বাগানে বাগানে ছড়িয়ে পড়েছে পাতা পচা রোগ ও পোকার আক্রমণ, যা নিয়ে দিশেহারা চাষি। সঙ্গে যোগ হয়েছে সার সংকট। সব মিলিয়ে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎপাদন পঞ্চগড়ে চায়ের উৎপাদন কমছে আশঙ্কাজনকভাবে।
চাষিরা জানান, বাগানে লাল মাকড়, লোফার ও কারেন্ট পোকার আক্রমণের পাশাপাশি এখন নতুন করে দেখা দিয়েছে পাতা পচা রোগ। ওষুধ দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। কুঁড়ি থেকে নতুন পাতা বের হওয়ার পরপরই তা পচে কালচে হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে কমছে কাঁচা পাতার উৎপাদন।
চা বোর্ডের আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, চায়ের উৎপাদন ২০২৩ মৌসুমের তুলনায় কমেছে। গত মৌসুমে (২০২৪) উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার (পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, দিনাজপুর ও নীলফামারী) সমতল ভূমিতে উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৪৩ লাখ ৯০ হাজার ১৫১ কেজি চা, যা আগের মৌসুমের চেয়ে ৩৫ লাখ ৫৭ হাজার কেজি কম। আর গত মৌসুমে জাতীয় উৎপাদনের ১৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ চা সমতল ভূমি থেকে যুক্ত হয়েছে; এবার এর পরিমাণ ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
চা বোর্ডের দাবি, দাম না পেয়ে চাষিদের বাগান পরিচর্যায় অনেকটা অনীহা এবং কিছু বাগান নষ্ট করে ফেলার কারণে উৎপাদন কিছুটা কমেছে।
তেঁতুলিয়ার নুরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল খালেক, আহসান হাবীবসহ কয়েকজন চা-চাষি জানান, চলতি মৌসুমে ২৪-২৫ টাকা কেজিতে তারা কারখানায় চা পাতা দিচ্ছেন। মৌসুমের শুরুতে সেটা ছিল ১৫ থেকে ১৬ টাকা। পরে অবশ্য দাম বেড়েছে।
নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, নানা সমস্যার কারণে পাতার উৎপাদন কমেছে। ফলে এ দামে আমাদের পোষাচ্ছে না। নতুন করে পাতা পচা রোগে বিপাকে পড়েছি। চা বাগান টিকিয়ে রাখতে সার-কীটনাশকসহ নানা ওষুধ দিতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ অনেক বাড়ছে।
চাষিরা বলছেন, চা চাষে এখানে আলাদাভাবে নেই সারের বরাদ্দ। জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পঞ্চগড়ে চাহিদা অনুযায়ী ৪৫ হাজার ৯৮২ টন ইউরিয়া, ১৪ হাজার ৯১৬ টন টিএসপি, ১৭ হাজার ২৪৫ টন ডিএপি, ২২ হাজার ৫৪৬ এমওপি সার বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় অতিরিক্ত ১ হাজার মেট্রিক টন সার বরাদ্দ দেয় মন্ত্রণালয়। এই বরাদ্দের ভিত্তিতে ৫ উপজেলায় সার বিভাজন করা হয়। কিন্তু এ বরাদ্দ নেই চা চাষের ক্ষেত্রে।
চা বোর্ডের আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, পঞ্চগড়ে নিবন্ধিত ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান আছে ১ হাজার ৬৫টি, বড় আটটি। ছোট-বড় মিলিয়ে অনিবন্ধিত চা বাগান ৫ হাজার ৮৭৫। ১০ হাজার ২৬৭.২৮ একর জমিতে করা বাগানে চা উৎপাদন হচ্ছে। বৃহৎ এ অঞ্চলজুড়ে চা চাষ হলেও চাষিদের জন্য আলাদাভাবে নেই সারের বরাদ্দ। ফলে বোরো-আমনে বরাদ্দের সার ব্যবহার হওয়ায় চা চাষিরা সার সংকটে ভোগেন।
চাষিদের অভিযোগ, ডিলার ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে চড়া দামে সার কিনতে হচ্ছে। অন্যথায় সার মেলে না। চাষিরা চা চাষের জন্য আলাদা করে সার বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, চা বাগানের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সার বরাদ্দ দেয় না। এটা দেওয়ার কথা চা বোর্ডের। আমনের জন্য বরাদ্দকৃত সার চাষিরা চা বাগানসহ অন্যান্য ফসলে ব্যবহার করছেন। তাই এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
তেঁতুলিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তামান্না ফেরদৌস জানান, আগের মতোই সারের চাহিদা দেওয়া হয়েছে। এবার চাহিদা অনুযায়ী বিভাজনও করা হয়েছে। কিন্তু চা-সহ বিভিন্ন আবাদের কারণে সারের সংকট দেখা দিতে পারে। আরও সারের প্রয়োজন রয়েছে।
চা বোর্ডের পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকর্তা আমির হোসেন বলেন, চা চাষের জন্য আলাদাভাবে সারের কোনো বরাদ্দ নেই। কৃষি উৎপাদনে যেসব সার বরাদ্দ হয়, তা থেকেই চা বাগানে সার ব্যবহৃত হয়।
চা বোর্ডের পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরিফ খান বলেন, তীব্র খরা ও গরমের কারণে প্রথমে লাল মাকড়, পরে লোফারের আক্রমণ হয়। এগুলো দমনের পর শুরু হয়েছে পাতা পচা রোগ। আমরা চাষিদের কপার, হাইড্রোক্সাইড বা অক্সিক্লোরাইড জাতীয় ছত্রাকনাশক দুই দফায় স্প্রে করার পরামর্শ দিচ্ছি। এতে আক্রান্ত বাগানে রোগ কমছে। কয়েকদিন আগে দৈনিক পাতা সংগ্রহ নেমে গিয়েছিল তিন লাখ কেজিতে, যা এখন বেড়ে পাঁচ লাখে দাঁড়িয়েছে। আশা করা হচ্ছে, পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হবে এবং এবার সমতলে রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদন হবে। তিনি আরও বলেন, আমরা কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সারের চাহিদা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে থাকি। সেখান থেকে যা বরাদ্দ হয়ে আসে, তা ডিলারের মাধ্যমে চাষিরা সংগ্রহ করে ব্যবহার করেন। চা উৎপাদন কমে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত বছর চা উৎপাদন কমে গিয়েছিল, এটা সত্য। তবে এ বছর সরকারি রেকর্ডে বেড়েছে।
মন্তব্য করুন