দলবদলের নাটক শুধু আমাদের দেশেই নয়, হরহামেশাই ঘটছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। বিতর্কিত এসব দলবদল ফুটবলে বিশ্বস্ততা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও খেলাধুলার গতিশীলতার ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। চলছে ইউরোপিয়ান ফুটবলের দলবদল। এরই মধ্যে নানা নাটকীয়তার পর ফ্রান্স তারকা কিলিয়ান এমবাপ্পেকে দলে ভিড়িয়ে চমক দেখায় রিয়াল মাদ্রিদ। শেষ অঙ্কে কী আছে, জানা যাবে ট্রান্সফার উইন্ডোর দরজা বন্ধ হলেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেখা যায় নতুন বিতর্ক—ফ্রি ট্রান্সফার। পরের মৌসুমে দল সাজানোর চেষ্টায় থাকে ক্লাবগুলো। তবে চুক্তি সইয়ের আগে কে কোথায় যোগ দেবেন, কেউ বলতে পারে না। ফুটবলে এমন কিছু দলবদল আছে যেগুলো বিভিন্ন কারণে কুখ্যাত আর নীতিবহির্ভূত বলে বিবেচিত হয়।
১. লুইস ফিগো (বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদ, ২০০০)
বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম ‘বিতর্কিত’ দলবদলে পর্তুগিজ সুপারস্টার লুইস ফিগোর নাম শীর্ষে। তার একটি দলবদলে নাড়িয়ে দেয় ফুটবল কাঠামো। নীতি পরিবর্তনে বাধ্য হয় অনেক ক্লাব। বার্সাকে লা লিগা চ্যাম্পিয়ন করানোর পরই ঘোষণা দেন, মূল্যায়ন না পাওয়ায় তিনি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদে নাম লেখাবেন। ফিগোর এই দলবদলের ঘোষণা বজ্রপাতের মতো বিঁধে বার্সা সমর্থকদের হৃদয়ে। পরে জানা যায়, আগেই চুক্তি সেরে ফেলেন লুইস ফিগো। পুরো বিশ্বে আলোড়ন তোলা এই দলবদলে বদলে যায় ক্লাবগুলোর অনেক হিসাব-নিকাশ। রিয়ালে যোগ দেওয়ার পর প্রথম ন্যু ক্যাম্প সফরে বার্সার বিক্ষুব্ধ সমর্থকদের কাছ থেকে শূকরের একটি কাটা মাথা উপহার পান ফিগো।
২. ইয়োহান ক্রুয়েফ (আয়াক্স-বার্সেলোনা, ১৯৭৩)
সত্তর-আশির দশকে বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ইয়োহান ক্রুয়েফ ‘টোটাল ফুটবলে’র মাধ্যমে ফুটবলে বিপ্লব আনেন। ১৯৬৪ সালে আয়াক্সের সিনিয়র দলে প্রমোশন পান। আয়াক্সকে নিয়ে যান বিশ্বসেরা কাতারে। তখন এক দশকের বেশি সময় শিরোপাহীন ছিল বার্সেলোনা। শৈশবের ক্লাব ছেড়ে বিতর্কিতভাবে ক্রুয়েফ যোগ দেন বার্সায়। হতভম্ব আয়াক্স সমর্থকরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। যোগ দিয়েই খোলনলচে পাল্টে দেন নতুন ক্লাব বার্সাকে। সাফল্যের রঙে রাঙিয়ে বার্সার হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনেন, আর হয়ে ওঠেন ক্লাবের কিংবদন্তি। বার্সার যে আকাশ-পাতাল পরিবর্তন—তা ক্রুয়েফেরই কৃতিত্ব।
