গত দুই দশকে বদলে গেছে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার চালচিত্র। বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসেছে গুণগত পরিবর্তন। উন্নত বিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে হয়েছে আধুনিকীকরণ। পরিবর্তন এসেছে শিখন-পঠন পদ্ধতিতে।
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় গত দুই দশকে যে অগ্রগতি ঘটেছে, তার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। ২০০১ সালে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। গত দুই যুগে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান তৈরি করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
শিক্ষার মান, গবেষণায় উৎকর্ষ, আন্তর্জাতিক সংযোগ এবং পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো- সবকিছু মিলিয়ে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি হয়ে উঠেছে একটি অনন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার দর্শন
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি তৈরির পেছনে রয়েছে স্যার ফজলে হাসান আবেদের দূরদর্শী চিন্তা। তিনি বিশ্বাস করতেন- দেশের উন্নয়নের জন্য প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষার সাথে মানসম্পন্ন ও সময়োপযোগী উচ্চশিক্ষাও নিশ্চিত করা জরুরি। এই চিন্তা থেকেই ২০০১ সালে স্যার ফজলে গড়ে তোলেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। তার লক্ষ্য ছিল এমন একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, যেখানে শিক্ষার্থীরা বিশ্বমানের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে পারবে, নেতৃত্ব দিতে পারবে দেশে-বিদেশে। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি উদ্ভাবনী শিক্ষাপদ্ধতি, গবেষণাভিত্তিক পাঠ্যক্রম এবং আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। এখানে শিক্ষার্থীরা যুগোপযোগী শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিকতা, নেতৃত্ব ও সামাজিক দায়বদ্ধতার শিক্ষাও পেয়ে থাকেন এবং বৈশ্বিক সমস্যার সমাধানে সক্ষম হয়ে ওঠেন।
অ্যাকাডেমিক শিক্ষায় অনন্য
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষাব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানের। এখানে রয়েছে ৯টি স্কুল, ৬টি বিভাগ, ৩টি ইনস্টিটিউট ও ৫টি সেন্টার। প্রতিটি স্কুলে রয়েছে আধুনিক পাঠ্যক্রম, গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা ও দক্ষ শিক্ষকমণ্ডলি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুলগুলো এমনভাবে তৈরি, যেখানে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার পাশাপাশি- নেতৃত্ব, প্রবলেম সলভিং ও সামাজিক দায়িত্ববোধের মতো গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতাও শেখে। ব্যবসা, প্রকৌশল, আইন, সমাজবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, ডেটা সায়েন্স, স্থাপত্য ও জেনারেল এডুকেশনের মতো নানা বিষয়ে আধুনিক ও ব্যবহারিক শিক্ষা দেওয়া হয়।
প্রযুক্তিনির্ভর ল্যাব, মাঠপর্যায়ের গবেষণা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং বাস্তবমুখী শিক্ষা পদ্ধতি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় শক্তি। এসবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত হয়। যা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিকে পরিণত করেছে বাংলাদেশের অন্যতম উদ্ভাবনী ও সময়োপযোগী একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।
শিক্ষার্থীরা এখানে নিয়মিতভাবে আন্তর্জাতিক প্রকাশনা, জার্নাল এবং কনফারেন্সে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের গবেষণাকর্মকে সমৃদ্ধ করছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি প্রোগ্রাম এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে বাস্তব জীবনে তার অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে সমাজ ইতিবাচক অবদান রাখতে সক্ষম হয়।
গবেষণায় নেতৃত্ব
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি গবেষণা ও উদ্ভাবনে বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি গবেষণায় ৩৭.৯ কোটি টাকা এবং ২০২০ সালে ৫৫.২৩ কোটি টাকা ব্যয় করে, যা দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০২০ সালে, এটি তার মোট বাজেটের ১৬.৪১% গবেষণায় ব্যয় করেছে।
