ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি তেহরানে তার নিয়মিত বাসভবনে অবস্থান না করে নিরাপদ বাংকারে অবস্থান করছেন। ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর এমন খবর আগেই এসেছে, যদিও তা ইরান নিশ্চিত করেনি। এরপর মার্কিন ঘাঁটিতে হামলাসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয় ইরান। ঘটে যুদ্ধবিরতিও কিন্তু খামেনির খোঁজ নেই। তেহরানের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও সরকারি কোনো সিদ্ধান্ত, বৈঠক বা প্রটকলে খামেনির নেই।
সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনি এখন কোথায়? ইরানের ক্ষমতার করিডোর এবং তেহরানের রাস্তায় এই প্রশ্নটি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং সামনের রাজনীতির পথ চলা নিয়ে ইরানের অভ্যন্তরীণ মতবিরোধের ওপর একটি বিশেষ প্রতিবেদন করেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ওয়াই-নেট নিউজও সেই সূত্রে খামেনির বর্তমান অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
প্রতিবেদনটি শুরু হয়েছিল ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের একজন উপস্থাপকের করা প্রশ্নের মাধ্যমে। খামেনির সহকারীকে তিনি বলেন, ‘মানুষ সর্বোচ্চ নেতাকে নিয়ে খুব চিন্তিত। আপনি কি আমাদের বলতে পারেন তিনি কেমন আছেন?’ উপস্থাপক উল্লেখ করেন দর্শকরাও এ বিষয়ে শত শত বার্তা পাঠাচ্ছে। তবে, সহকারী মেহদি ফাজায়েলি কোনো স্পষ্ট উত্তর দেননি।
তিনিও অসংখ্য জিজ্ঞাসা পেয়েছেন জানিয়ে ফাজায়েলি বলেন, ‘আমাদের সকলের প্রার্থনা করা উচিত। সর্বোচ্চ নেতাকে রক্ষা করার দায়িত্বে থাকা লোকেরা তাদের কাজ ভালোভাবে করছে। আল্লাহর ইচ্ছায়, আমাদের জনগণ তাদের নেতার সঙ্গে বিজয় উদযাপন করতে পারবে।’
সবশেষ গত ১৮ জুন তার আগে থেকে রেকর্ড করা একটি ভিডিও বার্তা টেলিভিশনে প্রচার হয়েছে। ওই ভাষণে তিনি ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ’ করতে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে আহ্বান জানিয়েছিলেন তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ভিডিওটি ছিল পূর্ব রেকর্ডকৃত।
এরপর ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতির বিষয়টি মঙ্গলবার দেশটির প্রেসিডেন্টসহ সিনিয়র কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছিলেন। কিন্তু এরপরও দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির দিক থেকে বিষয়টি স্বীকার করে প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য আসেনি।
মূলত দেশটির কোনো বিষয়ে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির বক্তব্যই শেষ কথা। তাই যুদ্ধবিরতির বিষয়ে ইরানিদের মধ্যে এখনো শঙ্কা রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবেও নজর দেওয়া হচ্ছে যে, খামেনি এ বিষয়ে কখন কথা বলেন।
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে ঘিরে নেওয়া হয় নজিরবিহীন নিরাপত্তাব্যবস্থা। ইসরায়েলি হামলায় দেশটির সেনাপ্রধানসহ একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিহত হওয়ার পর থেকেই এই অতিরিক্ত সতর্কতা গ্রহণ করা হয়।
খামেনিকে রক্ষা করতে গঠন করা হয় একটি অভিজাত ও অতিসংরক্ষিত নিরাপত্তা ইউনিট- যার অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতেন না এমনকি ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) শীর্ষ কর্মকর্তারাও। তেহরানের সূত্র জানায়, এই ইউনিট এতটাই গোপন যে এর নাম, কাঠামো ও সদস্যদের পরিচয় পুরোপুরি অজানা রাখা হয়েছে।
৮৬ বছর বয়সী খামেনি বর্তমানে তার সব ধরনের ইলেকট্রনিক যোগাযোগ বন্ধ রেখেছেন। শুধু কয়েকজন বিশ্বস্ত সহকারীর সঙ্গেই তার সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ বন্ধের পরও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখায় প্রশ্ন উঠেছে। নিউইয়র্ক টাইমস সূত্রে জানা গেছে, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নে পদক্ষেপ তার অবস্থান গোপন রাখতে নেওয়া হয়েছে, যেন কোনো গোয়েন্দা সংস্থা বা প্রযুক্তির সাহায্যে তাকে ট্র্যাক করা না যায়।
ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইরানের বিভিন্ন প্রশাসনিক ও সামরিক স্তরে অনুপ্রবেশ করেছে বলে তথ্য রয়েছে। এই আশঙ্কা থেকেই খামেনির নিরাপত্তা ইউনিটকে সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়েছে, যাতে কোনোভাবেই তা ভেদ করা না যায়। তবে সবাই আশা করেছিলেন, যুদ্ধ শেষে নিহত শীর্ষ কর্মকর্তাদের জানাজায় তিনি অংশ নেবেন। তাদের জন্য দোয়া অনুষ্ঠানে মোনাজাত করবেন। কিন্তু তা হয়নি। এমনকি প্রেসিডেন্টসহ কোনো কর্মকর্তার সঙ্গেও সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয়নি খামেনির।
এদিকে সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে খামেনির অনুমতি ছাড়া দেশ বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে হামলা বা ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির মতো সিদ্ধান্তের পেছনে তার মতামত ছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। যদি খামেনি তাতে সম্মতি না দেয় তবে কী করে ইরান সিদ্ধান্ত নিচ্ছে? তার উত্তরসূরি বা ভারপ্রাপ্ত কেউ দায়িত্ব পালন করছেন কিনা তা নিয়েও ইরানিদের মধ্যে গুঞ্জন চলছে।
সংঘাতে ইসরাইলের হত্যার হুমকির মধ্যে ছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। বিষয়টি আমলে নিয়ে সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে তিনজন ধর্মীয় নেতাকে মনোনীত করেছেন। আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি তার জীবন ও ইসলামি প্রজাতন্ত্রের নেতৃত্বকাঠামো উভয়কেই রক্ষা করার জন্য এ পদক্ষেপ নিয়েছেন। তবে খামেনির প্রস্তাব করা তিনজনের নাম প্রকাশ করা হয়নি। যুদ্ধ পরবর্তী তাদের বেঁচে থাকা নিয়েও স্পষ্ট কিছু জানা যাচ্ছে না।
অর্থনৈতিক দৈনিক খানেমানের প্রধান সম্পাদক মোহসেন খালিফেহ বলেন, ‘খামেনির অনুপস্থিতি আমাদের সকলকে খুব চিন্তিত করে তুলেছে।’ মোহসেন মাত্র দুই সপ্তাহ আগে খামেনির নিখোঁজ বা নিহত হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। তখন তা কল্পনাতীত বলে মনে করা হতো। কিন্তু মোহসেনও হয়তো এখন সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। তিনি বলেন, ‘যদি খামেনি মারা যান, তাহলে তার জানাজা সবচেয়ে গৌরবময় এবং ঐতিহাসিক হবে।’
মন্তব্য করুন