৩. ইব্রাহিমোভিচ (ইন্টার মিলান-বার্সেলোনা, ২০০৯) স্যামুয়েল ইতোর বদলে ক্ষুরধার স্ট্রাইকার প্রয়োজন কাতালানদের। সুইডিশ স্ট্রাইকার ইব্রাহিমোভিচ তখন সুপার ফর্মে। নানা উদ্ভট কাণ্ডকারখানায় সমালোচনা সত্ত্বেও বার্সা অফিসিয়ালরা ইন্টার মিলানের হয়ে মাঠ মাতানো ইব্রাকে দলে চাইলেন। দুপক্ষে গোপনে চুক্তি হয়। এই দলবদলে খবরে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তবে বিতর্ক কখনোই পিছু ছাড়েনি পাগলাটে ইব্রার। উদ্ধত স্বভাব, অহংবোধ ও বেখেয়ালিপনার কারণে সময়ের অন্যতম সেরা হয়েও থিতু হতে পারেননি কোথাও। বিবাদের কারণে পরের বছরই তাকে লোনে পাঠানো হয় এসি মিলানে। বারবার ক্লাব বদলের কারণে বরাবরই সবার অপছন্দের পাত্র সুইডিশ এই স্ট্রাইকার।
৪. ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো (ম্যানইউ-রিয়াল, ২০০৯) রিয়াল মাদ্রিদ বরাবরই দলবদলে চমক দেখায়। এক মহানাটক হয় ফুটবলের অন্যতম মহানায়ক পর্তুগিজ ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে ঘিরে। সুপার ফর্মে থাকা রোনালদো তখনো মহাতারকা হয়ে ওঠেননি। ২০০৭ থেকেই রোনালদোকে চাইছিল রিয়াল। তাদের সেই চাওয়া বারবার আটকে যায় ফার্গুসনের অনিচ্ছায়। তবে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে বার্সার কাছে হারের পর ফার্গির কৌশল নিয়ে সমালোচনা এবং ম্যাচে মাঠ থেকে তুলে নেওয়ায় প্রকাশ্যে বিরক্তি দেখান সিআর সেভেন। এতে ফার্গিও নাখোশ হন। সেই সুযোগ নেন রিয়াল প্রেসিডেন্ট পেরেজ। শেষমেশ দেনদরবারের পর ওই সময়ের রেকর্ড অর্থে বার্নাব্যুতে নাম লেখান পর্তুগিজ তারকা। রিয়ালে যোগ দিয়ে নিজেকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়।
৫. ডেভিড বেকহাম (ম্যানইউ-রিয়াল মাদ্রিদ, ২০০৪) ইংলিশ ফুটবলের তৎকালীন ‘পোস্টারবয়’ ডেভিড বেকহাম। তার জাদুকরী ফ্রিকিক ও নিখুঁত ক্রস প্রতিপক্ষকে বোকা বানাতো হরহামেশা। ম্যানইউতে ২৫৬ ম্যাচ খেলার পর গোল বাধে ২০০৩ সালে। ফর্মে থাকার পরও বেশ কিছু ম্যাচে বেকহামকে বেঞ্চে বসিয়ে রাখা হয়। মনক্ষুণ্ন হয়ে মৌসুম শেষে ছুটি কাটাতে যুক্তরাষ্ট্র যান। ওই সময় টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে রীতিমতো বজ্রপাত চারদিকে। বার্সেলোনা নাকি কিনতে চাচ্ছে তাকে—এতেই তোলপাড়। পরদিনই ম্যানচেস্টারে ফিরে দেখা পাননি ফার্গুসনের। বাধ্য হয়ে এজেন্ট মারফত বেকহাম জানান, তিনি বার্সায় যাবেন না, যাবেন রিয়ালে। সপ্তাহ পর রিয়ালে নাম লিখিয়ে ‘গ্যালাকটিকো’ পূর্ণ করেন বেকহাম।
৬. কার্লোস তেভেজ (ওয়েস্টহাম-ম্যানইউ-ম্যানসিটি, ২০০৭-২০০৯) কার্লোস তেভেস আর্জেন্টিনা থেকে উঠে আসা উদীয়মান খেলোয়াড়দের অন্যতম। পারফরম্যান্সে উজ্জ্বল থাকলেও উদ্ধত আচরণ আর অহংবোধের কারণে তিনি কোথাও থিতু হতে পারেননি। ক্যারিয়ারের শুরুতে যোগ দেন চিরশত্রু ব্রাজিলের করিন্থিয়াসে। ২০০৬ সালে ওয়েস্টহামে নাম লিখিয়ে শুরু হয় ইউরোপের অধ্যায়। ওয়েস্টহাম পরের মৌসুমে ম্যানইউতে লোনে পাঠায় তেভেজকে। তেভেজের শর্ত ছিল, মৌসুম শেষে ম্যানইউ তাকে কিনে নিতে হবে। উগ্র ব্যবহারের কারণে দুই বছর মাঠের চেয়ে ম্যানইউর বেঞ্চেই বেশি জায়গা হয় তার। অ্যালেক্স ফার্গুসনও ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ওঠেন। তেভেজের তাগাদার পরও ম্যানইউ কর্তৃপক্ষ শর্ত দেয়, আরেক মৌসুম লোনে থাকতে হবে। বেঁকে বসেন তেভেজ। মরিয়া হয়ে ওঠেন দল বদলাতে। নানা নাটকের পর ম্যানসিটিতে নাম লেখান।
