দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিরাপত্তা সঞ্চিতিতে (প্রভিশন) ঘাটতির অঙ্ক। চলতি বছরের জুন শেষে ১০ বাণিজ্যিক ব্যাংক এ ঘাটতিতে পড়েছে। এসব ব্যাংকে ঘাটতি ছাড়িয়ে গেছে সাড়ে ৩১ হাজার কোটি টাকা। তবে কিছু ব্যাংক প্রভিশন উদ্বৃত্ত রাখায় দেশের ব্যাংক খাতে সার্বিক সঞ্চিতি ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করপোরেট সুশাসন এবং ব্যাংকিং ব্যবসার ভিত্তি মজবুত না হওয়ায় এ সংকটের উৎপত্তি হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সরকারি বেসরকারি—সব মিলিয়ে ১০ ব্যাংকের মোট সঞ্চিতি ঘাটতির পরিমাণ ৩১ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা। কয়েকটি ব্যাংক তাদের লক্ষ্যমাত্রার বেশি সঞ্চিতি রেখেছে। ফলে ব্যাংক খাতে সার্বিক প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতের সার্বিক প্রভিশন ঘাটতি ছিল ১৯ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় মাসের ব্যবধানে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৫ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে পরিচালন মুনাফার শূন্য দশমিক ৫ থেকে ৫ শতাংশ সাধারণ ক্যাটাগরির ঋণের বিপরীতে প্রভিশন হিসেবে রাখতে হয়। নিম্নমানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে ২০ এবং ৫০ শতাংশ সন্দেহজনক খেলাপি ঋণের বিপরীতে রাখতে হয়। এ ছাড়া, প্রতিটি ব্যাংকের জন্য মন্দ বা লোকসান ক্যাটাগরির খেলাপি ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশনিং আলাদা করে রাখার বিধান রয়েছে। প্রভিশন ঘাটতি ব্যাংক খাতের জন্য একটি অশনিসংকেত, কারণ এটি ব্যাংকগুলোর দুর্বল আর্থিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরে, যা মূলত উচ্চ খেলাপি ঋণের ফল।
তথ্যমতে, জুন শেষে সবচেয়ে বেশি প্রভিশন ঘাটতিতে ছিল বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক। বিভিন্ন দুর্নীতি এবং অনিয়মের কারণে বেশ আলোচিত এই ব্যাংকটি। তাই অন্যদের তুলনায় আমানত সংগ্রহ এবং ঋণ আদায়ে বেশ পিছিয়ে তারা। জুন শেষে ব্যাংকটির মোট প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরেও তাদের সঞ্চিতি ঘাটতি ছিল ১১ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা। ছয় মাসের ব্যবধানে এই ঘাটতি বেড়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থান রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের। জুন শেষে ব্যাংকটির প্রভিশনে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বরেও ব্যাংকটির সঞ্চিতিতে ঘাটতি ছিল ৪ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। তৃতীয় অবস্থানে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ২৪১ কোটি টাকা। আর রূপালি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ৪ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে ইতিবাচক ধারায় থাকলেও চলতি বছরের জুনে বিডিবিএলের সঞ্চিতি ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৪ কোটি টাকা। এ ছাড়াও বেসরকারি খাতের আইএফআইসি ব্যাংকে ৫০৬ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে ৪৪৩ কোটি, ঢাকা ব্যাংকে ৩২৭ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে ৩৯১ কোটি ও সাউথইস্ট ব্যাংকে ১৯৮ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, সাধারণত প্রভিশন করলে মুনাফা কমে যায়। মুনাফা কমলে লভ্যাংশ দেওয়া যায় না। মালিকদের তো একটা লভ্যাংশের আগ্রহ থাকে। সে কারণেই প্রভিশন ঘাটতি হয়। নিয়ন্ত্রণ সংস্থা নিজের কাজটা করলে সেটা করে পার পেয়ে যাওয়ার কথা নয়। ব্যাংগুলোর জন্য নিয়ম বেঁধে দেওয়া আছে, কোন ক্যাটাগরির জন্য কত প্রভিশন করতে হবে। সরকারি ব্যাংক হোক আর বেসরকারি, প্রভিশন অবশ্যই রাখতে হবে।
এদিকে জুন শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। মার্চ শেষে ঋণ স্থিতি ছিল ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। তখন খেলাপি ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। সে হিসেবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৯ হাজার ৯৬ কোটি টাকা। ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৪২ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা।