হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে দেশে মুদ্রণ শিল্পের প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। সেটিও দেশ বিভাগের সময়ের কথা। তবে দ্রুতই খাতটি বিস্তৃত হয় স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে। আবার শুরুটা সনাতনী ধাঁচের হলেও পরে যুগের উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধীরে ধীরে মুদ্রণের কর্মকাণ্ডও আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে ওঠে। অনেকটা সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে সাহসী কিছু উদ্যোক্তার চেষ্টাতেই মূলত দেশে মুদ্রণ শিল্পের ভিত্তি গড়ে ওঠে। এরপর শুধুই এগিয়ে যাওয়ার গল্প। ছোট-বড় মিলিয়ে ৭ হাজার প্রতিষ্ঠানের একটি শিল্পে পরিণত হয় খাতটি। বিনিয়োগ করা হয় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার, যা সরাসরি ৫ লাখের অধিক মানুষের কর্মসংস্থানের পথ তৈরি করে। অভ্যন্তরীণ প্রয়োজন মিটিয়ে খাতটি এখন মোট রপ্তানির ৬ শতাংশ এককভাবে সরবরাহ দেওয়ার সক্ষমতায় পৌঁছেছে।
এত এত সম্ভাবনা যে শিল্পকে ঘিরে, বর্তমানে তার হালচাল কী? খাতটি কি এখনো সেই দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, না তার অবিরাম অগ্রগতিতে কোনো ছন্দপতন ঘটেছে, অর্থাৎ হালনাগাদ পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করেছে দৈনিক কালবেলা। এতে অপ্রত্যাশিত হলেও বাস্তবে সম্ভাবনাময় এই মুদ্রণ শিল্পের এখন ‘ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন’-এর মতো পিছু হটার দৃশ্যপট চিত্রায়ণের তথ্য পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু একটি তথ্য ধরে পর্যালোচনা করলেই বর্তমানে দেশের মুদ্রণ শিল্পের প্রকৃত অবস্থা কী—সেটি আন্দাজ করা সম্ভব। করোনার আগে সার্বিকভাবে মুদ্রণ শিল্পের উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী ও সেবার বাজার ছিল ১২ হাজার কোটি টাকা; কিন্তু সেই বাজার এখন নেমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকায়। অর্থাৎ, খাতটির ব্যবসার অর্ধেকই উধাও হয়ে গেছে।
কেন এই বিপর্যয়: করোনার পর থেকে এই শিল্প খাতে নানাবিধ সংকট বিরাজ করছে। আর এই সংকটের সূত্রপাত মুদ্রণ শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল কাগজের দামে সীমাহীন বৃদ্ধির ইস্যুতে। ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি করতে পারছেন না আমদানিকারকরা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্ক। এ সুযোগে স্থানীয় কাগজ উৎপাদনকারী উদ্যোক্তারা সিন্ডিকেট করে কাগজের দাম যেমন খুশি বাড়িয়ে চলেছেন। চাহিদার তুলনায় বাজারে কাগজের সরবরাহ দিচ্ছেন কম। এর বিপরীতে অন্য সব উপকরণের দামও বেড়ে গেছে। অন্যদিকে, কাগজসহ বিভিন্ন উপকরণের ঘাটতিতে দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রেতারা মুদ্রণ কাজের অর্ডার দিচ্ছেন কম। এতে করে ছাপাখানার রেট সে হারে বাড়ানো সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে মুদ্রণ শিল্পের উদ্যোক্তাদের মধ্যেও অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় কেউ কেউ ব্যবসায় টিকে থাকতে আগের থেকেও কম রেটে অর্ডার নিচ্ছেন। এতে করে অন্যরা আশানুরূপ কাজ পাচ্ছেন না। করোনার পর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা হলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ খাতটিকে নতুন সংকটের দিকে ধাবিত করে। এমতাবস্থায় আগে যেখানে মুদ্রণ শিল্পে দিনে ১৫ ঘণ্টা কাজ চলত, ধীরে ধীরে সেই কর্মঘণ্টা দিনে ৮ ঘণ্টায় নেমে আসে। এর পাশাপাশি সপ্তাহে বাধ্য হয়ে বেশিরভাগ কারখানা সপ্তাহে দুদিন ছুটি রাখতে বাধ্য হচ্ছে। এ ছাড়া করোনাজনিত মন্দার ঢেউ সামাল দিতে না পেরে মুদ্রণ শিল্পের ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা অনেকে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। এসব কিছু মিলেই মুদ্রণ শিল্পে আজকের বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ফলে এ খাতের বিপুলসংখ্যক শ্রমিক কর্মহীন হওয়া এবং এই সংকট আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মুদ্রণ শিল্পে কী ধরনের কাজ হয়: সব ছাপাখানায় সব ধরনের কাজ হয় না। এক-দেড় হাজার প্রেসে সারা বছরই গার্মেন্টস এক্সেসরিজ যেমন হ্যান্ড ট্যাগ, ইনলে বোর্ড ও লেবেল তৈরি হয়। আবার পাঠ্যপুস্তকসহ বই ছাপার সঙ্গে যুক্ত হাজার খানেক প্রেস। যেখানে সরকারি পাঠ্যপুস্তক, আর সহায়ক পুস্তক (গাইড বই), উচ্চস্তরের বই ও গল্প-উপন্যাস ছাপা চলে সারা বছর। ওষুধের মোড়ক ছাপার কাজ করে কিছু ছাপাখানা। এ ছাড়া বাকি ছাপাখানাগুলো বই, ক্যালেন্ডার, ডায়েরি, ভিজিটিং কার্ড, শুভেচ্ছা কার্ডসহ ব্যাংকের বিভিন্ন সামগ্রী ছাপায়।
