চীনে ৩০ জন খ্রিস্টানকে গ্রেপ্তার করেছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী, যা নিয়ে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। মানবাধিকার কর্মীরা আশঙ্কা করছেন, এটি হতে পারে আরও বৃহত্তর দমন অভিযানের সূচনা।
চীনা পুলিশ অভিযানে যাদের গ্রেপ্তার করেছে, তারা মূলত স্বাধীনভাবে পরিচালিত গির্জার সদস্য— যেসব গির্জা সরকার অনুমোদিত নয় এবং রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ‘থ্রি-সেল্ফ চার্চ’ ব্যবস্থার বাইরে পরিচালিত হয়।
অধিকারকর্মীদের ভাষায় এটি চীনে গত কয়েক দশকের মধ্যে খ্রিস্টানদের ওপর সবচেয়ে বড় ধরপাকড় অভিযান। গত সপ্তাহান্তে অন্তত ৩০ জন খ্রিস্টান, যারা ‘জায়ন চার্চ’–এর সঙ্গে যুক্ত, তাদের আটক করা হয়। এই চার্চের প্রতিষ্ঠাতা জিন মিংরি।
অনেকেই আশঙ্কা করছেন, এর মাধ্যমে চীনে অনিবন্ধিত গির্জাগুলোর বিরুদ্ধে আরও বড় অভিযানের সূচনা হতে পারে।
চীন যদিও একটি নাস্তিক রাষ্ট্র, তবে সরকারি হিসাবে দেশটিতে এখন প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ (৩৮ মিলিয়ন) প্রোটেস্ট্যান্ট ও ৬০ লাখ (৬ মিলিয়ন) ক্যাথলিক খ্রিস্টান রয়েছেন। তবে এসব পরিসংখ্যান কেবল রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত চার্চগুলোর অনুসারীদেরই অন্তর্ভুক্ত করে, যেমন থ্রি-সেলফ প্যাট্রিয়টিক মুভমেন্ট ও ক্যাথলিক প্যাট্রিয়টিক অ্যাসোসিয়েশন, যারা রাষ্ট্র ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আনুগত্যে জোর দেয়।
অধিকারকর্মীদের ধারণা, এই হিসাবের বাইরে বহু চীনা নাগরিক নিবন্ধনবিহীন ‘হাউস চার্চ’ বা অনিবন্ধিত গির্জায় ধর্মচর্চা করেন—যা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
বিগত বছরগুলোয় এসব গির্জা ক্রমাগত সরকারি দমননীতি ও সেন্সরশিপের মুখে পড়েছে। বহু গির্জা ভেঙে ফেলা হয়েছে। অনেক ভবন থেকে ক্রস অপসারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি বহু ধর্মীয় গ্রন্থ ও খ্রিস্টান অ্যাপ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ধর্মের চীনাকরণের ডাক দেন। এর ফলে ২০১৮ সালের সংশোধিত ধর্মীয় আইন অনুযায়ী সরকারি অনুমতি ছাড়া প্রকাশ্যে উপাসনা নিষিদ্ধ হয়। এই নিয়মের পর থেকেই জায়ন চার্চসহ অনেক গির্জা বন্ধ হয়ে যায়। কেউ কেউ অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন কার্যক্রম চালু করে, আবার কেউ পুরোপুরি থেমে যায়।
গত মে মাসে ‘অন্ধবিশ্বাসের মাধ্যমে আইন ব্যাহত করার’ অভিযোগে ‘লাইট অব জায়ন’ চার্চের পাদরি গাও কোয়ানফুকে আটক করা হয়। জুনে শানশির লিনফেন গোল্ডেন ল্যাম্পস্ট্যান্ড চার্চের কয়েকজন সদস্যকে ‘প্রতারণা’র অভিযোগে কারাদণ্ড দেওয়া হয়, যা মানবাধিকার সংগঠনগুলো ‘মিথ্যা অভিযোগ’ বলে দাবি করেছে।
সেপ্টেম্বরে সরকার নতুন অনলাইন আচরণবিধি জারি করে, যেখানে বলা হয়—শুধু লাইসেন্সপ্রাপ্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানই অনলাইনে ধর্মীয় বক্তৃতা দিতে পারবেন। এটি আন্ডারগ্রাউন্ড চার্চগুলোর অনলাইন কার্যক্রম বন্ধ করার আরেকটি কৌশল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
গত শুক্রবার ও শনিবার চীনা পুলিশ বেইজিং ও সাংহাইসহ অন্তত ১০টি শহরে অভিযান চালায়। গুয়াংশি প্রদেশের বেইহাই শহর থেকে জিন মিংরিকে গ্রেপ্তার করা হয়। চার্চের দাবি, অন্যান্য পাদরি, নেতা ও সদস্যরাও আটক হয়েছেন।
