দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে খাদ্যপণ্যের দাম। এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতিও বাড়ছে ক্রমাগত। মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখা ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কাজগুলোর অন্যতম হলেও দুই সূচকেই ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানটি। মূলত, মুদ্রানীতির বিপরীতমুখী পদক্ষেপের কারণেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে অস্থিরতা কমানো যাচ্ছে না মুদ্রাবাজারেরও। বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক নীতিবিরোধী আউট-অব-বাস্কেট প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই দেশের অর্থনীতির বড় ক্ষতি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন আর্থিক অস্থিরতা সামাল দিতে প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত অর্থবছর বাজেট বাস্তবায়নে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে রেকর্ড ঋণ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দেশের মূল্যস্ফীতি লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছরের শুরুতে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে ব্যাংক থেকে ঋণ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। এতে ব্যাংক ঋণসহ সব ধরনের ঋণ ও আমানতে বাড়ে সুদহার। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির অর্থ হলো, বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংককে অব্যাহত ঋণ সুবিধা দিয়ে বাজারে মুদ্রা সরবারহ বাড়াচ্ছে। এতে দেশের মূল্যস্ফীতিতে লাগাম কোনোভাবেই টানা যাচ্ছে না।
তথ্য বলছে, গত রোববারও বাংলাদেশ ব্যাংক ২২ ব্যাংক ও তিন আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ১৫ হাজার কোটি টাকার স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ধার দিয়েছে। এর মাধ্যমে শুধু এপ্রিলেই ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধার দিয়েছে ২ লাখ ৯৬ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা। আর আন্তঃব্যাংক হিসাব করলে ব্যাংকগুলোর ধার সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার বেশি।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, ব্যাংকগুলোতে যে তারল্য সংকট দেখা যাচ্ছে, তার অনেকটাই তৈরি করা। রেপোর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে ধার দেওয়ায় তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বেশি সুদে সরকারের বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করছে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিতে রেপোতে ধার দেওয়া সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। এ কারণেই মূল্যস্ফীতিতে কোনো প্রভাব পড়ছে না। এক কথায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেওয়া নীতিগুলোর বেশিরভাগই ভুল। এজন্যই আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফেরানো যাচ্ছে না।
তথ্য বলছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক। অর্থাৎ, বাজারে টাকার জোগান কমানোর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে নিয়ে আসা। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রম পুরো উল্টো ধারায় চলছে। দেশের আর্থিক বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছর প্রচলিত ব্যাংকগুলোতে ১৩ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকা তারল্য সহায়তা দিয়েছে, যা গতবারের তুলনায় সাড়ে সাত গুণ বেশি। ওই বছর তারল্য সহায়তার পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। ডলার বিক্রি ও অন্যভাবে বাজার থেকে ডলার তুলে নেওয়া হলেও ব্যাংকগুলোকে বেশি তারল্য সহায়তা দেওয়ায় মূল্যস্ফীতিতে লাগাম টানা যাচ্ছে না। অর্থাৎ মুদ্রাবাজারে টাকার প্রবাহ কমছে না।
বর্তমান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ২০২২ সালের জুলাইয়ে দায়িত্ব গ্রহণের সময় বলেছিলেন মুদ্রানীতির আলোকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করবেন। সেই সময় দেশের মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এর মধ্যে পেরিয়েছে প্রায় দুই বছর। সবশেষ গত মার্চে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে বেড়েছে। এমনকি ১৩ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর অবস্থান করছে। ২০২৩ সালের ৭ নভেম্বর অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশ ও আগামী জুনের মধ্যে তা ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসবে। কিন্তু তা আর হয়নি।
এরপর পুনর্গঠিত মুদ্রানীতি কমিটির প্রথম সভায় মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। গত ২৬ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সব ধরনের সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়। ওইদিন সাংবাদিকদের লিখিতভাবে জানানো হয় অর্থবছরের প্রথমার্ধ শেষে তথা ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশ এবং অর্থবছর শেষে অর্থাৎ জুনে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। এ লক্ষ্যের কথা জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বর্তমান ডেপুটি গভর্নর ড. মো. হাবিবুর রহমান।
কিন্তু ডিসেম্বর শেষে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গৃহীত পদক্ষেপ কাজে আসেনি। এমন প্রেক্ষাপটে গত ১৮ জানুয়ারি নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়। এতে মুদ্রানীতির কাঠামো পরিবর্তন করে দ্রুততম সময়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা দেন গভর্নর। ডিসেম্বরের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতার জন্য সময় চান তিনি। কিন্তু চার মাস পেরিয়ে গেলেও মূল্যস্ফীতিতে লাগাম টানা যায়নি।