রাজকুমার নন্দী
প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০২৩, ০২:৫৫ এএম
আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০২৩, ১২:৩৯ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
একদফার আন্দোলন

বিদেশি চাপ কাজে লাগিয়ে এগোতে চায় বিএনপি

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

একদফা দাবি আদায়ে মাঠের কর্মসূচির পাশাপাশি দেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের ওপর বিদেশিদের চাপকে কাজে লাগিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায় বিএনপি। ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচিতে পুলিশ ও সরকারি দলের হামলার পর জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতি এবং ঢাকায় মহাসমাবেশের আগের দিন বাংলাদেশ বিষয়ে জাতিসংঘে মার্কিন দূতকে ১৪ কংগ্রেস সদস্যের চিঠিকে পুলিশ ও সরকারের ওপর বড় চাপ হিসেবে দেখছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা দলটি।

বিএনপি নেতাদের দাবি, ওই বিবৃতি ও চিঠি নিরপেক্ষ নির্বাচন ইস্যুতে তাদের রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতিফলন। আন্তর্জাতিক সংস্থা দুটির বিবৃতিতে বাংলাদেশে বিক্ষোভকারীদের ওপর অতিরিক্ত বল প্রয়োগ না করতে পুলিশের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। দলটির প্রত্যাশা, আন্তর্জাতিক এই অব্যাহত চাপের পরিপ্রেক্ষিতে চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আগামীতে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে পুলিশ।

সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে আন্দোলন শুরুর পর থেকেই কূটনৈতিক তৎপরতাও বাড়ায় বিএনপি। ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচিতে পুলিশি হামলা-মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ২ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, জার্মানিসহ ঢাকায় নিযুক্ত ২৫টি দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে দলটি। সেখানে অবস্থান কর্মসূচিতে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশ ও সরকারি দলের হামলা, গুলিবর্ষণ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ, মামলা-গ্রেপ্তার, নির্যাতনের ঘটনা ভিডিও ফুটেজসহ কূটনীতিকদের সামনে তুলে ধরা হয়। শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে যে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়, সেটাও কূটনীতিকদের জানায় বিএনপি। এ ছাড়া ২৮ জুলাই মহাসমাবেশের আগের দিন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গেও বৈঠক করেন দলটির নেতারা।

এদিকে বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিতে হামলার পর গত শুক্রবার বাংলাদেশ ইস্যুতে প্রেস নোট প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশন। সেখানে আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটি বাংলাদেশে অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজনের স্বার্থে শান্তিপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে সব রাজনৈতিক দল, তাদের সমর্থক এবং নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে পুলিশের অতিরিক্ত বল প্রয়োগের বিষয়টি অবশ্যই দ্রুত তদন্ত করতে এবং দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি।

এ ছাড়া একই দিন এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বিক্ষোভকারীদের ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ বন্ধের আহ্বান জানায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিতে বিক্ষোভকারী ও দলের নেতাদের ওপর সহিংস আক্রমণের খবর যাচাই করে এ আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। আন্তর্জাতিক এই মানবাধিকার সংস্থাটির অন্তর্বর্তীকালীন দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক আঞ্চলিক পরিচালক স্মৃতি সিংহ বলেন, অ্যামনেস্টি যে ছবি ও ভিডিওগুলো যাচাই করেছে, সেগুলো বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে আলোকপাত করে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচও (এইচআরডব্লিউ) গত বুধবার বাংলাদেশ নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। সংস্থাটির অভিযোগ, বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিক্ষোভকারীদের ওপর অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করা হচ্ছে। বিরোধী নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এইচআরডব্লিউর এশিয়াবিষয়ক উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বিবৃতিতে বলেছেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর পরিচালিত দমন অভিযানকে নির্বাচন গণতান্ত্রিক না হওয়ার সতর্ক সংকেত হিসেবে দেখা উচিত হবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের।

এদিকে গত সোমবার এক টুইট বার্তায় বাংলাদেশে বিরোধী দলের ওপর শক্তি প্রয়োগে বিরত থাকার আহ্বান জানান মতপ্রকাশ ও সমাবেশের অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ক্লেমেন্ট ভউল। একই দিন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে চলমান সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে একটি বিশ্বাসযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিতে মার্কিন পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেন, গত সপ্তাহে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিক্ষোভকে ঘিরে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। আমরা বাংলাদেশ সরকারকে সহিংসতার ঘটনাগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত এবং সহিংস অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানাই। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে বর্তমান রাজনৈতিক সহিংসতার পরিবেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না।

এ ছাড়া ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশের আগের দিন বাংলাদেশ বিষয়ে জাতিসংঘে মার্কিন দূতকে ১৪ কংগ্রেস সদস্য চিঠি দিয়েছে। সেখানে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানান তারা। একই সঙ্গে তারা জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে বাংলাদেশের সদস্যপদ স্থগিত রাখার আহ্বান জানান। চিঠিতে কংগ্রেস সদস্যরা বলেন, ‘নির্বাচনে জালিয়াতি, সহিংসতা, ভয়ভীতির অতীত ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনা সরকার সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন হতে দেবেন—এমন বিষয়ে আমরা অত্যন্ত সন্দিহান।’

