সেলিব্রিটি ব্যবসায়ী ছিলেন না তিনি। এরপরও টানা পনেরো বছর দেশসেরা করদাতা নির্বাচিত হয়েছেন মো. কাউছ মিয়া। গত সোমবার রাতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
মো. কাউছ মিয়া একজন জর্দা ব্যবসায়ী। হাকীমপুরী জর্দার মালিক তিনি। তবে এখন তিনি সবার কাছে পরিচিত দেশের শীর্ষ করদাতা হিসেবে। ২০১৫-১৬ অর্থবছর দেশে সর্বোচ্চ কর দিয়েছেন। স্বীকৃতি হিসেবে গত মাসে ট্যাক্স কার্ড পেয়েছেন। আগের অর্থবছরও ব্যক্তি পর্যায়ে সেরা করদাতা হয়েছিলেন। শীর্ষ ১০ করদাতার তালিকায় তিনি ছিলেন কয়েক বছর ধরেই। এনবিআরের সেরা করদাতা পুরস্কার সব সেলিব্রিটি ও বড় ব্যবসায়ীকে পেছনে ফেলে তিনিই জয় করে আসছিলেন। মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন এই কাউছ মিয়া? কীভাবে তার উত্থান হয়েছিল? মায়ের দেওয়া আড়াই হাজার টাকা পুঁজি করে ১৯৫০ সালে ব্যবসা শুরু করেন কাউছ মিয়া। মৃত্যুর আগপর্যন্ত সফলভাবে ব্যবসা করে গেছেন। বাবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চাঁদপুরের পুরান বাজারে মুদি দোকান দেন। এরপর ধীরে ধীরে ১৮টি ব্র্যান্ডের সিগারেট, বিস্কুট ও সাবানের এজেন্ট হন। ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি চাঁদপুরেই ব্যবসা করতেন।
১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন কাউছ মিয়া; শুরু করেন তামাকের ব্যবসা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ৪০-৪৫ ধরনের ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট থাকলেও তার মূল ব্যবসা ছিল তামাক বেচাকেনা। হাকীমপুরী জর্দার মালিক হিসেবে সারা দেশে পরিচিত তিনি; হাকীমপুরী জর্দার কৌটায়ও তার ছবি। একবার আমদানি ব্যবসার লাইসেন্স নিয়েছিলেন কাউছ মিয়া। কিন্তু এ ব্যবসায় কারসাজি না করলে টিকে থাকা মুশকিল—এই চিন্তা থেকে ছেড়ে দিলেন ওই পথ। নদীপথে পণ্য পরিবহনে ১৮টি কার্গো জাহাজ আছে কাউছ মিয়ার। এই ব্যবসা দেখাশোনা করেন তার ছেলেরা।
কাউছ মিয়া ১৯৫৮ সালে কর দেওয়া শুরু করেন। ২০১৯ সালে এনবিআরের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘আগে টাকা-পয়সা এখানে-সেখানে রাখতাম। এতে নানা ঝামেলা ও ঝুঁকি ছিল। ১৯৫৮ সালে প্রথম কর দিয়ে ‘ফ্রি’ হয়ে গেলাম। এরপর সব টাকা-পয়সা ব্যাংকে রাখতে শুরু করলাম। হিসাবনিকাশ পরিষ্কার করে রাখলাম।’ ১৯৬৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এক নম্বর করদাতা হয়েছিলেন কাউছ মিয়া।
২০১৯ সালের সেরা করদাতা পুরস্কার দেওয়ার সময় কাউছ মিয়াকে নিয়ে এক গল্প বলেছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তৎকালীন চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। তিনি বলেন, কাউছ মিয়া প্রতি বছর আয়কর বিবরণী জমা দেন। পুরস্কার দেওয়ার সময় এলে সংশ্লিষ্ট মাঠপর্যায়ের কর কর্মকর্তারা কাউছ মিয়াকে বলেন, ‘এবার মনে হয় আপনি সর্বোচ্চ করদাতা হতে পারবেন না।’ তখন কাউছ মিয়া বলেন, কত টাকা দিলে সর্বোচ্চ করদাতা হতে পারব? এর দু-এক দিন পরই তিনি ৫ কোটি টাকার চেক পাঠিয়ে দেন। শীর্ষ করদাতা হিসেবে কাউছ মিয়া কত কর দেন, সেখানে এর ধারণা পাওয়া যায়। জর্দার ব্যবসা থেকে তখন (২০১৭ সাল) মাসে ৪০-৫০ লাখ টাকা কর দিতে হতো। সব মিলিয়ে কাউছ মিয়া প্রতি বছর প্রায় ৪৫ কোটি টাকা কর দিতেন বলে এনবিআর সূত্রে জানা যায়। নিজের বিষয়ে অনেকটাই অকপট ছিলেন কাউছ মিয়া। কালো টাকা সাদা করেছেন; সে কথাও ওই জীবনীতে পাওয়া যায়: ‘সরকার যখন অঘোষিত টাকা বৈধ করার জন্য ১০ শতাংশ কর ঘোষণা করেছে, তখন কাউছ মিয়া সরকারের ঘোষণায় সাড়া দিয়ে সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অঘোষিত টাকা সাদা করে নিয়েছেন। গাড়ি বোঝাই করে ব্যবসায়িক মুনাফার সব অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়ে সাদা করে নিয়েছেন। তখন তিনি মুনাফার অর্থ দিয়ে ঢাকা শহরে কয়েকটি বাড়ি ও জায়গা কিনেছেন। কাউছ মিয়ার বিশেষত্ব হলো ঢাকার বড় ব্যবসায়ীদের মতো গুলশান-বনানী কিংবা মতিঝিলে বিলাসবহুল কার্যালয় নেই তার। পুরান ঢাকার আগা নওয়াব দেউড়ি রোডের হাকীমপুরী জর্দার কারখানার একটি কক্ষই তার চেম্বার। মৌলভীবাজার থেকে সরু এই গলিপথ ধরে কিছুটা পথ হাঁটলেই তার কারখানা। সেখানেই বসতেন তিনি। কিন্তু গুলশান-বনানী, মতিঝিলের ডাকসাইটে ব্যবসায়ীদের পেছনে ফেলে পুরান ঢাকার ঘুপচি গলির এই ব্যবসায়ীই প্রতি বছর সর্বোচ্চ করদাতা হতেন।