ক্রমেই বিশ্বশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে চীন। প্রতিনিয়ত নিজেকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ও সামরিকভাবে শক্তিশালী করে চলছে দেশটি। মাত্র কয়েক দশক আগেও সামরিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে এত শক্তিশালী ছিল না বেইজিং। বিপুল ভূ-সম্পদ এবং বিশাল সামুদ্রিক সীমানার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও চীন অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেকটা পিছিয়ে ছিল। দেশটির বিস্ময়কর উত্থানের পেছনে যার রয়েছে বড় অবদান, তিনি দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। বিখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিনের তালিকা অনুযায়ী তিনি বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি।
চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে ১৯৫৩ সালের ১৫ জুন জন্মগ্রহণ করেন শি জিন পিং। বাবা শি ঝংশান ও মা শি জেন দুজনেই ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য। তিন ভাই-বোনের মধ্য জিন পিং সবার ছোট। শিশু জিন পিংয়ের প্রথম বিদ্যালয় ২৫নং বেইজিং স্কুল। এরপর ১৯৬০ সালে বেইজিংয়ের বেয়ি স্কুলে ভর্তি হন তিনি। সেখানে লিউ হে’র সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় তার। পরে যিনি জিন পিংয়ের উপদেষ্টা এবং চীনের উপপ্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
জিন পিংয়ের বাবা শি ঝংশান চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তবে তিনি কয়েকবার দল ও সরকারের বিরাগভাজন হন। প্রথমবার কালচারাল বিপ্লবের সময়, দ্বিতীয়বার ১৯৮৯ সালে তিয়েনআনমেন স্কয়ারে শিক্ষার্থী ও বিক্ষোভকারীদের দমনে চীনা সরকারের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে।
জিন পিংয়ের বয়স যখন ১০ বছর তখন দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে তার বাবাকে হেনানের একটি কারখানায় কাজ করতে পাঠানো হয়। ১৯৬৬ সালে চীনে শুরু হয় কালচারাল বিপ্লব। বিপ্লবীরা জিনপিংয়ের বাড়িতে হানা দেয়। বাবা ঝংশান বিপ্লবের বিরোধিতা করায় এর পরিণতি ভোগ করতে হয় তার পরিবারকে। বিপ্লবীরা তার মা শি জেনকে এটা ঘোষণা করতে বাধ্য করান যে, তার বাবা একজন দেশদ্রোহী। চাপে পড়ে তার মা তা ঘোষণাও করেন। পরে জেলে পাঠানো হয় তার বাবাকে। ১৯৬৮ সালে বাবা যখন কারাগারে, তখন জিন পিংকে ইয়ানচুয়ান কাউন্টির একটি গ্রামে পাঠানো হয়।
প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল ইয়ানচুয়ানে গিয়ে স্থানীয় কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে মিশে যান জিনপিং। একসময় বেইজিংয়ের অভিজাত পরিবারের সন্তানটির এমন গুণ মুগ্ধ করে স্থানীয়দের। তারা জিন পিংকে নিজেদেরই একজন ভাবতে শুরু করেন। এ জন্যই জিন পিংয়ের প্রতি চীনের কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির ব্যাপক সমর্থন লক্ষ্য করা যায়। ইয়ানচুয়ানে গিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির স্থানীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন জিনপিং। ফল স্বরূপ কাউন্টির সাধারণ সম্পাদক হন তিনি। সেখান থেকেই বাস্তব রাজনীতির হাতেখড়ি হয় তার।
ইয়ানচুয়ান কাউন্টিতে দীর্ঘ সাত বছর অবস্থানের পর বেইজিংয়ে ফিরে আসেন জিন পিং। এসে ১৯৭৫-৭৯ সাল পর্যন্ত শিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিক্যাল ইঞ্জিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। পড়াশোনার পাশাপাশি সমানতালে রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন জিন পিং। ওই সময় কার্ল মাক্স, লেনিন ও মাও সেতুংয়ের রাষ্ট্র চিন্তা ও জীবন দর্শনের সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত হন।
১৯৮২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির ঝেংডিং কাউন্টির সহসাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় জিন পিংকে। পরের বছর সহসাধারণ সম্পাদক থেকে সাধারণ সম্পাদক পদে উন্নীত হন তিনি। ১৯৮৭ সালে চীনের জনপ্রিয় ফোকশিল্পী পেং লিয়ানককে বিয়ে করেন জিন পিং। ওই ঘরে তাদের একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। তবে তার সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। প্রেসিডেন্ট জিন পিং ২০০৮ সালে চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জিন পিং।
এর মাত্র চার বছর পর অর্থাৎ ২০১২ সালে দেশটির ক্ষমতাসীন কামিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। পরের বছর ২০১৩ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রেসিডেন্টে নির্বাচিত হন শি জিন পিং।
প্রথম মেয়াদে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের পর দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৮ সালে আবারও প্রেসিডেন্ট হন জিন পিং। ওই বছরই দেশটির জাতীয় কংগ্রেস সংবিধান সংশোধন করে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টের মেয়াদকাল আজীবন করেন।
ক্ষমতায় এসে প্রথমেই দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করেন জিন পিং। শত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও কঠোর অবস্থান থেকে এক চুলও নড়েননি তিনি। ২০১৩ সালে শুরু করা ওই অভিযানে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিকে শাস্তির আওতায় আনেন তিনি।
এই অভিযানের মধ্য দিয়ে জিন পিং পার্টির অভ্যন্তরে যাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভাবতেন, তাদেরও শাস্তির আওয়াতায় এনেছেন, এমন অভিযোগ থাকলেও কঠোর এই অভিযান তিনি দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে পেরেছিলেন। এর প্রতিদানও পান তিনি।
২০১৬ সালে জিন পিংকে চীনের ‘সর্বোচ্চ নেতা’ ঘোষণা করে তার দল চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি। পার্টির ইতিহাসে মাত্র তিনজন ব্যক্তি এই উপাধি লাভ করেন। তারা হলেন—মাও সেতুং, দেং জিয়াওপিং ও জিয়াং জে মিন। এ ছাড়া শি জিনপিং মাও সে তুংয়ের পর দ্বিতীয় নেতা, যার আদর্শ ও চিন্তাধারা জীবিত অবস্থায়ই চীনের সংবিধানে লেখা হয়েছে।
চীনা জনগণের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকলেও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নানা কারণেই বিতর্কিত শি জিন পিং। জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিমদের ওপর গণহত্যা ও তাদের বন্দিশিবিরে আটকে রেখে জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য করানোর অভিযোগ রয়েছে জিন পিং প্রশাসনের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে অস্বাভাবিক ঋণ দিয়ে সে দেশের অভ্যন্তীরণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ ও ঋণের ফাঁদে ফেলারও অভিযোগ রয়েছে।
এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অসম বাণিজ্যযুদ্ধ, সমগ্র দক্ষিণ চীন সাগরকে নিজেদের দবি করে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বৈরিতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ, স্বাধীন মতপ্রকাশে প্রতিবন্ধকতা এবং সংবাদমাধ্যমের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সমালোচিত চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং।
মন্তব্য করুন