আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং অপরাধ প্রতিরোধ কার্যক্রমকে গতিশীল করতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে দেশে মোবাইল কোর্ট (ভ্রাম্যমাণ আদালত) পরিচালিত হয়। ২০০৯ সালে আইন হওয়ার পর থেকে এটি চলমান। তবে মাঝেমধ্যেই মোবাইল কোর্টের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার অনেক নজির জড়ো হচ্ছে। প্রায় এক যুগ আগে আইনের কয়েকটি ধারা লঙ্ঘন করে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার অভিযোগে হাইকোর্টে রিট করেন এক ভুক্তভোগী। এরপর আরও দুটি রিট হয়। হাইকোর্ট তিনটি রিট শুনানি করে মোবাইল কোর্ট আইনের ১৭টি ধারার মধ্যে ১১টি ধারা ও উপধারাকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন।
এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। ২০১৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করেন আপিল বিভাগ। ওই স্থগিতাদেশের পর প্রায় সাত বছর অতিবাহিত হতে যাচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ে আর শুনানি হয়নি। এমনকি আপিলের সারসংক্ষেপও জমা পড়েনি। শুনানি শেষ করতে রাষ্ট্রপক্ষের কোনো উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না। ফলে স্থগিতাদেশের সুযোগে বৈধতার প্রশ্ন মাথায় নিয়েই পরিচালিত হচ্ছে মোবাইল কোর্ট। ঘুরেফিরে মোবাইল কোর্টের অপব্যবহারের অভিযোগও বাড়ছে। দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে মোবাইল কোর্ট আইনের সংস্কারেরও দাবি উঠছে। তবে বিষয়টি আপিল বিভাগে বিচারাধীন থাকায় জটিলতা তৈরি হয়েছে। সংস্কারের প্রস্তাবে যুক্ত করতে হলে আগে আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন।
রিটকারীদের আইনজীবী ব্যারিস্টার হাসান এম এস আজিম বলেছেন, ‘যেহেতু মোবাইল কোর্ট আইনের বৈধতার প্রশ্নটি এখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন, তাই আগে এটা নিষ্পত্তি হতে হবে। তারপর আইন সংস্কারের বিষয় আসবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মোবাইল কোর্টের বিচারিক প্রক্রিয়ায় যেসব ত্রুটি রয়েছে, হাইকোর্টের রায়ের আলোকে সেগুলো সংশোধন করা প্রয়োজন। আামি মনে করি, দ্রুতই বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। তবে সরকার যেহেতু এখনো আপিলের সারসংক্ষেপ আদালতে জমা দেয়নি।
সে কারণে আমরাই সারসংক্ষেপ রেডি করছি। আশা করছি, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে এই সারসংক্ষেপ জমা দেব। এরপর দ্রুত শুনানির উদ্যোগ নেব।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘দেশে মোবাইল কোর্ট সচল রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যৌন হয়রানি, বাল্যবিয়েসহ ছোটখাটো অপরাধের তাৎক্ষণিক বিচার ও সাজা প্রদানের জন্য এই বিধান রাখা উচিত। তবে অদক্ষ লোকজন দিয়ে এই কোর্ট পরিচালিত হওয়ায় আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে।
জানতে চাওয়া হলে সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মো. শাহজাহান সাজু কালবেলাকে বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তানেও মোবাইল কোর্ট চালু আছে। সেখানেও ছোটখাটো অপরাধের বিচার মোবাইল কোর্টের মাধ্যমেই হচ্ছে। এর মধ্যে ভারতে ২০০৮ সাল থেকে বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে এই কোর্ট পরিচালিত হয়। এর নিয়ন্ত্রণে থাকেন সুপ্রিম কোর্ট। এ ছাড়া ২০১৩ সালে পাকিস্তানে মোবাইল কোর্ট চালু হয়েছে। সেখানেও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত এই কোর্টের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিম কোর্টের হাতে রয়েছে। দুটি দেশেই অভিযুক্তরা আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেন। কিন্তু আমাদের দেশে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকে না। পাশাপাশি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হওয়ায় অনেক সময় আইনের ভুল প্রয়োগ করে ফেলে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও চলে। এসব কারণে আমাদের দেশেও সুপ্রিম কোর্টের অধীনে মোবাইল কোর্ট চালু রাখা যেতে পারে। প্রতিটি জেলায় একাধিক দেওয়ানি ও ফৌজদারি পৃথক মোবাইল কোর্ট স্থাপন করা যেতে পারে। নিয়মিত আদালতের মতো এসব আদালতে সাপোর্টিং স্টাফও নিয়োগ করতে হবে। এতে করে একদিকে প্রশিক্ষিত লোক দায়িত্বে থাকবে, অন্যদিকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকবে না। মোবাইল কোর্টের স্বেচ্ছাচারী ব্যবহারও বন্ধ হবে।’
মোবাইল কোর্ট চালু রাখার পক্ষে সাবেক স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব আবু আলম মো. শহীদ খানও। তিনি কালবেলাকে বলেন, প্রশাসনেও বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট থাকতে পারেন। যখন মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবেন, তখন এসব ম্যাজিস্ট্রেট সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণে থেকে করবেন। সুপ্রিম কোর্ট তাদের মনিটরিং করবেন। তারা সুপ্রিম কোর্টের কাছে জবাবদিহি করবেন। একজন বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট তো সব সময় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবেন না। বাকি সময় তিনি প্রশাসনের দায়িত্ব পালন করবেন।
