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর থেকে সিরিয়ায় অবস্থানরত ইরানপন্থী মিলিশিয়ারা সিরিয়ার অভ্যন্তরে মার্কিন ও মিত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে অসংখ্য হামলা চালিয়েছে।
ইরাকের ভেতরে একাধিক শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠী তৈরি এবং তাদের শক্তি বৃদ্ধিতে বেশ সাফল্যও দেখিয়েছে ইরান। এমনকি এখন ইরাকি পার্লামেন্টের ভেতরেও ইরানের পক্ষে কথা বলার মতো অনেক প্রভাবশালী কণ্ঠ তৈরি হয়েছে। ইরাক যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেনের পতনের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জয় হয়েছে সত্যি, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের জয় আসলে শাপে বর হয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল প্রতিপক্ষ ইরানের জন্য। ইরানপন্থি ইরাকি মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো ৭ অক্টোবর থেকে ইরাকে মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে রকেট হামলা বাড়িয়েছে।
২০১১ সালে ইরাক থেকে বেশিরভাগ মার্কিন বাহিনীর প্রস্থানের পর, ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো ইরাকের ভঙ্গুর গণতন্ত্রে রাজনৈতিক সংহতি চেয়েছিল। এই গোষ্ঠীগুলো ইতোমধ্যে ইরাকে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করেছে। ২০১৪ সালে আইএসআইএস-এর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ইরাকের অসংখ্য ইরানপন্থি গোষ্ঠীকে একীভূত করে তৈরি করা হয়েছিল পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সেস (PMF)। তারা আইএসআইএসের দখল থেকে দেশের বেশিরভাগ অঞ্চল মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল যা ইরাকিদের কাছে তাদের মর্যাদা ও গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
ইরাকের ২০১৮ সালের সংসদীয় নির্বাচনে এই পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সেস (PMF) দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক ব্লক হয়ে ওঠে এবং এই গোষ্ঠী আর্থিক নিরাপত্তার জন্য আলাদা বাজেট লাভ করে। PMF সদস্যরা এখন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইরাকের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সুপ্রিম কোর্ট পারচালনা করে। ২০২৩ সালের ইরাক সংসদ নির্বাচনে PMF-এর রাজনৈতিক শাখা ইসলামিক রেজিস্ট্যান্স ইন ইরাক (আইআরআই) মোট ২৮৫টি আসনের মধ্যে ১০১টি আসনে জয়লাভ করে। তারাই ইরাক থেকে অবশিষ্ট মার্কিন বাহিনীকে বের করে দেওয়ার প্রচেষ্টার উদ্যোগ নিয়েছে।
৭ অক্টোবর থেকে ইরাকের এই ইরানপন্থি মিলিশিয়া শক্তিগুলো মার্কিন সামরিক অবস্থানগুলোতে তাদের হামলা বাড়িয়ে দিয়েছে। ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিগুলোকে চাপে রাখতে ইরানের প্রক্সি হিসেবে কাজ করছে এই মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো। গত জানুয়ারিতে জর্ডান সীমান্তে মার্কিন ঘাটিতে ড্রোন হামলা চালিয়ে তিন মার্কিন সেনাকে তারাই হত্যা করেছিল বলে ধারণা করা হয়।
হুথি ও ইয়েমেন:
১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধের মধ্যে একটি শিয়া ইসলামপন্থি গোষ্ঠী হিসাবে আবির্ভূত হয় হুথিরা। হুথি আন্দোলন প্রাথমিকভাবে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দিকে তাদের মনোযোগ নিবদ্ধ রেখেছিল। ২০১০-এর দশকে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ ব্যপক আকার ধারণ করে। এ সময় ইরানের ইশারায় হুথিদের পাশে এসে দাঁড়ায় হিজবুল্লাহ। হিজবুল্লাহ হুথিদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণের দিকে মনোনিবেশ করে অন্যদিকে ইরান তার আর্থিক, লজিস্টিক এবং অস্ত্র সহায়তা বৃদ্ধি করে।
২০১৫ সালে সৌদি আরব হুথিদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ইয়েমেন আক্রমণ করে। ফলে হুথিদের প্রতি ইরানের সমর্থন আরও বৃদ্ধি পায়। ইরানের ব্যাপক সামরিক ও আর্থিক সহায়তায় হুথিরা সৌদি নেতৃত্বাধীন বাহিনীকে পরাজিত করে। ২০২৩ সালে সৌদি আরব ইয়েমেন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়।
ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে হুথিরা দক্ষিণ ইসরায়েলে বেশ কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। কিন্তু তাদের প্রধান লক্ষ্য হামাস ও ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া। হুথিরা ইরানি এবং হিজবুল্লাহ কর্মকর্তাদের সাঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করে। তারা বিশেষ করে মার্কিন জাহাজগুলোকে টার্গেট করে রকেট হামলা চালাচ্ছে।
ফিলিস্তিনকে সমর্থন এবং পশ্চিমাবিরোধী নীতি দেশের মধ্যে হুথিদের সমর্থনকে ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে তুলছে। তাদের এই সক্রিয়তা ইয়েমেনের শান্তি প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে। আর পরিশেষে এটি দেশের উপর হুথিদের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে। ইয়েমেনে হুথিদের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এই অঞ্চলে ইরানের অদৃশ্য সম্রাজ্যকে নিঃসন্দেহে আরও একধাপ এগিয়ে দেবে।
জন রুয়েল: অস্ট্রেলিয়ান-আমেরিকান সাংবাদিক। ভাষান্তর: মুজাহিদুল ইসলাম
মন্তব্য করুন