ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে প্রায় ১০ বছর আগে একটি ফেসবুক পেইজ খুলেছিলেন নয়াপল্টনের বাসিন্দা আফছানা নূর। গত বছরের নভেম্বর মাসে হঠাৎ তিনি দেখেন; তিনি আর পেইজটির অ্যাডমিন নন। পেইজটি হ্যাক করেছে বিদেশি একটি চক্র। ওই চক্রের সদস্যরা একের পর এক আপত্তিকর ভিডিও আপলোড দিতে থাকে। পেইজটি নিয়ে চরম বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়েন আফছানা। তিনি নিরুপায় হয়ে পল্টন থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন গত বছরের ১৬ নভেম্বর। একজন এসআইকে জিডির বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ারও দায়িত্ব দেওয়া হয়। দীর্ঘ এক বছর পার হলেও থানা পুলিশ বা ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ইউনিট থেকে একবারের জন্যও জিডিটির বিষয়ে কোনো খোঁজখবর নেওয়া হয়নি। বাদী জিডি বা এ বিষয়ে কোনো প্রতিকারও পাননি। প্রতিনিয়ত দেশের থানাগুলোতে হাজার হাজার জিডি হয়। কোনো তদবির না থাকলে পুলিশ সেগুলোর খবর রাখে না। বাদীও তার কোনো প্রতিকার পান না। কিন্তু এবার জিডি হওয়া মাত্রই অ্যাকশনে যাচ্ছে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও পুলিশ সদর দপ্তর।
ঢাকা মহানগর পুলিশ বলছে, জিডি হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যেই ডিএমপি এলাকায় অ্যাকশনে যাবে পুলিশ। এ জন্য পুলিশের কনস্টেবল থেকে এসআই পর্যায়ের চৌকশ কিছু কর্মকর্তাকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জিডি করার পর বাদীকে ৮টি প্রশ্ন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষ থানায় ডিজি করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছে কি না জেলা পুলিশ সুপার, রেঞ্জ ডিআইজি ও মেট্রোপলিটন কমিশনারদের একজন সহকারী কমিশনার বা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে মনিটরিংয়ের দায়িত্ব দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সূত্র বলছে, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অধীন ৪৯টি থানায় প্রতিদিন গড়ে ৫০টি করে জিডি লেখা হয়। তার প্রায় সবই থেকে যায় ফাইলবন্দি। গুরুত্ব অনুসারে জিডি তদন্তের কোনো বিধি নেই ডিএমপি কিংবা পুলিশ সদর দপ্তরের। শুধু তাই নয়, কোন কোন জিডির দ্রুত গতিতে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করে নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন, সে সম্পর্কেও নেই সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা। ফলে প্রায় সব জিডি থেকে যায় তদন্তের বাইরে।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, থানায় সাধারণত হত্যার হুমকি, চাঁদাবাজির হুমকি, সম্পত্তিগত বিরোধ, আর্থিক বিরোধ, সাইবার বুলিং, অনলাইন প্রতারণা, নারীর প্রতি সহিংসতা, ইভটিজিং, শ্লীলতাহানি, মোটরসাইকেল খোয়া যাওয়া, মোবাইল, মানিব্যাগ, ল্যাপটপ খোয়া যাওয়া, সনদ বা দলিল দস্তাবেক হারানো, যানবাহন হারানো ইত্যাদি বিষয়ে জিডি হয়। জিডি দায়েরকারীর অভিযোগ, হত্যার হুমকির কারণে জিডি করলেও নিরাপত্তা দেওয়া কিংবা বিষয়টি খতিয়ে দেখার ক্ষেত্রে পুলিশের রয়েছে গাফিলতি। তদন্ত কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও বাদীর অভিযোগ শুনতেও আগ্রহ দেখান না। ফলে সাধারণ মানুষ জিডি করে কোনো প্রতিকার পান না।
অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, মানুষের জানমালের নিরাপত্তা চেয়ে প্রথম আইনি পদক্ষেপ হলো জিডি। আর সেই জিডির তদন্ত করতে যদি পুলিশ গড়িমসি করে, তাহলে নতুন অপরাধ সংঘটনের নতুন ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সব জিডির ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করে থানা পুলিশ। কিন্তু অনেক সময়ই মোবাইলসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ও ছোট-বড় যানবাহন হারানোর পর থানায় জিডি করা হলেও পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেয় না বা বাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করে না। এবার সেই অবস্থার অবসানের ঘোষণা দিয়েছে পুলিশ। তারা বলছে, জিডি হলে এক ঘণ্টার মধ্যেই অ্যাকশনে যাবে পুলিশ।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মো. সাজ্জাত আলী বুধবার কালবেলা বলেন, ‘ডিএমপির কোনো থানায় জিডি করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের হয়রানি মেনে নেওয়া হবে না। জিডি করার এক ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ ঘটনাস্থলে যাবে এবং প্রয়োজনীয় অ্যাকশন নেবে। এ লক্ষ্যে ডিএমপি এলাকায় পুলিশের বাছাইকৃত ১৫০ জন সদস্যকে এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও সদস্যকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হবে। আগামী রোববার (২২ ডিসেম্বর) থেকে যে কোনো জিডির এক ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ যাওয়ার বিষয়টি কার্যকর করা হবে।’
ডিএমপি ও পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, শুধু রাজধানীর থানাগুলোতে বছরে ৬ লাখের বেশি জিডি হয়। হাজার হাজার মামলা তদন্তের জন্য যেখানে পর্যাপ্ত কর্মকর্তা নেই, সেখানে সব জিডির তদন্ত করা অসম্ভব। তাই এখন থেকে দ্রুত পদক্ষেপ হিসেবে জিডি হওয়া মাত্রই বিশেষ পুলিশ টিম পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জিডি করার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের হয়রানি লাঘবে বিশেষ কিছু নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। সেখানে বলা হয়েছে, যে সব নাগরিক থানায় জিডি করতে যান তারা সহজে জিডি করতে পেরেছেন কি না, বিষয়টি পুলিশ সদর দপ্তর মনিটরিং করবে। থানায় জিডি করতে আসা লোকজনকে পুলিশ সদর দপ্তরের মনিটরিং টিম ৮টি প্রশ্ন করবে। প্রশ্নগুলো হচ্ছে, জিডি বা মামলার ক্ষেত্রে কোনো রেফারেন্স ব্যবহার করতে হয়েছে কি না? থানায় প্রবেশের সময় দালালের সম্মুখীন হয়েছেন কি না? ডিজি করতে কত সময় লেগেছে এবং জিডি করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা কোনো গড়িমসি করেছে কি না? জিডি করতে কোনো অনৈতিক বা আর্থিক সুবিধা দাবি করেছিল কি না? ডিউটি অফিসারের আচরণ কেমন ছিল? জিডি করতে কোনো সমস্যার সম্মুখীন করা হয়েছিল কি না? জিডি-পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছিল কি না? জিডিকারীর সার্বিক সন্তুষ্টি কেমন ছিল।
পুলিশ সদর দপ্তরের মনিটরিং টিম থানার মান নির্ণয়ের জন্য ৮ প্রশ্নের ওপর ১০০ শতাংশ নম্বর নির্ধারণ করে ৯০ শতাংশ হলে অসাধারণ, ৮০ হলে উত্তম, ৭০ হলে চলতি মান এবং ৬০ হলে চলতি মানের কম হিসেবে বিবেচিত হবে। যেহেতু পুলিশ সদর দপ্তর থেকে দেশের সব থানায় মনিটরিং সম্ভব নয়; তাই সিডিএমএস থেকে বাদীর ফোন নম্বর নিয়ে ৮টি প্রশ্ন করতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে পুলিশের অতিরিক্ত আইজি (চলতি দায়িত্ব, ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. আকরাম হোসেন বলেন, জিডি-সংক্রান্ত বিষয়ে পুলিশের সব ইউনিটকে পুলিশ হেডকোয়ার্টাসের ফরমেট অনুযায়ী ৮ প্রশ্নের জবাবের ওপর নির্ভর করে প্রতি মাসে থানার অবস্থান নির্ণয় করা হবে। যেসব থানায় সেবার মান কম হবে, তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, থানায় গিয়ে মানুষ উত্তম সেবা পাবে; সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। পুলিশ সদর দপ্তরের পাশাপাশি পুলিশ সদস্যদের মধ্যে যারা ডিএসবিতে (জেলা পুলিশের বিশেষ শাখা) কাজ করেন তারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যাচাই-বাছাই করে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করবেন। ডিএসবি সদস্যরা যত্নসহকারে বিষয়গুলো তদারকি করে প্রয়োজন হলে পুলিশ সদর দপ্তরকে অবহিত করবেন। পুলিশ সদর দপ্তর এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।