২ হাজার কারখানায় আধুনিক প্রযুক্তি: বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির হিসাবে, সারা দেশে ৭ হাজার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শুধু রাজধানী ও এর আশপাশে প্রায় ৫ হাজার ছাপাখানা আছে। রাজধানীর পল্টন, নীলক্ষেত, সূত্রাপুর, গুলিস্তান, ওয়ারী, নারিন্দা ও বাংলাবাজারেও রয়েছে ছাপাখানা। এদের বেশিরভাগই সমিতির সদস্য। এর বাইরে প্রতিটি জেলাতেই রয়েছে ছাপাখানা। বর্তমানে অত্যাধুনিক মুদ্রণসরঞ্জাম নিয়ে কাজ করছে প্রায় দুই হাজার মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান চার রঙের মুদ্রণযন্ত্র নতুন সংযোজিত হয়েছে।
সরেজমিন যা জানা গেল: গত সোমবার ও বুধবার ফকিরাপুল ঘুরে দেখা গেছে, ছাপাখানাগুলোতে মুদ্রণের কাজ করছে শ্রমিকরা। তবে কাজের চাপ আগের মতো নেই। কাজের অর্ডার বেশি না থাকায় শ্রমিকদের মধ্যে তেমন তাড়াহুড়ো নেই।
প্রতিষ্ঠান মালিকরা বলেন, দেশের মিল মালিক এবং আমদানিকারকরা সিন্ডিকেট করে কাগজের দাম বাড়াচ্ছেন। পাশাপাশি ডলার সংকটের কারণে আমদানিও হচ্ছে কম। এই অজুহাতে মিল মালিক এবং আমদানিকারকরা কাগজ মজুত করে ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছেন। সরকারি মিলগুলো যদি চালু থাকত, তাহলে কাগজের এই সংকট থাকত না। সিন্ডিকেট বন্ধ হলে সরকারও লাভবান হতো, মুদ্রণ শিল্পও উন্নতি করত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা।
স্টার প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের মালিক শেখ তমিজউদ্দিন কালবেলাকে বলেন, আগে মাসে ১০ লাখ টাকা লাভ হতো। এখন ২ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়। বর্তমানে শুধু সিজনাল কিছু ব্যবসা হয়, সে সময়টায় কিছুটা পুষিয়ে নেওয়া হয়। এ ছাড়া সারা বছর তেমন কোনো লাভ থাকে না। বছরের শেষ সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ক্যালেন্ডার, ডায়েরি, বই ছাপানোর কাজ হয়। সে সময়টা একটু বেশি কাজ থাকে। তিনি বলেন, আগে প্রিন্টিং রেট ছিল হাজারে ২০০ টাকা, এখন সেটা কমে ১৫০ টাকা হয়েছে, ৮০ টাকায়ও অনেকে কাজ করেন।
ফকিরাপুলের শ্যাডো প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের ম্যানেজার সৈয়দ জাবেদ হোসেন জানান, আগে ২৪ ঘণ্টায় কাজ হতো। এখন বিকেল ৫টায় বন্ধ হয়ে যায়। আগে গড়ে অর্ডার আসত ১ লাখ, এখন তা ২০ হাজারে নেমেছে। আগে দিনে ৩০ হাজার টাকার মতো কাজ হতো। এখন সেটা ১০ হাজারে নেমেছে।
এসএম ট্রেডিংয়ের কর্ণধার শাহাদাত হোসেন জানান, যে যেভাবে পারছে ব্যবসা করছেন, কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছেন না। এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে একটা রেট শিডিউল এ সংকটের অনেকটা অবসান হতে পারে।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. জহুরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, পেপার মিল মালিকরা মনোপলি বাজার তৈরি করেছেন, তারা তাদের মার্কেটটা ঠিক রাখছেন আর মুদ্রণ শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য যা যা করা দরকার তার সবটাই করছেন। যে পরিমাণে কাগজের পাল্প আমদানি দরকার, তার ১০ ভাগও করছেন না তারা। এ কারণেই কাগজের দাম বেড়েছে।
বাজার খারাপ হওয়ার পেছনে তিনি নিজেদেরও দোষারোপ করেন। বলেন, যে প্যাকেটটা তৈরি করতে আগে ২ টাকা লাগত, এখনো ওই প্যাকেটটার খরচ ২ টাকা; কিন্তু দেখা গেল, আমি সেটি ১ টাকা ৯০ পয়সায় করে দিচ্ছি শুধু টিকে থাকার জন্য। এসব কারণে এরই মধ্যে অনেক ছোট প্রতিষ্ঠান হারিয়ে গেছে।
মন্তব্য করুন