বিএনপি নেতারা বলছেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে গণতান্ত্রিক বিশ্ব ও বন্ধু রাষ্ট্রগুলো তাদের অবস্থান এরই মধ্যে স্পষ্ট করেছে। বাংলাদেশে মানবাধিকার রক্ষা ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে তারা দীর্ঘদিন ধরে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে। কারণ, তারা এদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচিতে পুলিশ ও সরকারি দলের হামলার ঘটনায় বিবৃতির মধ্য দিয়ে তাদের স্পষ্ট অবস্থান আবার সামনে চলে এসেছে।

এর আগে বিএনপির প্রত্যাশা ছিল, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে গত মে মাসে মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকায় পরিবর্তন আসবে; কিন্তু তাদের আচরণে যে কোনো পরিবর্তন আসেনি, অবস্থান কর্মসূচিতে মারমুখী ভূমিকায় সেটা প্রমাণিত হয়েছে বলে দলটির মূল্যায়নে উঠে এসেছে। তবে এ কর্মসূচিকে ঘিরে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা যে কড়া বিবৃতি দিয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ প্রশাসন আগামীতে বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে প্রত্যাশা দলটির। অন্যথায় বিদেশি এই চাপ আরও বাড়তে পারে বলে অভিমত বিএনপি নেতাদের।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান কালবেলাকে বলেন, ২৯ জুলাই বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিতে আক্রমণের ঘটনার পরম্পরায় পশ্চিমা বিশ্ব, গণতন্ত্রকামী বিভিন্ন দেশ, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে—তাতে এই সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব নয়, সেটি স্পষ্ট হয়েছে। তিনি বলেন, বিএনপি শান্তিপূর্ণ উপায়ে সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে আন্দোলন করছে। এই আন্দোলন আরও বেগবান হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সরকারের পতন নিশ্চিত হয়।

জানা যায়, ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচিকে ঘিরে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন কৌশলে পরিবর্তন এনেছে বিএনপি। রাজপথে চূড়ান্ত আন্দোলনে যেতে এখন সেপ্টেম্বরকে টার্গেট করেছে দলটি। সফল মহাসমাবেশের পরদিন অবস্থান কর্মসূচিতে নেতাকর্মীর উপস্থিতি কম হওয়ায় এবার সতর্কতার সঙ্গে নতুন কর্মসূচি দেবে। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা মূল্যায়ন করে চলতি আগস্ট মাসে ধারাবাহিক আরও জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি দিতে পারে বিএনপি। তবে শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক কর্মসূচির পরিবর্তে কেন্দ্র ও তৃণমূল ঘুরেফিরে নতুন এই কর্মসূচি পালিত হতে পারে। এ সময়ে ঢাকাসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরে সমাবেশ, অবস্থান, পদযাত্রা, বিক্ষোভের মতো কর্মসূচি হতে পারে। নতুন কর্মসূচি প্রণয়নে এখন শরিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছে বিএনপি। ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পর আন্দোলন ফের বেগবান করবে বিএনপি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগেই রাজপথে চূড়ান্ত ফয়সালা করতে চায় দলটি। অক্টোবরেই নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হতে পারে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাকসুতে প্রথম দিনে ৫ জনের মনোনয়ন সংগ্রহ 

ফিলিস্তিনিদের ৩০০০ জলপাই গাছ উপড়ে ফেলল ইসরায়েলি বাহিনী

দেশে ১ কোটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে : টুকু

ভারতে গ্রেপ্তার বাংলাদেশি পুলিশ কর্মকর্তা ১৪ দিনের জেল হেফাজতে

বিয়ের আসরেই ১৫ লাখ টাকা খোয়ালেন বর

ডিজিটাল ব্যাংক খুলতে লাগবে কমপক্ষে ৩০০ কোটি টাকা

ইউল্যাবে অনুষ্ঠিত হলো বৃহত্তম মার্কেটিং সামিট 

থানার ব্যারাকে ধর্ষণের শিকার সেই নারী সতীনের সংসার করতে চান

খালেদা জিয়ার সঙ্গে ইসহাক দারের সাক্ষাতে রাজনৈতিক আলোচনা হয়নি : ডা. জাহিদ

‘পরিবেশ সংরক্ষণ করেই মাছ উৎপাদন করতে হবে’

১০

সমাজের বরণীয়দের সব সময় স্মরণে রাখতে হবে : অপর্ণা রায়

১১

পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান বাংলাদেশের

১২

রাহুল গান্ধীকে চুমু যুবকের, অতঃপর...

১৩

৩৮ বছর পুরোনো যে রেকর্ড ভাঙলেন অস্ট্রেলিয়ান স্পিনার

১৪

জুলাই যোদ্ধা ফারুকের গাল থেকে গুলি অপসারণ

১৫

ক্যানসারের চতুর্থ পর্যায়ে অভিনেত্রী তন্নিষ্ঠা

১৬

পানি পানে এই ৪ ভুল করছেন? হতে পারে ভয়াবহ বিপদ

১৭

রাবিতে নিয়োগ বোর্ড বাতিলের দাবিতে উপাচার্যের বাস ভবনের সামনে বিক্ষোভ

১৮

ভিকারুননিসায় হিজাব পরায় ২২ শিক্ষার্থীকে বের করে দিলেন শিক্ষিকা

১৯

দুই মোটরসাইকেলের সংঘর্ষ, নিহত দুই

২০
X