সাতক্ষীরা প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

সাতক্ষীরায় বিএনপির তিন গ্রুপের দ্বন্দ্ব, নেতাকর্মীদের আস্থায় রহমতুল্লাহ পলাশ

রহমতুল্লাহ পলাশ। ছবি : সংগৃহীত
রহমতুল্লাহ পলাশ। ছবি : সংগৃহীত

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সাতক্ষীরা-২ (সদর-দেবহাটা) আসনে বিএনপির মনোনয়নকে কেন্দ্র করে অস্থিরতার হাওয়া বইছে। এই কেন্দ্র থেকে প্রাথমিক মনোনয়নে ধানের শীষ প্রতীক পেয়েছেন বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ। তার এই মনোনয়নে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে। তবে নেতাকর্মীদের আস্থায় যে নাম রয়েছে তিনি হলেন জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি রহমতুল্লাহ পলাশ। অনেকের মতে, পলাশ ধানের শীষের প্রতীক পেলে বিএনপির মধ্যে চলা তীব্র বিভাজনের নিরসন হবে।

সরেজমিনে সাতক্ষীরা সদর ও দেবহাটা উপজেলায় বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা যাচ্ছে।

আরও জানা গেছে, আব্দুর রউফ বিএনপির টিকিট পাওয়ায় সাবেক লাবসা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল আলিম এবং সাবেক পৌর মেয়র তাসকিন আহমেদ চিশতীর কর্মী-সমর্থকরা চরম অস্থিরতা ও হতাশার মধ্যে রয়েছেন।

এ বিষয়ে স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা বলছেন, আব্দুর রউফ, আব্দুল আলিম ও তাসকিন আহমেদের মধ্যে কেউ প্রার্থী হলে বাকি দুজন ভেতরে ভেতরে বিরোধিতা করবেন। এতে ভোটের মাঠ ভেঙে পড়বে। তাই এই তিনজনকে বাদ দিয়ে নেতা-কর্মীদের পছন্দ রহমতুল্লাহ পলাশকে। পলাশই একমাত্র ব্যক্তি, যাকে তিন গ্রুপই মেনে নেবে। তিনপক্ষের বিভক্ত মাঠ তিনি আবার এক করতে পারেন।

সদরের একাধিক ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ভাষ্য, রহমতুল্লাহ পলাশ পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির রাজনীতিক। তৃণমূল নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের আস্থার কেন্দ্রে উঠে এসেছেন তিনি।

এর ব্যাখ্যায় তারা জানান, চলতি বছরের শুরুতে জেলা বিএনপির গ্রুপিংয়ের কারণে স্থানীয় প্রশাসন ও কেন্দ্র যখন নাখোশ ছিল সে সময় রহমতুল্লাহ পলাশকে আহ্বায়ক করায় মুহূর্তেই পাল্টে যায় জেলা বিএনপির রাজনীতি। জেলা বিএনপির গ্রুপিংয়ের কারণে অচলবস্থা থেকে কয়েক মাসের ব্যবধানে বর্তমানে প্রতিটি ইউনিটে পুনর্গঠনের পথ দেখিয়েছেন।

তাছাড়া রহমতুল্লাহ পলাশ কেবল ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতার কারণেই আলোচনায় নন; তার রাজনৈতিক শেকড়ও বেশ গভীর। তিনি রাজনৈতিক পরিবার থেকে উঠে আসা নেতা।

জানা গেছে, ১৯৭৯ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাক্ষরিত ছাত্রদলের প্রথম কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটিতে নাম ছিল রহমতুল্লাহ পলাশের। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের প্রথম কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পেলেও জোটগত কারণে আসনটি জামায়াতে ইসলামীর জন্য ছেড়ে দেয় দলটি।

রহমতুল্লাহ পলাশের বাবা সাবেক মন্ত্রী এম মনসুর আলীরও এই এলাকায় রাজনৈতিক অবস্থান ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। ১৯৭৮ সালে কালিগঞ্জ-দেবহাটা সংসদীয় আসনে ধানের শীষ প্রতীকে বিপুল ভোটে জয়ী হন তিনি। পরে ১৯৯৬ সালে সাতক্ষীরা-২ আসনে আবারও ধানের শীষে নির্বাচন করেন।

