বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ৮২টি মামলা করা হয়। এর মধ্যে ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেনে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দায়ের করা হয় ১৭টি। বাকি মামলাগুলো হয় আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে।
আইনজীবীরা বলছেন, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এসব মামলা করা হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। কোনো তথ্যপ্রমাণ না থাকায় সহজেই মামলাগুলো বাতিল হয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে অনেক মামলাই বাতিল হয়েছে। বর্তমানে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতসহ দেশের বিভিন্ন আদালতে ১৮ থেকে ১৯টি মামলা বিচারাধীন। এসব মামলার মধ্যে দণ্ডপ্রাপ্ত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা, অর্থ পাচারের অভিযোগে করা একটি মামলা এবং সম্পদের হিসাব বিবরণী দাখিল না করার অভিযোগে করা একটি মামলা রয়েছে। বাকি মামলাগুলো বেশিরভাগই মানহানির অভিযোগে দায়ের করা। এরই মধ্যে গতকাল রোববারও আপিল বিভাগ চাঁদাবাজির অভিযোগে করা পৃথক চারটি মামলা বাতিল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখেছেন। অর্থাৎ মামলাগুলোর কার্যক্রম বাতিলই থাকছে।
আদেশের পর তারেক রহমানের অন্যতম আইনজীবী ও বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘হাইকোর্ট মামলাগুলো বাতিল করে রায় দিয়েছেন। এই বাতিলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে। দুই পক্ষের পূর্ণাঙ্গ শুনানি নিয়ে আদালত রাষ্ট্রপক্ষের আপিল ডিসমিসড (খারিজ) করে দিয়েছেন। তার মানে দাঁড়াল হাইকোর্ট মামলাগুলো যে বাতিল করেছিলেন, সেই বাতিলের রায় বহাল থাকল। তিনি আরও বলেন, ‘ওয়ান ইলেভেনের সরকারের সময় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এসব মিথ্যা চাঁদাবাজির মামলা করা হয়েছিল।’
এক প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, তারেক রহমানের দেশে আসা না আসা মামলার ওপর নির্ভর করছে না। দেশের প্রচলিত আইন-আদালত ও সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল তিনি। এখন সব মিলিয়ে তার বিরুদ্ধে আরও ১৮-১৯টি মামলা রয়েছে। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা প্রতিটি মামলা যেন আইনগতভাবে মোকাবিলা করা হয়, তিনি আমাদের সুস্পষ্টভাবে এ নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি প্রচলিত আইন, আদালত ও সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। যেহেতু আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে, আপন গতিতে চলবে, অতএব তারেক রহমানের দেশে আসা না আসা মামলার ওপর নির্ভর করছে না। তার দেশে আসার ব্যাপারে মামলা কোনো ধরনের প্রভাবও বিস্তার করছে না। এক প্রশ্নের জবাবে কায়সার কামাল বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। দেশে আসার বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ তিনি যথাসময়ে নেবেন।’
জানা গেছে, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া ৮২ মামলার মধ্যে গত ছয় বছরে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, অর্থ পাচার, মানহানিসহ পাঁচ মামলায় সাজা হয় তার। পলাতক দেখিয়েই মামলাগুলোর বিচার সম্পন্ন করেন বিভিন্ন আদালত। এরই মধ্যে একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলা ও একটি মানহানির মামলায় তার সাজা বাতিল হয়েছে। এ ছাড়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে দুর্নীতির অভিযোগে করা মামলায় ১০ বছরের সাজা স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগ। তবে এ বিষয়ে আপিল বিভাগে এখনো তা বিচারাধীন। এ ছাড়া অর্থ পাচারের অভিযোগে করা একটি মামলায় দেওয়া সাত বছরের সাজার কার্যকারিতাও আপিল বিভাগ স্থগিত করেছেন। এ মামলারও আপিল বিচারাধীন। পাশাপাশি অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় তারেক রহমানকে দেওয়া ৯ বছরের সাজার রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল বিচারাধীন। বিচারাধীন অন্য মামলাগুলো দেশের বিভিন্ন আদালতে মানহানির অভিযোগে দায়ের করা হয়।
জানতে চাওয়া হলে ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ‘ওয়ান ইলেভেনের সময় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ১৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু আদালতের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে যে, সেগুলো ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আইনগত কোনো ভিত্তি ছিল না, যে কারণে সব মামলা বাতিল হয়ে গেছে। এ ছাড়া ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় মানি লন্ডারিং আইনে ও একুশে আগস্ট হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছিল। এ ছাড়া শেখ হাসিনাকে খুশি করার জন্য সারা দেশে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বেশ কিছু মানহানির মামলা করেছিল। মামলা করার পর অনেক বাদীর আর কোনো খোঁজ নেই। অনেকে মারা গেছে। অনেক বাদী মামলায় সাক্ষ্য দেয়নি। তাই আইনিভাবে অনেক মামলা বাতিল ও খারিজ হয়ে গেছে। কয়েকটা মামলায় দুঃখজনকভাবে রায় হয়েছিল।’
পৃথক চার মামলা বাতিলই থাকল: তারেক রহমানের বিরুদ্ধে করা চাঁদাবাজির চারটি মামলা খারিজ করে যে রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট, গতকাল আপিল বিভাগেও তা বহাল রয়েছে। এর আগে রাজধানীর পৃথক দুটি থানায় করা এই চারটি মামলার কার্যক্রম বাতিল ঘোষণা করে গত ২৩ অক্টোবর হাইকোর্ট রায় দেন। ২০০৭ সালে গুলশান থানায় তিনটি এবং ধানমন্ডি থানার একটি মামলাসহ ওই চার মামলার কার্যক্রম বাতিল চেয়ে তারেক রহমানের করা পৃথক আবেদনের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে ওই রায় দেওয়া হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ গত ডিসেম্বরে পৃথক লিভ টু আপিল করে। পৃথক লিভ টু আপিল গত ৯ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে ওঠে। আদালত লিভ টু আপিল আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য নির্ধারণ করেন। জানতে চাইলে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক বলেন, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে চারটি লিভ টু আপিল করা হয়। লিভ টু আপিলগুলো শুনানি করে খারিজ করে দেওয়া হয়েছে।
আইনজীবীদের দেওয়া তথ্য অনুসারে, রেজা কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফতাব উদ্দিন ২০০৭ সালের ২৭ মার্চ তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনসহ অন্য ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগে গুলশান থানায় একটি মামলা করেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আল আমিন কনস্ট্রাকশনের কর্মকর্তা সৈয়দ আবু শাহেদ সোহেল চাঁদাবাজির অভিযোগে একই বছরের ৪ মে গুলশান থানায় একটি মামলা করেন। তারেক রহমান ও তার একান্ত সহকারী মিয়া নূরউদ্দিন অপুকে আসামি করে ঠিকাদার আমীন আহমেদ ভূঁইয়া চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে দ্রুত বিচার আইনে গুলশান থানায় ২০০৭ সালের ৮ মার্চ একটি মামলা করেন। ঠিকাদার মীর জাহির হোসেন ধানমন্ডি থানায় ২০০৭ সালের ১ এপ্রিল গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের বিরুদ্ধে অন্য মামলাটি করেন। এই চার মামলার কার্যক্রম বাতিল চেয়ে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে হাইকোর্টে পৃথক আবেদন করেন তারেক রহমান। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুল অ্যাবসলিউট (চূড়ান্ত) ঘোষণা করে গত ২৩ অক্টোবর রায় দেন হাইকোর্ট।