মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত নতুন বিল ‘ওয়ান, বিগ, বিউটিফুল অ্যাক্ট’-এ থাকা একটি ধারা ইতোমধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়েছে বিশ্বজুড়ে অভিবাসী সমাজে।
বিলটিতে প্রবাসীদের নিজ দেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর ৩.৫ শতাংশ হারে কর আরোপের প্রস্তাব রয়েছে। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বাংলাদেশ ও ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার রেমিট্যান্সনির্ভর দেশগুলো।
বৃহস্পতিবার (৫ জুন) সংবাদমাধ্যম বিবিসি তাদের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
বিশ্লেষকদের মতে, করটি চালু হলে বাংলাদেশ-ভারতের মতো দেশগুলো প্রতিবছর ১২ থেকে ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত হারাতে পারে। এতে শুধু ডলার সরবরাহ সংকুচিতই হবে না, দেশীয় মুদ্রার মানেও পরবে চাপ।
বিশেষ করে, এই অঞ্চলের অর্থনীতি যেহেতু প্রবাসী আয়ের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল, তাই প্রভাব পড়বে সামষ্টিক অর্থনীতির প্রতিটি স্তরে।
২০২৩ সালে ভারতীয় প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন প্রায় ১১৯ বিলিয়ন ডলার, যা ভারতের মোট বাণিজ্য ঘাটতির অর্ধেক পূরণ করেছে এবং সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের চেয়েও বেশি ছিল। এর বড় অংশ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, ভারত ২০০৮ সাল থেকেই রেমিট্যান্স গ্রহণে বিশ্বের শীর্ষে রয়েছে। আরবিআই ধারণা করছে, ২০২৯ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ১৬০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে।
ভারতীয় অভিবাসীদের একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ আয়ের পেশায় যুক্ত- যেমন প্রযুক্তি, ব্যবস্থাপনা ও বিজ্ঞান খাতে। একজন ন্যূনতম বেতনের কর্মীও বছরে প্রায় ২৪ হাজার ডলার উপার্জন করেন, যার একটি অংশ পাঠানো হয় দেশে।
এই অর্থই পরিবারের শিক্ষা, চিকিৎসা, আবাসন ও দৈনন্দিন ব্যয় বহনের মূল উৎস হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষ করে ভারতের কেরালা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ু রাজ্যে।
বিশ্বব্যাংকের প্রধান রেমিট্যান্স অর্থনীতিবিদ ড. দিলীপ রথা বলেন, এই কর মূলত অননুমোদিত অভিবাসী ও কর না-দেয়া প্রবাসীদের লক্ষ্য করে প্রস্তাব করা হয়েছে। যদিও ট্যাক্স ক্রেডিটের সুযোগ রাখার কথা বলা হয়েছে, তবু বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে করদাতাদের মধ্যেও।
তিনি সতর্ক করেন, এই ধরনের করের ফলে হুন্ডি, হাওলা, হাতে নগদ বহন কিংবা ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে অর্থ পাঠানোর প্রবণতা বেড়ে যাবে, যা আর্থিক নিরাপত্তা ও ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিও প্রবাসী আয়ের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। শুধু ২০২৩ সালেই বাংলাদেশে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলার, যার বড় একটি অংশ এসেছে মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে। কর আরোপের ফলে এই প্রবাহ কমে গেলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ, টাকার মানে অবনতি ও দৈনন্দিন পণ্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতি দেখা দিতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এটি হলে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রায়ই বাজারে ডলার ছাড়তে হতে পারে, যার প্রভাব পড়বে আমদানি ব্যয় ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে।
দিল্লিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জিটিআরআই-এর প্রধান অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, রেমিট্যান্স কমে গেলে পরিবারগুলোর ভোগব্যয় ও সঞ্চয় কমে যাবে। মানুষ তখন খাবার, চিকিৎসা ও শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদার দিকেই ব্যয় সীমিত রাখবে। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ, ব্যবসা ও উৎপাদন খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভলপমেন্ট-এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ট্রাম্পের প্রস্তাবিত কর কার্যকর হলে মেক্সিকো প্রতিবছর ২.৬ বিলিয়ন ডলার হারাতে পারে। একইসঙ্গে চীন, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন ও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশও উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
যদিও এখনো বিলটি সিনেট অনুমোদন ও প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষরের অপেক্ষায় রয়েছে, তবে এর প্রভাব নিয়ে ইতোমধ্যেই বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ ছড়িয়েছে। প্রবাসী নির্ভর অর্থনীতিগুলো এখন থেকেই ঝুঁকি মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেমিট্যান্স কর বাস্তবায়িত হলে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, সামাজিকভাবেও বড় ধরনের চাপ তৈরি হতে পারে অভিবাসী পরিবারগুলোতে। তাই এখনই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে কর প্রস্তাবটি পুনর্বিবেচনার দাবি উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে।
মন্তব্য করুন