জেলা বিএনপির সদস্যসচিব আবু জাহিদ ডাবলু বলেন, ‘২০১৩-২০১৬ সাল ছিল সাতক্ষীরায় সবচেয়ে ভয়াবহ সময়; ক্রসফায়ার, হত্যা, মামলা, গ্রেপ্তার সব মিলিয়ে দমবন্ধ অবস্থা। সেই সময় জেলা বিএনপির সভাপতি হিসেবে একের পর এক আন্দোলনে সম্মুখে থেকে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন রহমতুল্লাহ পলাশ। যখন কেউ মাঠে নামার সাহস পেত না, পলাশ ভাই তখনও কর্মীদের নিয়ে আন্দোলন চালিয়েছেন। দমন পীড়নের সেই সময়টাতে তিনিই দলের একমাত্র ভরসা ছিলেন।’

তিনি আরও বলেন, চলতি বছর সাতক্ষীরা-২ আসনের মোট ১৭১টি ওয়ার্ডে সদস্য নবায়নের মাধ্যমে ১৭১টি ওয়ার্ড ও ১৯ ইউনিয়ন বিএনপির কমিটি নির্বাচন ও সম্মেলন, এটি সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির ইতিহাসে নজিরবিহীন সাংগঠনিক কাজ। এই সব কার্যক্রমে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক রহমতুল্লাহ পলাশ সশরীরে উপস্থিত থেকে প্রতিটি ইউনিটে সংগঠন পুনর্গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। ফলে তৃণমূল পর্যায়ে তার গ্রহণযোগ্যতা এখন সবচেয়ে উঁচুতে।

এদিকে, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে ইউপি নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় বহিষ্কৃত সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুর রউফ এবার বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন। তিনি সবসময়ই বিতর্কিত। ২০২৪ সালের ২৫ এপ্রিল দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে আলিপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় কেন্দ্রীয় বিএনপি তাকে প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করেছিল। সেই সময় দলীয় চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে স্থানীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আপনাকে বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে নির্দেশক্রমে বহিষ্কার করা হলো।

অপরদিকে, চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল সাতক্ষীরা সদরের আলিপুর চেকপোস্ট মাদ্রাসা ও মসজিদ আয়োজিত এক মাহফিলে জনপ্রিয় ইসলামী বক্তা ও শিল্পী কবির বিন সামাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে আলোচনায় আসেন আলিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ। ওই ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষোভ প্রকাশ করে স্থানীয় আলেম-ওলামা ও তৌহিদি জনতা ব্যানারে মানববন্ধন করেন। বক্তারা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আব্দুর রউফকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গণঅভ্যুত্থানের পর রউফের নেতৃত্বে সাতক্ষীরা বাস টার্মিনাল দখল করা হয়। তার আরেক ভাই হাবিবুর রহমান হবি ভোমরা স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন দখলে নেন। তারই ভাইপো আ ন ম আবু সাঈদ মূলধারার সাংবাদিকদের বাইরে রেখে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের নিয়ে সাতক্ষীরা প্রেস ক্লাব দখল করেন। যদিও প্রশাসনের সহযোগিতায় সি অ্যান্ড এফ অ্যাসোসিয়েশন নিরপেক্ষ ভোটের মাধ্যমে বেদখলমুক্ত হয়। এ ছাড়া জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে তাদের দখল থেকে উদ্ধার করা হয় প্রায় ৩০ বিঘা সরকারি খাস জমি।

যে কারণে নেতাকর্মীরা আশঙ্কা করছেন, আব্দুর রউফ তার ছেলেকে গুম দেখিয়ে মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়েছেন। তাদের দাবি, রউফের ছেলে আবু সেলিম ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের কারণে গুম হয়েছেন। কিন্তু সেটিকে দলীয় কারণে গুম হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। আবু সেলিম যে সময় গুম হন, সে সময় তিনি এবং তার বাবা আব্দুর রউফ বিএনপির তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ ছিলেন না।

এছাড়া আরেক নেতা চেয়ারম্যান আব্দুল আলিমের পক্ষে জেলা ও উপজেলা বিএনপির কিছু অংশ আছে। তবে দলের ভেতরে তার বিরোধী গোষ্ঠীও শক্তিশালী। বিশেষ করে তার বিরুদ্ধে দলের মধ্যে গ্রুপিং সৃষ্টি করার অভিযোগে রয়েছে সবসময়।

এদিকে, আরেক নেতা তাসকিন আহমেদ চিশতী তিনি সাবেক পৌর মেয়র শহর বিএনপির বড় অংশ তার অনুসারী। কিন্তু তিন গ্রুপের মাঝে তিনিই সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত। এছাড়া পৌর মেয়র থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতির নানা অভিযোগ ছিল।