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির গবেষণা ক্ষেত্রগুলো বিস্তৃত ও বহুমাত্রিক। জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথ স্বাস্থ্য, পুষ্টি, জেন্ডার সমতা, প্রজনন স্বাস্থ্য, সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে । ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট দারিদ্র্যবিমোচন, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, জেন্ডার সমতা, শাসন ব্যবস্থা, জলবায়ু পরিবর্তন ও ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি নিয়ে গবেষণা করে। ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে গুণগত পরিবর্তন আনতে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষাবিষয়ক বিভিন্ন কোর্স ও প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম ডিজাইন করছে সেই সাথে প্লে পেডাগজি, প্রারম্ভিক শৈশব উন্নয়ন, শিক্ষা খাতে উদ্ভাবনী সমাধানসহ শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক মানোন্নয়নে অসাধারণ অবদান রাখছে। গুণগত গবেষণার মাধ্যমে বহুভাষিক শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিচ্ছে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব ল্যাঙ্গুয়েজেস।
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ সংরক্ষণ, নবায়নযোগ্য শক্তি ও জলবায়ু অভিযোজন নিয়ে কাজ করছে। সেন্টার ফর এন্টারপ্রেনারশিপ ডেভেলপমেন্ট উদ্যোক্তা উন্নয়ন, স্টার্ট-আপ সহায়তা এবং ব্যবসায়িক উদ্ভাবনের মাধ্যমে উদ্যোক্তা উন্নয়নে সহায়ক ইকোসিস্টেম তৈরি করেছে। এই সেন্টারটি নতুন উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ, পরামর্শ এবং গবেষণা সহায়তা প্রদান করে চলছে। শান্তি, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিয়ে গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস। সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও বিশ্বের সংঘাত নিরসনে বিশ্বজুড়ে এই প্রতিষ্ঠানটির সুনাম রয়েছে।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও প্রকৌশল গবেষণার ক্ষেত্রেও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ভূমিকা অগ্রণী। বিশ্ববিদ্যালয়টির ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা দেশের প্রথম ন্যানো-স্যাটেলাইট ‘ব্র্যাক অন্বেষা’ তৈরি করেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মঙ্গল তরী, দ্বিচারী, ডুবোটেক, ব্র্যাকইউ অলটারসহ অসংখ্য উন্নতমানের রোবট তৈরি করেছে যেগুলো আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় দেশের জন্য সফলতা বয়ে এনেছে। এছাড়াও ব্যবসায় উন্নয়ন, স্থাপত্য, আইন, ফার্মাসিউটিক্যালসহ বিভিন্ন সেক্টরে গবেষণা পরিচালনা করছেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
গুণগত গবেষণার প্রতি অঙ্গীকারের অংশ হিসেবে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি চালু করেছে ‘কোয়ালিটি জার্নাল পাবলিকেশন অ্যাওয়ার্ড’—যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন গবেষণাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ২০২৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৭ জন শিক্ষক এই পুরস্কার অর্জন করেছেন, যারা সম্মিলিতভাবে ১৪৫টি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন স্বীকৃত আন্তর্জাতিক জার্নালে। এই উদ্যোগ শিক্ষকদের উচ্চমানের গবেষণায় আগ্রহী করে তোলে এবং ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির উদ্ভাবনী চিন্তা, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও অ্যাকাডেমিক উৎকর্ষের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে।
সম্প্রতি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে চালু হয়েছে লার্নিং অ্যান্ড টিচিং ইনোভেশন সেন্টার। পাঠদান ও শিক্ষণ প্রক্রিয়া আরো সহজ করতে উদ্ভাবনী পদ্ধতির প্রয়োগ নিয়ে কাজ করছে এই সেন্টারটি।
ইন্টারন্যাশনাল কোলাবোরেশন
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা, যা একে বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে একটি বৈশ্বিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অ্যাকাডেমিক ও গবেষণা কোলাবোরেশনে অংশ নিচ্ছে, যার ফলে শিক্ষার্থীদের জন্য খুলে যাচ্ছে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও কর্মসংস্থানের বৈশ্বিক সুযোগ।
বিশ্ববিদ্যালয়টি যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানচেস্টার, যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি, হার্ভার্ড, ডিউক ইউনিভার্সিটি, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিসহ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ গবেষণা, এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম ও নলেজ শেয়ারিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তি, সামাজিক উন্নয়ন এবং শিক্ষা খাতে এসব সহযোগিতা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
