চীনের সাথে মিলিটারি-টু-মিলিটারি যোগাযোগের জন্য অনুরোধ করে চলেছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। কিন্তু চীনা সামরিক বাহিনী জানে, আপনি যদি আমেরিকাকে অস্বস্তিতে ফেলতে চান, তাদের সাথে কথা বলবেন না। এবং চীন এই নীতিই গ্রহণ করেছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন তার সাম্প্রতিক চীন সফরের সময়, বারবার চীনা কর্মকর্তাদের কাছে একটি চীন-যুক্তরাষ্ট্র সামরিক-টু-সামরিক যোগাযোগ হটলাইন স্থাপন করতে অনুরোধ জানিয়েছেন। কিন্তু চীনা কর্মকর্তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
মার্কিন নৌবাহিনীর ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ডের প্রধান কমান্ডার অ্যাডমিরাল জন অ্যাকুইলিনো চলতি বছরের শুরুতে অভিযোগ করেছিলেন, চীন তার সামরিক বাহিনী পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) আঞ্চলিক কমান্ডের সাথে সরাসরি যোগাযোগ চ্যানেল স্থাপনের জন্য মার্কিন অনুরোধ উপেক্ষা করছে।
এমনকি মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন গত জুনে অনুষ্ঠিত শাংগ্রি-লা সংলাপের সময় চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লি শাংফুর সাথে বৈঠকের জন্য অনুরোধ করলে তাকেও প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল।
চীনের এই আচরণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় বেসামরিক এবং সামরিক কর্মকর্তারা বিরক্ত হতে পারেন। তবে তারা তাদের চীনা সমকক্ষদের সাথে যোগাযোগ হটলাইন চালুর পরিবর্তে, ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় নিজেদের নৌবাহিনী জাহাজ এবং সাবমেরিন স্বল্পতা বা অ্যান্টি-শিপ ক্রুজ মিসাইলের স্টক থাকার বিষয়ে বেশি চিন্তিত হওয়া উচিত।
মার্কিন বাহিনীর সাথে যোগাযোগের কৌশল চীনের অজানা নয়
গত কয়েক বছর ধরে মার্কিন সামরিক বাহিনী দক্ষিণ চীন সাগর এবং তাইওয়ান প্রণালিতে চীনা সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হচ্ছে। এটি সৌভাগ্যের যে, এখনো তারা সংঘাতে জড়ায়নি বা কেউ হতাহত হয়নি। চীন এবং মার্কিন সামরিক বাহিনীর মধ্যে যোগাযোগ হটলাইন চালু খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। চীনের লিবারেশন আর্মি জানে কীভাবে ওই এলাকায় মার্কিন বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়।
সব সামরিক বাহিনীর কাছে সমুদ্র অথবা আকাশে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করার জন্য পরিচালিত যোগাযোগ চ্যানেল ইতিমধ্যেই বিদ্যমান। আপনি আরও লক্ষ্য করে থাকবেন, চীনা সামরিক বাহিনী নিয়মিতভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়ান, জাপানি, কানাডিয়ান এবং অন্যান্য জাহাজ এবং বিমানের সাথে যোগাযোগ করে তাদের সতর্ক করে। দক্ষিণ চীন সাগর এবং তাইওয়ান প্রণালিকে নিজের বলে দাবি করে চীন এসব অঞ্চল থেকে তাদের দূরে থাকতে বলে।
চীনারা মনে করে, আমেরিকানসহ অন্যদের চীনের অনুমতি ছাড়া দক্ষিণ চীন সাগর এবং তাইওয়ান প্রণালিতে কাজ করা উচিত নয়। আর এখানেই চীন তার অবস্থানের জানান দেয়। তাই কিছু অন্য বা বিশেষ ‘যোগাযোগ চ্যানেল’ থাকা না থাকায় কারো মন পরিবর্তন করতে যাচ্ছে না।
মিলিটারি-টু-মিলিটারি যোগাযোগ হটলাইন হলে সমস্যা কী?
