কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২৩, ০২:৩৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাকৃবি উইমেন সাইক্লিং ক্লাব

চাকায় চাকায় স্বপ্ন পাড়ি

চাকায় চাকায় স্বপ্ন পাড়ি

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরসার নাম সাইকেল। হলগুলো থেকে ক্লাস ও প্রশিক্ষণ মাঠের দূরত্ব অনেক। প্যাডেল দাবিয়ে রোজ ছুটে চলছেন শিক্ষার্থীরা। চাকায় চাকায় পাড়ি দিচ্ছেন পাঁচ-সাত কিলোমিটার। জব্বারের মোড় থেকে ডেইরি ফার্ম ল্যাব, কেআর মার্কেট থেকে আমবাগান, এগ্রোনমি ফিল্ড কিংবা ভেটেরিনারি অনুষদ থেকে রিসার্চ অ্যানিমেল ফার্ম। এ গতিতে যেন ছাত্রীরা পিছিয়ে না থাকে, সেজন্য কাজ করে চলেছে বাকৃবি উইমেন সাইক্লিং ক্লাব। ক্লাবটি নিয়ে লিখেছেন ফাতেমা তুজ্জোহরা ও তানিউল করিম জীম-

শুরুটা ২০১৭ সালে। তখন ক্যাম্পাসের হাতেগোনা দু-একজন ছাত্রী সাইকেল চালাতে জানতেন। এত বড় ক্যাম্পাসে যারা সাইকেল চালাতে জানতেন না, তাদের নির্ভর করতে হতো রিকশার ওপর। অথবা হেঁটেই ক্লাস কিংবা ব্যবহারিকের মাঠে যেতে হতো তাদের। হয় খরচ করো, না হয় খেটে মরো দশা অবস্থা ছিল। সেই দৃশ্যের এখন আমূল বদল হয়েছে। এ ক্যাম্পাসে এখন মেয়েদেরও নিত্যসঙ্গী পরিবেশবান্ধব সাইকেল। যদিও মেয়েদের জন্য এ পথচলা সহজ ছিল না।

মেয়ে হয়ে সাইকেল চালাবে! কেমন মেয়ে, এমন মন্তব্য শুনতে হয়েছে অনেককেই। কোনো মেয়ে সাইকেল চালিয়ে গেলে তার দিকে বাঁকা চোখেও তাকাত আশপাশের অনেকে। এসব কারণে শুরুর দিকে অনেক ছাত্রী সাইকেল চালাতে আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু ক্লাস করতে একেক সময় একেক জায়গায় যেতে হয়। যার গড় দূরত্ব প্রায় পাঁচ-ছয় কিলোমিটার। হেঁটে এতদূর ক্লাস ধরা অসম্ভব। এত বড় ক্যাম্পাসে চলাচলের জন্য রিকশার ওপর ভরসা করে থাকাটাও মেনে নিতে পারেননি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন প্রগতিশীল শিক্ষক। তাদের মধ্যে অন্যতম পোলট্রি সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. সুবাস চন্দ্র দাস। তার উদ্যোগ ও অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো যাত্রা করে বাকৃবি উইমেন সাইক্লিং ক্লাব।

চাকায় চাকায় পেরিয়েছে প্রায় ছয় বছর। ছয় বছরে সংগঠনটি প্রায় এক হাজার নারী শিক্ষার্থীকে সাইকেল চালানো শিখিয়েছে। বাকৃবির ছাত্রী হলে এখন সাইকেল রাখার জায়গা নেই রীতিমতো। হল প্রশাসনও সাইকেল স্ট্যান্ড সম্প্রসারণে বাধ্য হচ্ছে।

মেয়েদের পাঁচটি হলেই রয়েছে উইমেন সাইক্লিং ক্লাবের হল প্রতিনিধি এবং অনুষদভিত্তিক অনুষদ প্রতিনিধি। প্রত্যেকটি ছাত্রী হলে উইমেন সাইক্লিং ক্লাবের নিজস্ব সাইকেলও রয়েছে। এগুলো সাইকেল চালানো শেখার কাজে লাগে। আবার এখান থেকে সারা দিনের জন্য ৫ টাকায় সাইকেল ভাড়াও নেওয়া যায়।