এছাড়াও, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি ওপেন সোসাইটি ইউনিভার্সিটি নেটওয়ার্কের এর মতো আন্তর্জাতিক শিক্ষা প্ল্যাটফর্মের সাথে যুক্ত। এর ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের আওতায় ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে গিয়ে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে লেখাপড়া করতে পারছেন। একইভাবে, বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থী, গবেষক ও পেশাজীবীরা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে আসছেন গবেষণা, উচ্চশিক্ষা বা সম্মেলনে অংশ নিতে। এই গ্লোবাল ইন্টারেকশন শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংস্কৃতিচর্চা, গ্লোবাল কম্পিটেন্স এবং গবেষণার পরিসর বাড়িয়ে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক এসব কোলাবোরেশন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিকে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় একটি রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার ড. ডেভিড ডাউল্যান্ড বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী। আমাদের শিক্ষার্থীরা বিশ্বের নানা প্রান্তের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে পড়াশোনা ও গবেষণায় অংশ নিচ্ছে। এই অভিজ্ঞতা তাদেরকে গ্লোবাল স্কিলস এবং আন্তসংস্কৃতিক বোধ গড়ে তুলতে সহায়তা করছে। আমরা চাই দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও এই ধরনের আন্তর্জাতিক চর্চায় আরও বেশি করে যুক্ত হোক। ব্র্যাকের পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতা আমাদের এই যাত্রায় একটি শক্ত ভিত্তি দিয়েছে। বিশেষ করে ডেটা সায়েন্স, রোবোটিকস, আর্টিফিশিয়েল ইন্টেলিজেন্স, সাইবার সিকিউরিটি, ব্লকচেইন ও সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তির মতো সামনের সারির খাতে আমরা বড় পরিসরে বিনিয়োগ করছি এবং আমাদের শিক্ষার্থীরা ইতিমধ্যে বিশ্বের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে এসব খাতে কাজ শুরু করেছে।’
নতুন ক্যাম্পাস : ভবিষ্যতের শিক্ষাঙ্গন
২০২৩ সালে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি তাদের নতুন স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাত্রা শুরু করে, যা ঢাকার মেরুল বাড্ডায় অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের প্রথম পরিবেশবান্ধব ক্যাম্পাস হিসেবে বিশেষভাবে প্রশংসিত।
নতুন ক্যাম্পাসে রয়েছে সর্বাধুনিক গবেষণাগার, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, সুবিশাল কনফারেন্স রুম, আধুনিক অডিটোরিয়াম, এবং ডিজিটাল লার্নিং স্পেস যেখানে শিক্ষার্থীরা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার সুযোগ পায়। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাবিষয়ক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনের জন্য রয়েছে মাল্টিপারপাস হল এবং সর্বাধুনিক অডিটোরিয়াম। ক্যাম্পাসের মোট আয়তনের ৫০ শতাংশ ফাঁকা রাখা হয়েছে যাতে শিক্ষার্থীরা একটি খোলামেলা পরিবেশ পায়, যেখানে তারা জ্ঞানচর্চা করতে পারে।
এই ক্যাম্পাসের স্থাপত্য নকশায় বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব দিকগুলোতে। প্রাকৃতিক আলো ও বায়ু চলাচলের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে জানালা স্থাপন করা হয়েছে এমনভাবে যাতে দিনের আলো থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়া যায় এবং কৃত্রিম আলো ও এয়ার কন্ডিশনারের ব্যবহার কমানো যায়।
সবুজ ছাদ এই ক্যাম্পাসের অন্যতম বিশেষত্ব, যা কেবল ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করে না, বরং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। সেই সাথে এটি বৃষ্টির পানি শোষণে কার্যকর। এছাড়া পানি সংরক্ষণ প্রযুক্তি যেমন রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম ও পানি রিসাইকেল ব্যবস্থাপনা চালু করা হয়েছে, যা জল সম্পদের অপচয় রোধে সহায়ক।
ক্যাম্পাসে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সোলার প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে, যা ক্যাম্পাসের বৈদ্যুতিক চাহিদার একটি বড় অংশ নিজস্বভাবে পূরণ করে। পাশাপাশি আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অনুসরণ করে ক্যাম্পাসে জৈব বর্জ্য থেকে কম্পোস্ট তৈরির মতো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যা এই প্রতিষ্ঠানের পরিবেশবান্ধবতার মানদণ্ডকে আরও সুদৃঢ় করেছে।