৭. রবার্তো ব্যাজ্জিও (ফিওরেন্তিনা-জুভেন্তাস, ১৯৯০) ১৯৯০ সালে তৎকালীন রেকর্ড ১৯ মিলিয়ন ডলারে ফিওরেন্তিনা সুপারস্টার রবার্তো ব্যাজ্জিওকে জুভেন্তাসের কাছে বেচে দেয়। মেনে নিতে পারেননি ‘ভিওলা’ সমর্থকরা। হাজারো সমর্থক ফ্লোরেন্সের রাস্তায় জড়ো হয়ে ক্ষোভ জানান। সে সময় দাঙ্গায় অর্ধশতাধিক আহত হন। এই দলবদলের রেশ থাকে দীর্ঘদিন। দুই মৌসুম পর প্রথমবারের মুখোমুখিতে সাবেক ক্লাবের বিপক্ষে পেনাল্টি নিতে অনীহা দেখান ব্যাজ্জিও। হেরে যায় দল। ম্যাচ শেষে ‘হৃদয়ে এখনো বেগুনি’ স্কার্ফ ফিওরেন্তিনার দর্শকদের দিকে তুলে ধরে বিতর্ক আরও উসকে দেন।
৮. অ্যাশলে কোল (আর্সেনাল-চেলসি, ২০০৫) চুক্তিবদ্ধ থাকা অবস্থায় ক্লাবকে না জানিয়ে ট্রান্সফার বিষয়ক আলোচনা করা ফুটবলার বা কোচদের জন্য একরকম মহাঅন্যায়। ২০০৬ সালে সেই ‘গর্হিত’ কাজটি করেন চেলসি কোচ হোসে মরিনহো ও আর্সেনাল ফুটবলার অ্যাশলে কোল। ক্লাবকে না জানিয়ে একটি রেস্টুরেন্টে কোলের সঙ্গে গোপনে দেখা করেন মরিনহো। সেই সাক্ষাতের কথা ফাঁস হলে চারদিকে শোরগোল বেধে যায়। প্রিমিয়ার লিগ কর্তৃপক্ষ কোল, মরিনহো ও চেলসিকে জরিমানা করে। পরের বছর অবশ্য বৈধভাবেই উত্তর লন্ডনের আর্সেনাল ছেড়ে চেলসিতে যান অ্যাশলে কোল। সেই দলবদলকে তীর্যক চোখে দেখা হয়।
৯. আন্দ্রে পিরলো (মিলান-জুভেন্তাস, ২০১১) ‘এল আর্কিতেত্তো’—অর্থ নির্মাতা। বল নিয়ন্ত্রণ, অবিশ্বাস্য পজেশনজ্ঞান ও সৃজনশীলতায় আর্কিতেত্তোই আন্দ্রে পিরলো। বিশ্বব্যাপী চাহিদা থাকলেও তিনি কখনো ইতালি ছেড়ে যাননি। ২০০১ সালে বিতর্কিতভাবে ইন্টার থেকে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী এসি মিলানে নাম লেখান। সমালোচনা সত্ত্বেও নতুন দলে দুর্দান্ত ফুটবলশৈলী উপহার দেন পিরলো। ২০১১ সালে বয়স ও পড়ন্ত ফর্মের ধুয়া তুলে মিলান কর্তারা পিরলোর পারফর্ম করার ক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান হন। সিদ্ধান্ত হয় চুক্তি পুনর্নবীকরণ না করার। আর এ সুযোগে জুভেন্তাস দলে ভেড়ায় তাকে। আর জুভেন্তাসের পুনরুত্থানের মূল কারিগর হয়ে ওঠেন আন্দ্রে পিরলো।
১০. রবিনহো (রিয়াল-ম্যানসিটি, ২০০৮) ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার রবিনহো সান্তোস থেকে রিয়াল মাদ্রিদে নাম লেখান। মহাতারকাদের ভিড়ে পর্যাপ্ত সুযোগ না পেয়ে দুই মৌসুম পর সিদ্ধান্ত নেন চেলসিতে যাওয়ার। চেলসিতে যাওয়ার প্রস্তুতির মধ্যেই ঘটে বিস্ফোরণ। ক্লাব তাকে বেচে দেয় ম্যানচেস্টার সিটিতে। গ্রীষ্মকালীন দলবদল উইন্ডোর শেষ দিন সুরাহা হয় বিষয়টি। ৩৩ মিলিয়ন পাউন্ডে যোগ দেন ম্যানসিটিতে। ম্যানসিটি যে আশা নিয়ে রবিনহোকে দলভুক্ত করে, তাদের সেই আশায় গুড়েবালি। ব্রাজিলিয়ান তারকা সেভাবে কিছুই দিতে পারেননি দলকে।
মন্তব্য করুন