পিপল লিবারেশন আর্মি যখন দক্ষিণ চীন সাগর এবং তাইওয়ান প্রণালিতে মার্কিন জাহাজ ও বিমানে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে বা বাধা দেয়, তখন চীনারা জানে যে, তারা ঠিক কী করছে এবং এই নির্দেশ ওপর থেকেই আসে।
তাই ‘তারা যা করছে তা করা উচিত নয়’ এটা বলার জন্য একটি নির্দিষ্ট লাইনে চীনাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারলেও তা অর্থহীন বলেই মনে হয়। চীনারা জানে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুশি নয় এবং তারা এতে পাত্তাও দেয় না।
উত্তরটা হলো, আমেরিকানরা এমন একটি যোগাযোগ চ্যানেল পেতে অনেক বেশি আগ্রহী। চীন যদি এই ধরনের চ্যানেলে যোগ দিতে অস্বীকার করে তবে সম্ভবত আমেরিকা চীনের সম্মতি পাওয়ার জন্য কিছু ছাড় অফার করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চীনা গুপ্তচর বেলুনকে একটি ইস্যু না করা।
আবার সামরিক ফ্রন্টে ছাড় নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমেরিকা চীনের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে পারে। অথবা এটি চীনের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক অ্যাসেট চুরি সম্পর্কে আমেরিকা তার অভিযোগ তুলে নিতে পারে।
ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন-চীন দ্বন্দ্ব
কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করতে পারেন, দুই সামরিক বাহিনীর মধ্যে যোগাযোগের এই অনুপস্থিতি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন অভিযানকে প্রভাবিত করে কিনা। এর উত্তর: প্রভাবিত করে না।
চীনারা জানে তারা কি করছে এবং তারা কি করতে চায়। তাদের উদ্দেশ্য হলো আমেরিকানদের এশিয়া-প্যাসিফিক থেকে তাড়িয়ে দেওয়া এবং এই অঞ্চলে চীনা লিবারেশন আর্মির আধিপত্য বিস্তার করা। তারা এই বিষয়ে তাদের অবস্থান যথেষ্ট পরিষ্কার করেছে।
এটি একটি প্রতিকূল সম্পর্ক। তাই চীনের সাথে মার্কিন মিলিটারি-টু-মিলিটারি যোগাযোগ বা সম্পৃক্ততা এখানে কোনো পার্থক্য তৈরি করবে না।
মার্কিন সামরিক বাহিনী কয়েক দশক ধরে চীন সামরিক বাহিনীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে এবং কখনো কখনো একসাথেও কাজ করেছে। সেটা ছিল ট্রাম্প প্রশাসন পর্যন্ত। মার্কিন নৌবাহিনীর প্রধান আঞ্চলিক মহড়া RIMPAC-তেও চীন সামরিক বাহিনীকে দুবার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
তবে এই নীতি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পাওয়াটা কী? যুক্তরাষ্ট্র পেল এমন একটি চীনা সামরিক বাহিনী যা অনেক ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই টেক্কা দিতে পারে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটিকে ছাড়িয়েও গেছে। তারা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে মার্কিন সামরিক বাহিনীর ওপর হামলা চালাতেও পিছপা হবে না।
আমেরিকার ভিন্ন পদ্ধতি কেমন হতে পারে?
আমেরিকানদের একটি অহংকার রয়েছে যে, তারা যদি কারও সাথে কথা বলতে পারে তবে তারা যে কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারে।
কিন্তু, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি চীনা সামরিক বাহিনীর সাথে এই যোগাযোগ চ্যানেল স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাবে? হয়তো তারা চেষ্টা চালিয়ে যাবে। তবে চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি বৃদ্ধি আমেরিকাকেও সংঘাতের পথে নিয়ে যেতে পারে।
মূল: গ্রান্ট নিউজহ্যাম (GRANT NEWSHAM), একজন অবসরপ্রাপ্ত আমেরিকান নৌ-কর্মকর্তা, বর্তমানে তিনি জাপান ফোরাম ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের একজন সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে কর্মরত আছেন।
ভাষান্তর: মুজাহিদুল ইসলাম
মন্তব্য করুন