কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। সংক্ষেপে সিবিবিএল। কিন্তু ‘কমিউনিটি ব্যাংক’ হিসেবেই মানুষের কাছে বেশি পরিচিত। বাংলাদেশ পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান। ২০১৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর দেশের চতুর্থ প্রজন্মের বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে পথ চলা শুরু করে ব্যাংকটি। সে হিসাবে আগামী ১১ সেপ্টেম্বর ব্যাংকটির চার বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। শতভাগ পুলিশ সদস্যদের মালিকানাধীন এই ব্যাংকটিতে প্রথম দুই বছর কোনো খেলাপি ঋণ না থাকলেও তৃতীয় বছর থেকে খেলাপি ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে। আর চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক শেষে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ কোটি ৪০ লাখ টাকা, যা ২০২২ সালের মার্চে ছিল ৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে তিনগুণ, যা ‘উদ্বেগজনক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পর্যালোচনা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক শেষে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ২১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ১০ কোটি ৪০ লাখ টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ। এর মধ্যে ২৪ দশমিক ৮১ শতাংশই মন্দমানে খেলাপি ঋণ, যা আদায় হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। মন্দ ঋণ বাড়লে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতাও কমে যায়। কারণ এর বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। ফলে ব্যাংকটির নিট আয়ে প্রভাব ফেলে। এতে দুর্বল হয়ে পড়ে ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি। ফলে বছর শেষে লভ্যাংশবঞ্চিত হতে পারেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। অন্যদিকে মন্দ ঋণের কারণে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনার ব্যয়ও বাড়ছে। মন্দ ঋণ বৃদ্ধির জন্য বাছবিচার ছাড়া ঋণ অনুমোদন করাই মূল কারণ। মন্দ মানে খেলাপি ঋণ বাড়ায় সুশাসনের অভাবকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, অনিয়ম, দুর্নীতি এবং আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের কারণে চতুর্থ প্রজন্মের নতুন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের বোঝা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, এক বছরে তিনগুণ খেলাপি হওয়া মোটেও কাম্য নয়। শুধু কমিউনিটি ব্যাংকে নয়, সার্বিকভাবেই ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের মাত্রা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া খেলাপি ঋণের যে তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশ করে সেখানেও দেখা যায়, ব্যাংকগুলো প্রকৃত তথ্য দেয় না। অর্থাৎ প্রকৃত খেলাপি ঋণের চেয়ে অনেক কম দেখানো হয়। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও বেশি অনুসন্ধান করা উচিত, কেন এত খেলাপি ঋণ হচ্ছে এবং সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কোনো ব্যাংকের মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া ওই ব্যাংকের জন্য অগ্রিম সতর্কবার্তা। মন্দ ঋণ বাড়লে ব্যাংকের দুই ধরনের ক্ষতি হয়। একটি হচ্ছে ব্যাংকের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে, যা পরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে এই মানের ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। আর এটি করতে গিয়ে ব্যাংকের আয় কমে যায়। আর ব্যাংক তার আয় ঠিক রাখার জন্য সঠিকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ না করেই ঋণ বিতরণ করে থাকে। ফলে সেই ঋণ আর আদায় করতে পারে না ব্যাংক।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, প্রথম দুই বছর তো খেলাপি হওয়ার কথা না। যে কোনো ব্যাংকে তার পর থেকেই খেলাপি ঋণ শুরু হয়। সেই হিসেবে কমিউনিটি ব্যাংকেও ঋণ বিতরণের পরপরই খেলাপি হওয়া শুরু হয়ে গেছে। আমাদের দেশের রীতি অনুযায়ী, পুলিশরা তো শুধু নিতে অভ্যস্ত, দিতে তো অভ্যস্ত নয়। কাজেই তাদের যদি ঋণ দেওয়া হয়, সেই ঋণ তো সহজে ফেরত পাওয়ার কথা না। তিনি বলেন, আমার মতে, এ ব্যাংকটিকে অনুমতি দেওয়ারই প্রয়োজন ছিল না। পৃথিবীর কোনো দেশেই পুলিশের জন্য আলাদা কোনো ব্যাংক নেই। আর আমাদের দেশে এসব ব্যাংকের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। সেটি আসলে কার স্বার্থে? এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক যেহেতু অনুমোদন দিয়েছে, তাই তাদেরই এই ব্যাংকটিকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এই খেলাপি ঋণের জন্য যারা দায়ী, তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
কমিউনিটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণ জানতে চাইলে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, প্রথম থেকেই যদি কোনো ব্যাংক সঠিকভাবে ঋণ বিতরণ করে, তাহলে সেখানে খেলাপি হওয়ার কোনো কারণ নেই। এখন যদি ব্যাংকটি মনে করে, এটি তো খুবই কম খেলাপি ঋণ। তাহলেই সেটি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে। সে জন্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
কমিউনিটি ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যে বলা হয়েছে, ব্যাংকটিতে যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, তার ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ ঋণ নিয়েছে পুলিশ। বাকি ৪৫ শতাংশ ঋণ সাধারণভাবে এসএমই, কৃষি এবং ভোক্তা খাতে দেওয়া হয়েছে। আমানত সংগ্রহের ক্ষেত্রেও মিশ্রাবস্থা রয়েছে। ৩০ শতাংশ আমানত আসছে বেতনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে। আর বাকি ৭০ শতাংশ আমানত এসেছে রিটেইল, করপোরেট এবং এসএমই খাত থেকে। ফলে যে কোনো ব্যাংকের মতোই কমিউনিটি ব্যাংকও একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক।
যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্চ প্রান্তিকে ব্যাংকটির মোট ঋণের ৬২ দশমিক ৪৪ শতাংশ ভোক্তা ঋণ খাতে বিতরণ করা হয়েছে যা একক খাত হিসেবে সর্বোচ্চ।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ব্যাংকটির মার্চ প্রান্তিকে মোট ঋণের ৮০ দশমিক ৫৮ শতাংশই ঢাকা বিভাগে কেন্দ্রীভূত আছে। এ ছাড়া খেলাপি ঋণের ৮১ দশমিক ২৫ শতাংশই ঢাকা বিভাগে রয়েছে। ১৪ জন বড় ঋণ গ্রাহকের কাছে ব্যাংকটির ফান্ডেড ঋণ স্থিতির পরিমাণ ৭১৯ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা যা ব্যাংকটির মোট ঋণের (ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড) ১৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ। একই সময়ে ব্যাংকটির ঋণ-আমানত হার ৮৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্যাংকটির সীমা হচ্ছে ৮৭ শতাংশ।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ব্যাংকটির মার্চ প্রান্তিকে মোট মূলধন ৬০৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা, যা গত ডিসেম্বর শেষে ছিল ৫৯৩ কোটি ১৩ টাকা। এ সময় ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের সঙ্গে সংরক্ষিত মূলধনের হার ১৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ, যা নির্ধারিত মাত্রা ১২ দশমিক ৫০ শতাংশের বেশি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মসিউল হক চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, নতুন ব্যাংক যখন ধীরে ধীরে ম্যাচিউরড হয়, তখন খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকে। তবে পরিমাণের দিক থেকে সেটি অনেক কম। মাত্র দশমিক ৩ শতাংশ, যা ব্যাংক খাতে এখনো সবচেয়ে কম। আর যে পরিমাণ ঋণ খেলাপি হয়েছে, আমরা সেটি আদায়েও সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।
মন্তব্য করুন