এই প্রাচীন ছাদের নিচে কেমন কেটেছিল আপনার প্রথম রাত? লোভ করে জেরুজালেমের মুসলমানদের একটি বাড়ি দখল করে সেই বাড়ির মালিক দুজন অসুস্থ বৃদ্ধকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছেন। এই বাড়িতে ঘুমাতে আপনার বিবেকে বাধেনি? ওহে অভিশপ্ত দখলদার!
একটি পরিবারের ৭০ বছরের স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িতে প্রবেশ করতে কেমন লেগেছিল আপনার? আপনি কি ১৯৪৮ সালের উচ্ছেদকৃতদের বাড়ি দখল করার মতো করে প্রবেশ করেছেন? এমন বাড়ি দখল করেছেন যেখানে রান্নাঘরে চুলার ওপরে হাঁড়ি আর ভেজা কাপড়গুলো এখনো শুকাতে দেওয়া! অন্যের বাড়ি আক্রমণ করতে কেমন লেগেছে আপনার? আপনার জন্য বাড়ি খালি করে দিতে পুলিশ একজন বৃদ্ধকে টেনেহিঁচড়ে তার বাড়ি থেকে নামিয়ে দিচ্ছে, দেখতে কেমন লেগেছিল আপনার?
আপনি কি দেয়ালের সেই গ্রাফিতিগুলো দেখেছেন, যেখানে লেখা ছিল; ‘আমরা ফিরে আসব’ এবং ‘ফিলিস্তিন স্বাধীন হবে’? আমি দেখতে পাচ্ছি, আপনি ইতিমধ্যেই ওই বাড়ির জানালায় ইসরায়েলি পতাকা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। যেমন একজন চোর প্রমাণ গোপন করার জন্য চুরি করা গাড়ির নম্বর প্লেট দ্রুত পরিবর্তন করে ফেলে এবং এখন এই বাড়িটি চিরকাল ইহুদিদের হয়ে গেল। এখন এই বাড়িটি আপনার হয়ে গেল! বিখ্যাত ইসরায়েলি বিচারব্যবস্থাকে ধন্যবাদ, যে বিচারব্যবস্থা ইহুদি জাতির অধিকারের নামে ডাকাতি করে, যে বিচারব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত এবং বর্ণবাদী।
ফিলিস্তিনে ইহুদি এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সম্পত্তির বণ্টন নিয়ে দ্বন্দ্ব অমীমাংসিত রয়েছে। জেরুজালেমের বিচারকরা কীভাবে সেই সম্পত্তি ভাগ করবেন ১৯৪৮ সালের আগে যা ইহুদিদের ছিলই না। একটি খাঁটি বর্ণবাদ প্রতিক্রিয়া ছাড়া রায় বর্ণনা করার অন্য কোনো উপায় আছে কি?
এই অভিশপ্ত বসতি স্থাপনকারীরা রাতে ঘুমায় কীভাবে? আর আগামী রাতেও বা তারা ঘুমাবে কেমন করে? আপনি কি ক্ষণিকের জন্যও ভেবেছেন, ৭৪ বছর বয়সি বৃদ্ধ ফিলিস্তিনি মুস্তাফা লাবানের ভাগ্যের কথা? এখন এই বৃদ্ধ বয়সে আপনি যাকে তার বাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছেন! আপনি কি তার স্ত্রীর কথা ভেবেছেন, যিনি ৬৮ বছর আগে এই বাড়িতে জন্ম নিয়ে মঙ্গলবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন? তাদের চোখের দিকে তাকানোর সাহস হয়েছিল কী আপনার? তাদের চেহারা কি আপনার চোখে ভাসে?