এখন প্রত্যেক শুক্রবার বাকৃবি হেলিপ্যাডে সাইকেল চালানো শেখানো হয়। সেখানে আবাসিক, অনাবাসিক সব ছাত্রীই শিখতে পারেন। ক্লাবের সদস্যরা পালাক্রমে শেখান নতুন সদস্যদের। দুই-এক দিন কিংবা একবেলাতেই শিখে যান অনেকে। ভালোমতো শিখতে লাগে বড়জোর চার-পাঁচ দিন।

ভেটেরিনারি অনুষদের শিক্ষার্থী সাদিয়া আফরোজ এশা জানান, সাইকেল জিনিসটা আমার বরাবরই ভালো লাগে। যখন শিশু ছিলাম তখন বাবা-মার সঙ্গে গ্রামে যেতাম। বাবা ওখানে গিয়ে একটা ছোট সাইকেল ভাড়া করত আমার জন্য। সেই সাইকেলে গ্রামে টো টো করে বেড়াতাম। অবশ্য চালানোর চেয়ে আছাড় খেয়ে পড়েছি বেশি। আস্তে আস্তে বড় হলাম। গ্রামেও যাওয়া কমে গেল। পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। এর মাঝে সাইকেল আর শেখা হয়নি। তবে যখনই রাস্তায় দেখতাম কাউকে সাইকেল চালাতে, মনে হতো ইশ আমিও যদি এভাবে সাইকেল নিয়ে ঘুরতে পারতাম! এরপর এলাম ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। এত বড় আর সুন্দর ক্যাম্পাস যে, সবসময় ঘুরতে ভালো লাগে। তারপর দেখি অনেকে সাইকেলে ঘুরে বেড়ায়। দেখে ইচ্ছা জাগল সাইকেল নিয়ে ঘোরার। কিন্তু শেখাও তো দরকার। এই ক্যাম্পাসে এসে পেলাম সেই সুযোগ। বন্ধুদের সহায়তায় যেদিন শিখেই ফেললাম সেদিনের স্মৃতি আজীবন মনে থাকবে। আমবাগানের রাস্তায় সাইকেল নিয়ে যখন যাচ্ছিলাম অন্যরকম এক আনন্দ হচ্ছিল! মুক্ত আকাশে পাখা মেলে উড়ে বেড়ানোর অনুভূতি। সাইকেল চালিয়ে চুল উড়িয়ে তেমনি এক অনুভূতি পাচ্ছিলাম। এখনো সুযোগ পেলেই বের হয়ে পড়ি সাইকেল নিয়ে। তবে প্রথম দিনের সেই অনুভূতি আজীবন আমার মনে গাঁথা।

সাইকেল নিয়ে ঘোরাঘুরির বিষয়ে সানজিদা হায়দার নামের অন্য শিক্ষার্থী জানান, শুক্রবার মানে আমাদের ঘোরাঘুরির দিন। সিনিয়র-জুনিয়ররা মিলে বের হই সকালে। নদের পাড় দিয়ে শুরু হয় যাত্রা। সকালের ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে শীতল বাতাসে আর পাখির কিচিরমিচির অন্য মাত্রা যোগ করে আমাদের যাত্রায়। এর পরে ঘুরতে ঘুরতে চলে যায় আমবাগান এবং লিচু বাগানের দিকে। চলতে চলতে আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও হয় অনেক সময়। কে কার আগে যেতে পারে। এদিকে নিজেকে ফিট রাখতে বেশিক্ষণ সাইকেল চালাতে চায় অনেকে। সব ঘোরা শেষে আবদুল জব্বার মোড়ে এসে হয় সকালের নাস্তা। তার পরেই শুরু হয় চায়ের আড্ডা। একদিন চলে যাব ক্যাম্পাস ছেড়ে, ব্যস্ত হয়ে পড়ব নানা কাজে। কিন্তু সাইকেলের চাকায় চাকায় স্মৃতিগুলো মনে থাকবে।