২০০৭ সালে ‘ভ্রাম্যমাণ আদালত অধ্যাদেশ’ জারি করে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালের ৪ অক্টোবর জাতীয় সংসদে এটিকে আইনে পরিণত করে, যা ‘মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯’ নামে পরিচিত। আইনটি হওয়ার পর থেকেই এর অপব্যবহারের অভিযোগ উঠতে থাকে। আইনে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সংঘটিত অপরাধের সাজা প্রদানের কথা থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না। অনেক সময়ই অভিযোগ উঠছে, ঘটনা ঘটার পর অভিযুক্তকে ধরে নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হয়। এরপর ম্যাজিস্ট্রেট অভিযুক্তকে সাজা দেন। অনেক সময় দোষ স্বীকার না করলেও ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাজা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
জানা যায়, ২০১১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ভবন নির্মাণ আইনের কয়েকটি ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগে আবাসন কোম্পানি এসথেটিক প্রপার্টিজ ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান খানকে ৩০ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। একই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পেয়ে ১১ অক্টোবর ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের কয়েকটি ধারা ও উপধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন তিনি। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের বৈধতা প্রশ্নে হাইকোর্টে আরও দুটি রিট করা হয়। তিনটি রিটের শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ১১ মে রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। ওই রায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের ১১টি ধারা ও উপধারাকে অবৈধ এবং অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে এ আইনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাও অবৈধ ঘোষণা করা হয়।
হাইকোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের ধারা ৫, ৬ (১), ৬ (২), ৬ (৪), ৭, ৮ (১), ৯, ১০, ১১, ১৩ ও ১৫ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এসব ধারা-উপধারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে ক্ষমতার পৃথককরণ-সংক্রান্ত সংবিধানের দুটি মৌলিক কাঠামোর বিরোধী। তবে অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতা ও বিতর্ক এড়াতে হাইকোর্টের রায়ে বিগত দিনে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের দেওয়া সব আদেশ, সাজা ও দণ্ডাদেশ মার্জনা করা হয় এ রায়ে।
রায়ে হাইকোর্ট বলেন, ‘আমরা মোবাইল কোর্টের ধারণার বিরোধিতা করি না। বরং আমাদের সমর্থন রয়েছে। কারণ, এর মাধ্যমে নিঃসন্দেহে দ্রুত অপরাধ শনাক্ত করা সম্ভব হয়। দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট ও তৃণমূল পর্যায়ে বিচার সহজতর করতে মোবাইল কোর্টের মতো দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল অপরিহার্য। এ ধরনের ফাস্টট্র্যাক কোর্ট দেশের ক্রমবর্ধমান মামলাজটের ঢেউকে কমানোর কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে।’ রায়ে আরও বলা হয়, ‘মোবাইল কোর্ট যদি থাকে, বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়া উচিত। অন্যথায় মোবাইল কোর্ট দেশের বিচার বিভাগের সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত হবে, যা সংবিধানের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং মাসদার হোসেনের মামলার আপিল বিভাগে প্রদত্ত রায়ের সঙ্গেও সংগতিপূর্ণ।’
এ রায়ের পরপরই রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল (আাপিলের অনুমতির আবেদন) করা হয়।
২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি আপিল বিভাগ রাষ্ট্রপক্ষের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করে তিন সপ্তাহের মধ্যে আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে ওই বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি আপিলের শুনানির দিন ধার্য করেন। এ ছাড়া আপিলের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত রাখেন। কিন্তু এখনো আপিলের সারসংক্ষেপই দাখিল হয়নি বলে জানা গেছে।
রিটকারীদের আইনজীবী ব্যারিস্টার হাসান এমএস আজিম বলেন, ‘মোবাইল কোর্টের অপব্যবহারের প্রশ্নের চেয়ে বড় কথা হলো এটি সংবিধানের মৌলিক নীতির পরিপন্থি। সংবিধান ও মাসদার হোসেন মামলার রায়ে বিচার বিভাগ আলাদা ও স্বাধীন থাকার কথা বলা আছে। সে কারণে বিচার কাজে নিয়োজিত নন—এমন কেউ বিচার করতে পারেন না। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচারক নন। আর মোবাইল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেটরা নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না। কারণ, তারা প্রশাসনের অধীন। তাদের আইনে অজ্ঞতার পাশাপাশি প্রশিক্ষণও নেই। এসব কারণে মোবাইল কোর্টের অপব্যবহার দেখতে পাচ্ছি।’