কেউ কেবল এই কামনা করতে পারে যে, তাদের বাড়ি থেকে নিক্ষিপ্ত হওয়ার চিত্র, আপনার মৃত্যু পর্যন্ত দুঃস্বপ্নে আপনাকে তাড়িত করবে। আপনি প্রতি রাতে আপনার সন্তানদের বিছানায় শোয়ানোর সময় তাদের প্রতিমূর্তি আপনার সামনে এসে দাঁড়াক।
কিন্তু তেমনটা হতে যাচ্ছে না। তারা আপনার কাছে মানুষ নয়, আপনার চোখে তারা মানুষের চেয়ে কম– কারণ, তারা ইহুদি নয় এবং এই সবকিছুই ইসরায়েলি বিচারব্যবস্থা দ্বারা অনুমোদিত ছিল।
আপনি কি গরিব মানুষের সেই ভেড়ার প্রবাদ শুনেছেন? সেই প্রবাদের মতোই এই বাড়ি দখলের গল্প। বিশাল বাড়ির ইহুদি হুইলার-বিক্রেতা ইসরায়েলি পুলিশের সাহায্য নিয়ে এই বাড়িতে ভাড়া থাকে। তারপর সে বাড়ি দখল করে নিয়ে বাড়ির মালিককেই ভাড়াটিয়া বানায়। এরপর সারাক্ষণ লাউড স্পিকারে বধির ইহুদি সংগীত দিয়ে পরিবারকে হয়রানি করত। তাতেও ওই পরিবারকে বাড়িছাড়া করতে না পেরে শেষে পুলিশ দিয়ে উচ্ছেদ করল। এভাবেই চলে মুসলমানদের বাড়ি দখল আর ইহুদিদের নতুন বসতি স্থাপন।
ইসরায়েলি জাতি মঙ্গলবার আবার জিতেছে। এবারের বিজয় একটি বিশেষ এবং গৌরবময় বিজয়, একটি বৃদ্ধ দম্পতির ওপর বিজয়। সেটেলার যেসব পরিবার, যারা ইতিমধ্যেই মুসলিমদের বসতির কেন্দ্রস্থলে ওই প্রাচীন ভবনে বসবাস শুরু করেছে, তারা এই ভবনে আরও ভাড়াটিয়া তুলছে।
যদি তারা আজ এই দখল করা অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করে, তারা এখনও ভাত এবং মুরগির ঝোল খেতে পারবে; যা ওই বৃদ্ধ দম্পতি তাদের সন্তানদের জন্য রান্না করেছিল। সেই খাবার এখনও ফ্রিজে রাখা আছে যা গত দুদিন আগেই রান্না করা হয়েছিল। ওই মুসলিম পরিবারের সমস্ত সম্পত্তি এখনও সেই অ্যাপার্টমেন্টেই রয়েছে, শুধু তাদের পারিবারিক ছবির অ্যালবামটা ছাড়া।
ইতিমধ্যে প্রধান প্রবেশদ্বারের তালাটি পরিবর্তন করা হয়েছে এবং ওই পরিবারের আর প্রবেশাধিকার নেই যারা ছিল এই বাড়ির মালিক। যেখানে নিজের বাড়িতে এই বৃদ্ধ দম্পতি সংরক্ষিত ভাড়াটে হিসেবে বসবাস করতেন। আবারও এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ফিলিস্তিনিদের কোনো সুরক্ষা নেই, এমনকি ভাড়াটে হিসেবেও নয়।
বাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়ার সময় ওই বৃদ্ধের স্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমরা ফিরে না আসা পর্যন্ত এই বাড়িটি একটি কারাগার হয়ে থাকবে।’
মঙ্গলবার, যেদিন ইসরায়েলি প্রতিবাদ আন্দোলন আরেকটি চিত্তাকর্ষক কৃতিত্ব অর্জন করেছিল, যখন দেশের প্রান্ত থেকে মানুষ ‘গণতন্ত্র’ এবং ‘লজ্জা’ বলে চিৎকার করে স্লোগান দিচ্ছিল, ঠিক সে সময় ঘটেছিল জেরুজালেমের এই অপমান। ওই মুসলিম পরিবার এখন আর সেখানে থাকেন না। এভাবেই মুসলিমদের বাড়িগুলো হবে ইহুদিদের, আর ইসরায়েল হবে একটি বর্ণান্ধ রাষ্ট্র।
মূল - গিডিয়ন লেভি (Gideon Levy), একজন ইজরায়েলি সাংবাদিক এবং লেখক
ভাষান্তর - মুজাহিদুল ইসলাম
মন্তব্য করুন