চতুর্থ বর্ষের রাজিয়া ইসলাম রাখি বলেন, শখ থাকা সত্ত্বেও সাইকেল চালানো শেখা হয়ে ওঠেনি এতদিন। কিন্তু ভার্সিটিতে এসে ক্লাবটি সম্পর্কে জানতে পারি। তারপর আমি উইমেন সাইক্লিং ক্লাবের মাধ্যমে সাইকেল চালানো শিখি। এখন অনেক দ্রুত চালাতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে জায়গাগুলো ঘুরে দেখার ইচ্ছা ছিল, সেখানে এখন সাইকেল চালিয়ে অনায়াসে যেতে পারি।

ক্লাবটির আয়োজনে দিবসকেন্দ্রিক থাকে নানা কর্মসূচি। আন্তর্জাতিক নারী দিবস, মা দিবস, আন্তর্জাতিক সাইক্লিং দিবসে মেয়েদের সাইকেল শোভাযাত্রা ও সাইক্লিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করে এ ক্লাব। এবার নারী দিবসে চার সফল নারী শিক্ষার্থী ও একজন নারী শিক্ষককে দেওয়া হয় ‘স্পার্কেল অ্যাওয়ার্ড’। উইমেন সাইক্লিং ক্লাবের সদস্যরা নিজেরা গ্রুপ করে সাইক্লিং করতে বের হন ক্যাম্পাসের আনাচে-কানাচে। এখন অনায়াসেই ১ হাজার ২০০ একর ক্যাম্পাসের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সৌন্দর্য উপভোগ করেন তারা।

উইমেন সাইক্লিং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা বাকৃবির পোলট্রি সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. সুবাস চন্দ্র দাস বলেন, বাকৃবিতে ক্লাস ও ল্যাবগুলো বেশ দূরে দূরে। ছাত্ররা এতদিন সাইকেলে সহজেই যাতায়াত করেছে। ছাত্রীরা পড়ত বিপদে। সেই ভাবনা থেকে চিন্তা করেছিলাম ওদের সংঘবদ্ধ হওয়া উচিত। এখন ক্যাম্পাসে মেয়েরা সাবলীলভাবে সাইকেল চালাতে পারে। তাদের সাইকেল কেনার হারও বেড়েছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাষ্ট্রপতির আদেশে ৩৪ পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি

ডাকসু নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাহার করলেন ২১ প্রার্থী

কলেজ শিক্ষার্থী হত্যা মামলায় ৫ জনের যাবজ্জীবন

জাতীয় পরিচয়পত্র করতে গিয়ে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ আটক

কাজলকে জুম করে অস্বস্তিকরভাবে ক্যামেরাবন্দি, ক্ষোভ মিনি মাথুরের

মানবদেহে বিশ্বের প্রথম মাংসখেকো মাছি শনাক্ত

টেকনাফের সাবেক চেয়ারম্যান জাফরের স্ত্রীর কারাদণ্ড

ডেঙ্গুতে আরও ৩ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৪১২

সারা দেশে একযোগে ৫৩ বিচারককে বদলি

‘রুমিন ফারহানাসহ সব নারীর প্রতি স্লাট-শেমিংয়ের বিরুদ্ধে আমার স্পষ্ট অবস্থান’

১০

ফল প্রকাশের দাবিতে রাবির আরবি বিভাগে শিক্ষার্থীদের তালা

১১

খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা : বুলু

১২

সমুদ্রে পর্যটকদের জন্য জরুরি নির্দেশনা

১৩

রিয়াল ছেড়ে ফরাসি ক্লাবে যাচ্ছেন স্প্যানিশ তারকা

১৪

বিশ্লেষণ / চীন-ভারতের বাঁধ যুদ্ধ : ব্রহ্মপুত্রের ভাগ্য নিয়ে শঙ্কায় বাংলাদেশ

১৫

নাফ নদ থেকে আরও ৭ জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি

১৬

কেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে চান, জানালেন সাদিক কায়েম

১৭

সাংবাদিক তুহিন হত্যাকাণ্ডে চার্জশিট দাখিল

১৮

স্পন্সর হারিয়ে কত টাকার ক্ষতির মুখে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড?

১৯

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জনপ্রতিনিধি হওয়ার কোনো স্বপ্ন আমার নেই : তারিকুল

২০
X