এই সব উদ্যোগের মাধ্যমে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি শিক্ষার একটি আদর্শ স্থান হয়ে ওঠার পাশাপাশি পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধ, টেকসই ও স্মার্ট ক্যাম্পাস গড়ে তুলেছে। এটি ভবিষ্যতের শিক্ষাঙ্গণ হিসেবে দেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও নগর পরিকল্পনাকারীদের জন্য অনুকরণীয় এক মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারপারসন তামারা হাসান আবেদ বলেন, ‘স্যার ফজলে এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে চেয়েছিলেন যেখানে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে শিক্ষা এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চা হবে। প্রকৃতি এবং আধুনিক স্থাপত্যের মিশেলে এই নতুন ক্যাম্পাসটি গড়ে তোলা হয়েছে যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জীবন সম্পর্কে অন্যভাবে ভাবতে শেখাবে। উন্নয়নের কারণে নগরায়ণ হবেই, কিন্তু প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের উদ্ভাবনী এবং সৃজনশীল হতেই হবে। নগর পরিকল্পনা এবং পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এই ক্যাম্পাস শিক্ষার্থী, পরিকল্পনাবিদ এবং সংশ্লিষ্টদের জন্য একটি আদর্শ মানদণ্ড হয়ে থাকবে।’
স্টুডেন্ট লাইফ ও এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিজ
নেতৃত্ব, সৃজনশীলতা, এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা বিকাশে সহায়তা করতে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে রয়েছে ৩৩টি ক্লাব। শিক্ষার্থীরা এসব ক্লাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নানান ধরনের কর্মশালা, সেমিনারে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। এসব অভিজ্ঞতা তাদের একাডেমিক জ্ঞানকে বাস্তব জীবনের প্রয়োজনীয়তায় রূপান্তর করে, যা পরবর্তীতে চাকরি বা উদ্যোক্তা জীবনে সহায়ক হয়। এসব ক্লাব বিতর্ক, ভাষা শিক্ষা, বিজনেস কেস কম্পিটিশন, উদ্যোক্তা কর্মশালা, রোবোটিকসসহ নিয়মিতভাবে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয় ক্যারিয়ার ফেয়ার, যেখানে দেশি-বিদেশি নামকরা করপোরেট প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। এতে শিক্ষার্থীরা চাকরির সুযোগ, ইন্টার্নশিপ এবং নেটওয়ার্কিংয়ের সুযোগ পান।
সমাজে প্রভাব ও নেতৃত্ব সৃষ্টি
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েটরা কেবল দেশের অভ্যন্তরেই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও নিজেদের দক্ষতা ও নেতৃত্বের ছাপ রেখে চলেছেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, অ্যাপল, মেটা, অ্যামাজন, প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ বিশ্বের বিভিন্ন কর্পোরেট ও উন্নয়ন সংস্থায় সফলভাবে কর্মরত আছেন। অনেকে আবার সফল উদ্যোক্তা হয়ে কর্মসংস্থান তৈরি করছেন এবং সামাজিক উদ্ভাবনের মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনছেন।
উদাহরণস্বরূপ, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে জলবায়ু পরিবর্তন, স্বাস্থ্যসেবা, নারী অধিকার, শিক্ষা, টেকসই নগর উন্নয়ন, ডিজিটাল প্রযুক্তি, এবং গার্মেন্টস খাতের শ্রমিক কল্যাণ–এসব বিষয় নিয়ে নিয়মিত গবেষণা হয়। শিক্ষকেরা নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কাজ করে বাস্তবভিত্তিক সমাধান তুলে ধরেন, আর শিক্ষার্থীরা গবেষণার মাধ্যমে দেশের বাস্তবতা বিবেচনা করে এর টেকসই সমাধান খুঁজে থাকেন।
এভাবে, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির গবেষণা কার্যক্রম শুধু আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশেই সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং এগুলো সমাজে বাস্তব পরিবর্তন আনার লক্ষ্য নিয়েই পরিচালিত হয়। এই গবেষণাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিই শিক্ষার্থীদের দেশপ্রেম, মানবিকতা ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে।
রেসিডেন্সিয়াল সেমিস্টার
রেসিডেনশিয়াল সেমিস্টার ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষাব্যবস্থার একটি অন্যতম বিশেষ ও বৈচিত্র্যময় অধ্যায়, যা শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত করে। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ সেমিস্টার, যেখানে শিক্ষার্থীরা সাভারে অবস্থিত এই রেসিডেনশিয়াল ক্যাম্পাসে থেকে অ্যাকাডেমিক, সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা শিক্ষিত হয়ে থাকে।
এই সেমিস্টারে শিক্ষার্থীরা অংশ নেন বিভিন্ন কর্মশালা, পাঠচক্র, সমাজবিষয়ক আলোচনা, শরীরচর্চা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও নেতৃত্ব উন্নয়নমূলক কার্যক্রমসহ নানান ধরনের ব্যক্তিত্ব উন্নয়ন কার্যক্রমে। তবে এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, শিক্ষার্থীরা নিয়মিতভাবে ব্র্যাকের নানা উন্নয়ন প্রকল্প, যেমন স্বাস্থ্যসেবা, মাইক্রোফাইন্যান্স এবং শিক্ষা প্রকল্প কার্যক্রম পরিদর্শন করে।