বিভক্তির এই সময়েই বারবার উঠে আসছে একটাই নাম রহমতুল্লাহ পলাশ। কারণ তিন পক্ষই তাকে ব্যক্তিগতভাবে সম্মান করেন, সম্পর্কও ভালো। এমনকি তিন নেতা-কর্মীদের অনুসারী দলের মধ্যে জরিপ করলে দেখা যাবে প্রার্থী না হলে পরবর্তী হিসেবে যাকে দেখতে চান একযোগে সবাই বলেন ‘রহমতুল্লাহ পলাশ’।’ নেতারা বলছেন, ঐক্য ধরে রাখতে ও দলকে সংঘাতমুক্ত রাখতে পলাশের বিকল্প নেই।

এদিকে সাতক্ষীরা-২ আসনে জামায়াতে ইসলামীর সাংগঠনিক শক্তি পরিপক্ব, সংগঠিত ও বহু বছরের প্রতিষ্ঠিত। স্থানীয়দের মতে, জামায়াতের বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রার্থী দরকার। নেতাকর্মীদের ভাষায় দুর্বল প্রতিপক্ষ দিলে ধানের শীষের ভোট অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।

এই জায়গায় রহমতুল্লাহ পলাশ নিজের আত্মবিশ্বাসের কথা বলেছেন, ‘জামায়াতের বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো সাংগঠনিক শক্তি, সম্মান, পরিচ্ছন্ন ইমেজ এসব দিক থেকেই আমি অন্যদের চেয়ে এগিয়ে। সাধারণ মানুষের ভোটও বেশি পাব এটা হলফ করে বলতে পারি।’

বিশ্লেষকদের মতে, মনোনয়ন যদি পলাশের দিকে যায়, তিন গ্রুপ এক ছাতার নিচে আসবে, ভাঙা মাঠ আবার সংগঠিত হবে, তৃণমূলের বিভক্ত ভোট একদিকে যাবে, বিএনপি আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতার জায়গায় ফিরবে, সাধারণ ভোটারের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। এক কথায়, ত্রিমুখী বিভাজন পেরিয়ে বিএনপিকে বাঁচাতে হলে পলাশ হতে পারেন চূড়ান্ত সমঝোতার মুখ।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিএনপি নেতা বদরুজ্জামান মিন্টু চিরনিদ্রায় শায়িত

ঢাকা-১৩ আসনে ধানের শীষের সমর্থনে যুবদলের গণমিছিল

নতুন জোটের ঘোষণা দিল এনসিপি

কড়াইল বস্তিতে আগুন, তারেক রহমানের সমবেদনা

কড়াইল বস্তিতে আগুনের ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টার উদ্বেগ ও সমবেদনা 

গণভোট অধ্যাদেশ জারি করে গেজেট প্রকাশ

জেসিআই ঢাকা ইউনাইটেডের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন মাসউদ

কড়াইল বস্তির আগুন নিয়ন্ত্রণে

চীনা দূতাবাস কর্মকর্তার সঙ্গে চৌদ্দগ্রাম জামায়াত নেতাদের মতবিনিময়

নুরুদ্দিন আহম্মেদ অপুর সঙ্গে সেলফি তুলতে মুখিয়ে যুবসমাজ

১০

অগ্রণী ব্যাংকের লকারে শেখ হাসিনার ৮৩২ ভরি স্বর্ণ

১১

শুভর বুকে ঐশী, প্রেম নাকি সিনেমার প্রচারণা?

১২

৭০৮ সরকারি কলেজকে চার ক্যাটাগরিতে ভাগ

১৩

ইউএস বাংলার সাময়িকীর কনটেন্ট তৈরি করবে অ্যানেক্স কমিউনিকেশনস

১৪

সাদিয়া আয়মানের সমুদ্র বিলাশ

১৫

পৌরসভার পরিত্যক্ত ভবনে মিলল নারীর মরদেহ 

১৬

কড়াইলের আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসার কারণ জানাল ফায়ার সার্ভিস

১৭

প্রশাসনের ৭ কর্মকর্তার পদোন্নতি

১৮

যুক্তরাষ্ট্রে যোগাযোগ ও মিডিয়া কনফারেন্সে জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে আলোচনা

১৯

এবার জুবিনের মৃত্যু নিয়ে উত্তাল বিধানসভা

২০
X