বিবিসি বেইহাইয়ের জননিরাপত্তা ব্যুরো কর্তৃক জারি করা একটি আনুষ্ঠানিক আটক নোটিশ পেয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, জিন মিংরি ‘তথ্য নেটওয়ার্কের অবৈধ ব্যবহার সন্দেহে কারাগারে আটক রয়েছেন। কিছু চার্চ সদস্য পরে মুক্তি পেলেও, বেশির ভাগই এখনো হেফাজতে, অনেকে জিন মিংরির সঙ্গেই একই কারাগারে আছেন।
খ্রিস্টান অধিকার সংস্থা লুক অ্যালায়েন্সের প্রতিষ্ঠাতা কোরি জ্যাকসন বলেছেন, এই অভিযান চীনজুড়ে সমন্বিতভাবে পরিচালিত হয়েছে। এর আগে এমন নজির ছিল না। আমরা আশঙ্কা করছি, এটি একটি বৃহত্তর দমন অভিযানের সূচনা।
আরেক সংস্থা ওপেন ডোর্স বলেছে, জায়ন চার্চ খুবই প্রভাবশালী ও খোলামেলা ছিল, যা কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণহীন সংগঠনগুলোর প্রতি ভীতি তৈরি করেছে।
তাদের মতে, চীন এখন ‘হাউস চার্চে’র বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখবে এবং মিথ্যা অর্থনৈতিক অপরাধের অভিযোগে ভয় দেখানো অব্যাহত থাকতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত পাদরি ও জায়ন চার্চের মুখপাত্র শন লং বলেন, এটি একটি পরিকল্পিত অভিযান ও জায়ন চার্চকে সম্পূর্ণভাবে উপড়ে ফেলার চেষ্টা।
চীনা প্রবাদ উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ওরা মুরগি মেরে বানরকে ভয় দেখাচ্ছে। জায়ন হলো সেই মুরগি, কারণ আমরা সবচেয়ে প্রভাবশালী।
জিন মিংরির জীবনের গল্পই চীনা খ্রিস্টান আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ১৯৬৯ সালে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় হেইলংজিয়াং প্রদেশে জন্ম নেওয়া জিন, শৈশবে রাষ্ট্রীয় আদর্শেই বড় হন।
কিন্তু ১৯৮৯ সালের তিয়ানআনমেন আন্দোলনের অভিজ্ঞতা তার জীবন বদলে দেয়। তিনি বলেন, ‘সেটি ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। রাষ্ট্রের প্রতি আমার বিশ্বাস ভেঙে পড়েছিল, আর তখনই আমি যিশুর পথে আসি।’
২০০২ সালে তিনি পরিবার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান, ক্যালিফোর্নিয়ায় ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন করেন, এরপর ২০০৭ সালে ফিরে এসে রাষ্ট্রনির্ভর চার্চের পরিবর্তে স্বাধীন জায়ন চার্চ প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রথমে ছোট একটি বাড়িতে মাত্র ২০ জন সদস্য নিয়ে শুরু হয় গির্জাটি। পরে সেটি বেইজিংয়ের একটি বড় অফিস ভবনে স্থান নেয় এবং দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। পরে ২০১৮ সালে কর্তৃপক্ষ সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর নির্দেশ দিলে তারা অস্বীকার করে। এরপর গির্জাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়, জিনের ওপর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। তার পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায়।
তবে জায়ন চার্চ থামেনি। অনলাইন ও ছোট ছোট গোপন সভার মাধ্যমে এটি চীনের ৪০টি শহরে ১০০ শাখায় বিস্তৃত হয়। তাদের প্রায় ১০ হাজার অনুসারী রয়েছে।
শন লং বলেন, ‘নিপীড়ন গির্জাকে ধ্বংস করতে পারে না। ইতিহাস বলছে, যেখানে দমন আছে, সেখানেই নবজাগরণ হয়।’
মন্তব্য করুন