তারা গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলে, তাদের জীবনসংগ্রাম কাছ থেকে বোঝে। ওল্ড এজ হোম, অনাথ আশ্রম এবং অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানে গিয়ে প্রবীণ ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সঙ্গে সময় কাটায়। এইসব অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে সহমর্মিতা, দায়িত্ববোধ ও নেতৃত্বের গুণাবলি তৈরি করে।
এই সেমিস্টার শিক্ষার্থীদের শেখায়- শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হলো সমাজের মানুষের সার্বিক উন্নয়ন। এই রেসিডেনশিয়াল সেমিস্টার অ্যাকাডেমিক ও মানবিক শিক্ষার এক অনন্য সংমিশ্রণ, যা শিক্ষার্থীদের পরিণত করে ভবিষ্যতের সচেতন, মানবিক ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে।
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির রেসিডেনশিয়াল সেমিস্টারের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থাপত্য বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী তাওসিফ মোনাওয়ার বলেন, ‘ঢাকার বাইরে থেকে আমরা যারা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এসেছিলাম, তারা সাধারণত আশপাশের বিভিন্ন মেস বা হোস্টেলে থাকতাম। একধরনের ঘিঞ্জি পরিবেশের ভেতর পড়াশোনার চাপে হাঁসফাঁস করতে হতো। রেসিডেনশিয়াল সেমিস্টার ছিল পুরোপুরি ভিন্ন এক পরিবেশ। সেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি কল্যাণমুখী চিন্তাভাবনা, বিভিন্ন সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম ও খেলাধুলার সুযোগ ছিল। অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও ভাবের আদান-প্রদান ঘটেছে। এতে করে তিন মাসের এই সেমিস্টার আমার মতো অনেকের চিন্তাভাবনাকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে, যা আমাদের সচেতন, মানবিক ও দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে বলে মনে করি।’
ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আগামীর পরিকল্পনা
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি ভবিষ্যতের উচ্চশিক্ষাকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, গবেষণাভিত্তিক ও টেকসই করে গড়ে তুলতে ভিশন, মিশন ও কৌশলগত স্তম্ভকে নতুনভাবে সাজিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি গ্লোবাল সাউথ-এর একটি নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। যার মূল ভিত্তি হলো অ্যাকাডেমিক উৎকর্ষ, সামাজিক প্রভাব ও মানবিক উন্নয়ন। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি এমন আগামীর নেতৃত্ব গড়ে তুলতে চায় যারা অ্যাকাডেমিক দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি সেগুলোকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে সক্ষম এবং যারা সহানুভূতি ও নৈতিকতাকে সঙ্গে নিয়ে সমাজে অর্থবহ পরিবর্তন আনবে। বিশ্ববিদ্যালয়টির চারটি কৌশলগত স্তম্ভ হলো-কারিকুলাম, শিক্ষা ও শিক্ষণ পদ্ধতির আধুনিকায়ন; শিক্ষার্থীবান্ধব মানসিকতা; ফলপ্রসূ গবেষণা গবেষণা; এবং ব্র্যাক ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন, জনস্বাস্থ্য, পাবলিক পলিসি ও নারী শিক্ষার ওপর বিশেষায়িত প্রোগ্রাম চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। এইসব উদ্যোগের মূল লক্ষ্য একটি 'গ্লোবাল সিটিজেন' গড়ে তোলা, যেখানে শিক্ষার্থীরা শুধু বাংলাদেশের নয়, বরং বিশ্বমানের নাগরিক হয়ে উঠবে, যারা নেতৃত্ব, সহনশীলতা এবং আন্তঃসাংস্কৃতিক বোধ নিয়ে ভবিষ্যতের সমাজ নির্মাণে ভূমিকা রাখবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কর্মযজ্ঞ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ফারহাত আনোয়ার বলেন, ‘শিক্ষা, গবেষণা এবং সমাজমুখী কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের লক্ষ্য এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে শিক্ষার্থীরা শুধু বইয়ের জ্ঞান বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারবে। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি বিশ্বাস করে, গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্বে একটি মানবিক ও টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণ সম্ভব, এবং সেই ভবিষ্যৎ গড়ার দায়িত্ব আমরা নিতে প্রস্তুত।’
উপসংহার
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি আজ কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এটি একটি ভাবনা, একটি চেতনা, এবং একটি প্রতিশ্রুতি- যা শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে বদ্ধ পরিকর। সুষ্ঠু পরিচালনা, উদ্ভাবনী চিন্তা, আন্তর্জাতিক মান এবং মানবিক মূল্যবোধের সমন্বয়ে এটি হয়ে উঠেছে একটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ২১ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি একটি সময়োপযোগী ও নেতৃত্বস্থানীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
মন্তব্য করুন