পেশাদার চুক্তি নেই, বড় কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলার অভিজ্ঞতাও নেই। তবুও বিশ্বকাপের টিকিট নিশ্চিত করে ইতালি ক্রিকেট এখন ইতিহাস লিখছে। ভারতের মাটিতে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে অনুষ্ঠিতব্য টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে জায়গা করে নিয়েছে ইউরোপের এই দেশটি।
বিশ্বকাপের আগেই টুর্নামেন্টের অন্যতম আলোচিত দল হয়ে উঠেছে ইতালি। অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের প্রবাসীদের নিয়ে গড়া এই দলটি দেখিয়ে দিয়েছে—মনে প্রাণে চাইলেই খেলার পরিধি কতদূর বাড়ানো যায়।
এই স্বপ্নযাত্রার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন হারি মানেন্তি। ইউরোপিয়ান কোয়ালিফায়ারে প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট নির্বাচিত হওয়া এই স্পিন অলরাউন্ডার মূলত অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। তবে তার শিকড় ইতালিতে। তার দাদা ছিলেন ইতালির বেনেত্তোন রাগবি দলের খেলোয়াড়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানেন্তির পরিবার নিরাপত্তার খোঁজে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমায়।
হারির ভাষায়— ‘আমার দাদিমা মাত্র সাত বছর বয়সে ইতালি থেকে অস্ট্রেলিয়ায় চলে আসেন। এরপর থেকেই আমাদের পরিবার সেখানেই রয়ে যায়, তবে ইতালির প্রতি টান কখনোই কমেনি।’
চার বছর আগে ইতালির ক্রিকেট বোর্ড মানেন্তির ভাই বেনজামিনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে হারির সঙ্গে। কোভিডের কারণে কিছুটা বিলম্ব হলেও, এরপর থেকেই তিনি নিয়মিত ইতালির হয়ে খেলছেন। প্রায় দুই বছর ধরে প্রতি মৌসুমে এক বা দুইটি টুর্নামেন্ট খেলেছেন, কখনো কোনো পেশাদার চুক্তি ছাড়াই।
‘আমাদের অধিকাংশ খেলোয়াড়ই চাকরি করে। কেউ কেউ শিক্ষক, কেউ ব্যাংকে কাজ করে। তবে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার টানে সবাই সময় বের করে ক্রিকেট খেলছে।’
মানেন্তি জানালেন, তাদের পরবর্তী লক্ষ্য হলো ওয়ানডে মর্যাদা অর্জন করা।
‘দলের সবাই জানে, বিশ্বকাপে খেলাই শেষ লক্ষ্য নয়। সামনে বড় চ্যালেঞ্জ ওয়ানডে স্ট্যাটাস পাওয়া এবং নিয়মিত আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা।’
শুধু ফুটবল নয়, একসময় ইতালিতে ক্রিকেটও জনপ্রিয় ছিল। আশ্চর্য হলেও সত্য, এসি মিলান—বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত একটি ফুটবল ক্লাব, একসময় ছিল একটি ক্রিকেট ক্লাব! সেই ঐতিহ্যকে সামনে রেখে আবার গড়ে তোলা হচ্ছে ইতালির ক্রিকেট।
তাসমানিয়ার ক্লাব ক্রিকেটার পিটার ডি ভেনুটো বর্তমানে ইতালির ক্রিকেটের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তার খোঁজে বের করে আনা খেলোয়াড়রাই আজ ইতালিকে পৌঁছে দিয়েছে বিশ্বকাপে। মানেন্তির ভাষায়— ‘পিটার আমাদের মধ্যে পেশাদার মানসিকতা ঢুকিয়ে দিয়েছেন। তিনি আমাদের মেন্টর, কোচ এবং দৃষ্টিভঙ্গি বদলের পথপ্রদর্শক।’
তাদের দলে প্রবাসীদের আধিক্য থাকলেও মানেন্তি আশাবাদী—স্থানীয় ইতালীয় ছেলেমেয়েরাও এই খেলায় আগ্রহী হয়ে উঠবে। ইতোমধ্যে স্কুল প্রোগ্রামের মাধ্যমে ক্রিকেট ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ‘ইতালিতে দক্ষিণ এশিয়ার অভিবাসীদের সংখ্যা বাড়ছে। অনেকেই ইতালিকে নিজের দেশ মনে করে ক্লাবে যোগ দিয়েছে। তারা ক্রিকেট ভালোবাসে, সেটি আমাদের ভবিষ্যতের বড় শক্তি হতে পারে।’
বিশ্বকাপে ইতালি কোন দলের বিপক্ষে খেলবে, তা এখনও নিশ্চিত নয়। তবে মানেন্তির স্বপ্ন স্পষ্ট—ভারতের মাটিতে ভারতের বিপক্ষে মাঠে নামা।
‘ভারতের বিপক্ষে খেলাটা স্বপ্ন। পুরো গ্যালারি ভর্তি থাকবে, আবহটা হবে অন্যরকম। যেহেতু আমি অস্ট্রেলিয়ায় বড় হয়েছি, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও খেলতে চাই। এমন কিছু ক্রিকেটার আছে, যারা আমার ক্লাব সতীর্থ ছিল। তাদের বিপক্ষে বিশ্বকাপে খেলাটা হবে দারুণ অভিজ্ঞতা।’
বড় কোনো পেশাদার ভিত্তি নেই, নেই বিশাল বাজেট। তবুও স্বপ্ন দেখছে ইতালি—বিশ্বকাপে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হয়ে ইতিহাস লিখতে। হারি মানেন্তির ভাষায়— ‘এই বিশ্বকাপে খেলা শুধু আমাদের নয়, পুরো ইতালির ক্রিকেট ইতিহাসের জন্য একটি বিপ্লব।’
মন্তব্য করুন