কাতার বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে পৌঁছে ইতিহাস লিখেছিল মরক্কো। আফ্রিকান ফুটবলে তাদের উত্থান তখনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেটি যে একদিনের কাকতালীয় সাফল্য ছিল না, তার প্রমাণ এখন মিলছে প্রতিটি স্তরে। আফ্রিকান কাপ অব নেশন্স জয়ের পর এবার অনূর্ধ্ব–২০ বিশ্বকাপের ফাইনালে শক্তিশালী আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে মরক্কো দেখিয়ে দিয়েছে—তারা কেবল একটি দল নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ ফুটবল কাঠামোর নাম, যেটি পরিকল্পনা, বিনিয়োগ ও দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গির ফল।
রোববার রাতের (বাংলাদেশ সময় সোমবার ভোর) অনূর্ধ্ব–২০ বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে নাকানিচুবানি খাইয়ে ২-০ গোলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আফ্রিকার এই নবজাগরণশীল দল। তবে এই সাফল্য কিন্তু একদিনে আসেনি, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গড়ে ওঠা এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে সংগঠিত বিনিয়োগ, আধুনিক অবকাঠামো ও শিক্ষাভিত্তিক ক্রীড়া সংস্কৃতি। কিন্তু কিভাবে এল এই পরিবর্তন?
মোহাম্মদ ষষ্ঠ একাডেমি: পরিবর্তনের সূচনা
সবকিছুর শুরু ২০০৯ সালে, রাজধানী রাবাতের উপকণ্ঠে উদ্বোধন হয় মোহাম্মদ ষষ্ঠ একাডেমি—যা শুধু ফুটবল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নয়, বরং এক পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাব্যবস্থা। এখানে তরুণরা শিখে কৌশল, ট্যাকটিকস, পাশাপাশি নিয়মিত শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা পায় ইউরোপীয় মানে। এখান থেকেই উঠে এসেছেন ইউসুফ এন-নেসিরি ও নায়েফ আগুয়েরদের মতো ইউরোপের আলোচিত ফুটবলাররা।
এই একাডেমিকে ঘিরেই মরক্কো শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে ফুটবল বিকেন্দ্রীকরণ। বিভিন্ন শহরে প্রতিষ্ঠা করা হয় আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, যাতে দেশের প্রান্তিক তরুণরাও সুযোগ পায় পেশাদার ফুটবলে প্রবেশের।
ফেডারেশনের নতুন দৃষ্টি ও পেশাদার ক্লাব কাঠামো
মরক্কো ফুটবল ফেডারেশন (FRMF) বুঝেছিল, প্রতিভা যথেষ্ট নয়—প্রয়োজন পেশাদার ব্যবস্থাপনা। তাই ক্লাবগুলোতে আনা হয় আর্থিক স্বচ্ছতা, আধুনিক স্টেডিয়াম, উন্নত প্রশিক্ষণ সুবিধা এবং কোচিং কাঠামো। একই সঙ্গে জাতীয় দলের বিভিন্ন বয়সভিত্তিক বিভাগে তৈরি হয় সমন্বিত পরিকল্পনা—যাতে একক দর্শনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে ভবিষ্যতের খেলোয়াড়রা।
ফলাফল: সাফল্যের ধারাবাহিকতা
এই পরিকল্পনার ফল দেখা যায় দ্রুতই। অনূর্ধ্ব–১৭ দল আফ্রিকার চ্যাম্পিয়ন হয়, অনূর্ধ্ব–২০ দল নিয়মিত লড়াই করে ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার শক্তিশালী দলগুলোর সঙ্গে সমানে সমান। শারীরিকভাবে শক্তিশালী, কৌশলগতভাবে পরিপক্ব এবং মানসিকভাবে দৃঢ়—মরক্কোর ফুটবলাররা হয়ে ওঠেন নতুন প্রজন্মের প্রতীক।
চূড়ান্ত সাফল্য আসে কাতার বিশ্বকাপ ২০২২–এ—যেখানে মরক্কো প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে পৌঁছে সেমিফাইনালে। সেটিই ছিল আফ্রিকান ফুটবলের এক ঐতিহাসিক রাত।
এর পরের বছরগুলোতেও গতি কমেনি। ২০২৪ প্যারিস অলিম্পিকে তারা জেতে ব্রোঞ্জ পদক, আফ্রিকান কাপ অব নেশন্সের শিরোপাও উঠে আসে তাদের হাতে। এরপর আজ আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া।
নারী ফুটবলেও শুরু হয়েছে একই ধরনের বিপ্লব—যেখানে নতুন প্রজন্মের মেয়েরা পাচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ ও সুযোগ।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার জয়গান
আজ মরক্কো শুধু আফ্রিকার নয়, বিশ্ব ফুটবলের উন্নয়ন মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তাদের সাফল্য প্রমাণ করছে—যেখানে স্বপ্নের সঙ্গে মিলে যায় শিক্ষা, সংগঠন আর দৃষ্টিভঙ্গি, সেখানেই জন্ম নেয় সত্যিকারের ফুটবল বিপ্লব।
মন্তব্য করুন