ইসরায়েলের সঙ্গে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চলা যুদ্ধের সময় গোপন আস্তানায় আশ্রয় নিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। যুদ্ধে শেষ হলেও এখনো প্রকাশ্যে আসেননি তিনি। দীর্ঘ এ যুদ্ধে দেশটির পরিবেশ অনেকটাই বদলে গেছে। ফলে প্রকাশ্যে এসেই দেশের পরিস্থিতি দেখে বড় ধাক্কা খাবেন খামেনি।
বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খামেনি যখন প্রকাশ্যে আসবেন, তিনি একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন দেশ দেখতে পাবেন। তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত, ক্ষতবিক্ষত এবং গভীরভাবে ক্ষুব্ধ এক ইরান দেখবেন।
৮৬ বছর বয়সী খামেনি যুদ্ধের সময় প্রাণনাশের ভয়ে গোপন বাঙ্কারে আশ্রয় নেন। সেখানে সকল ধরনের ইলেক্ট্রনিক যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছেন তিনি। এমনকি শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তারাও তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কাতারের আমিরের মধ্যস্থতায় ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়েছে। তবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু খামেনিকে হত্যার সম্ভাবনা পুরোপুরি নাকচ করেননি।
যখন তিনি প্রকাশ্যে আসনে তখন মৃত্যু ও ধ্বংসের একটি দৃশ্য দেখতে পাবেন। তিনি সম্ভবত রাষ্ট্রীয় টিভিতে দাবি করবেন যে তিনি এই সংঘাতে বিজয়ী হয়েছেন। তবে, তিনি নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হবেন।
যুদ্ধের পর ইরানের অবস্থা যুদ্ধে ইরানের সামরিক অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) অনেক শীর্ষ কমান্ডার নিহত হয়েছেন। এছাড়া ইরানের বেশিরভাগ পারমাণবিক স্থাপনাও বোমাবর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশটির অর্থনীতি বহু বছর ধরে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় ভেঙে পড়েছে। এক সময়ের প্রধান তেল রপ্তানিকারক দেশ এখন দরিদ্র হয়ে গেছে।
অনেক ইরানি আয়াতুল্লাহ খামেনিকে ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সংঘাতের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী করবেন। তারা তাকে ইসরায়েল ধ্বংসের আদর্শিক লক্ষ্য এবং পরমাণু অস্ত্র অর্জনের মাধ্যমে শাসনকে অজেয় করার বিশ্বাসের জন্য দোষারোপ করবেন।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং স্কলার প্রফেসর লিনা খাতিব বলেন, ইরানী শাসন আর কতদিন টিকবে তা অনুমান করা কঠিন, তবে এটি শাসনের শেষের শুরু বলে মনে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, খামেনি সম্ভবত ইসলামী প্রজাতন্ত্রের শেষ ‘সর্বোচ্চ নেতা’ হবেন।
গত দুই সপ্তাহে, ইরানিরা তাদের দেশ রক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং শাসনের প্রতি গভীর ঘৃণার মধ্যেও একতাবদ্ধ থেকেছেন। তারা শাসনের পক্ষে নয়, বরং একে অপরের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। গ্রামে ও শহরের বাইরে মানুষ তাদের ঘর খুলে দিয়েছে, দোকানদাররা সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য বিক্রি করেছে।
অনেক ইরানি মনে করেন, খামেনির আদর্শিক অবস্থান—ইসরায়েল ধ্বংসের নীতিই দেশকে আজ এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে। সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরান অধ্যয়ন কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক আলী আনসারি বলেন, দেশের অভ্যন্তরে বড় ধরনের মতবিরোধ এবং জনগণের অসন্তোষ স্পষ্ট।
প্রফেসর লিনা বলেন, অভ্যন্তরীণ বিরোধিতার মাধ্যমে শাসন উৎখাত হওয়ার সম্ভাবনা কম। শাসন দেশে এখনও শক্তিশালী এবং দমন বাড়াবে। বিবিসি জানিয়েছে, গত দুই সপ্তাহে, ইসরায়েলের জন্য গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ছয়জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং প্রায় ৭০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
একজন ইরানি নারী বিবিসিকে বলেন, তিনি যুদ্ধের ধ্বংসের চেয়ে বিধ্বস্ত ও অপমানিত শাসনের নিজ জনগণের বিরুদ্ধে ক্রোধের ভয় বেশি করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সাইলো পাহাড়ের নিচে সুড়ঙ্গে রাখা হয়েছে। ফলে এ হামলার ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বেঁচে গেছে। ইসরায়েল জানিয়েছে, ইরানের কাছে প্রায় ২ হাজার ৫০০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছিল। এরমধ্যে এখনও প্রায় ১ হাজার ৫০০টি অবশিষ্ট রয়েছে।
ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তারা তাদের উচ্চ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ নিরাপদ স্থানে সরিয়েছে। এই মজুদ থেকে প্রায় নয়টি বোমা তৈরি করা সম্ভব। ইরানের পার্লামেন্ট জাতিসংঘের পারমাণবিক নজরদারি সংস্থা আইএইএর সাথে সহযোগিতা কমানোর পক্ষে ভোট দিয়েছে। দেশটির এ সিদ্ধান্ত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দিকে ঠেলে দিতে পারে।
এছাড়া ইরানি পার্লামেন্ট আইএইএর সঙ্গে সহযোগিতা কমানোর জন্য ভোট দিয়েছে। এছাড়া দেশটির পার্লামেন্টে পারমাণবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি (এনপিটি) থেকেও সরে আসতে প্রস্তাব পাস করছে। ফলে দেশটি শিগগিরই এ চুক্তি থেকে বের হয়ে যেতে পারে।
মন্তব্য করুন