অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় না বিএনপি। দলটি চায়, সরকার নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রম শেষে দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করুক। তাদের দাবি, পতিত ফ্যাসিবাদ ও তাদের দোসরদের চলমান নানা ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় নির্বাচিত সরকারের বিকল্প নেই। এ দাবিতে সভা, সেমিনারসহ নানাভাবে সোচ্চার রয়েছে দলটি। সরকার দ্রুত সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ না দিলে আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চ নাগাদ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। বিএনপি এখন দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের শরিক সমমনা দল ও জোটগুলোকেও পাশে চায়। দলটির প্রত্যাশা—সভা, সেমিনার, মানববন্ধনের মতো কর্মসূচিতে জোট শরিকরাও সোচ্চার হোক। গতকাল শুক্রবার দুপুরে রাজধানীতে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে এ বিষয়টি তুলে ধরা হয় বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়টি’ বিভিন্নভাবে আলোচনায় এসেছে। বিএনপির অভিমত, এ ধরনের সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন হওয়ার নজির নেই। এটা করলে সময়ক্ষেপণ হবে। ফলে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত হবে। আর জাতীয় নির্বাচনে যত বিলম্ব ঘটবে, দেশে সংকট তত বাড়বে। তাই এখন সরকারের উচিত, বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে জনআকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের দিকে দৃষ্টি স্থির করা। বিএনপি চায়, সরকার কোনো চাপ কিংবা কোনো পক্ষ বা কারও স্বার্থ প্রাধান্য না দিয়ে জনস্বার্থে দ্রুত সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দিয়ে দেশকে নির্বাচনমুখী করে সামনে এগিয়ে যাবে।
দলটি মনে করে, এই সরকারের পক্ষে সব সংস্কার করা সম্ভব নয়, সেটা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন, সেটা করে সরকারকে দ্রুত নির্বাচন দিতে হবে। কারণ, নির্বাচনই সংস্কারের প্রথম ধাপ। এটা দিয়ে শুরু করতে হবে সংস্কার। তা ছাড়া বিএনপিও সংস্কার চায়। দলটির নেতারা বলছেন, এ জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে ২০২৩ সালে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা তুলে ধরা হয়েছে। জনগণের ভোটে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় গেলে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করে তা বাস্তবায়ন করবে বিএনপি।
সূত্রমতে, বৈঠকে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে দলের এমন মনোভাবের বিষয়টি সমমনা জোট নেতাদের জানিয়ে দ্রুত জাতীয় নির্বাচন দাবিতে তাদেরও সোচ্চার হওয়ার পরামর্শ দেয় বিএনপি। বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, নির্বাচন দাবিতে তারা সোচ্চার রয়েছে। দেশব্যাপী রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা সংবলিত লিফলেট বিতরণ ছাড়াও সভা-সেমিনার-বিক্ষোভ সমাবেশের মধ্য দিয়ে নেতারা দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। আপনারাও (সমমনা জোট) এ দাবিতে সোচ্চার হোন। ১২ দলীয় জোটের মতো আপনারাও জনগণের কাছে ৩১ দফা তুলে ধরুন। এ ছাড়া সভা, সেমিনার, মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি দিয়েও নির্বাচনের দাবি তুলে ধরতে পারেন। বিএনপির পাশাপাশি সমমনা অন্য দল ও জোটগুলোর পক্ষ থেকেও দাবিটি তুলে ধরলে সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে।
বিএনপি মনে করে, ছাত্রদের জুলাই ঘোষণাপত্রের অন্যতম লক্ষ্য ছিল বাহাত্তরের সংবিধানকে বাতিল করা। এ ক্ষেত্রে তাদের আপত্তি রয়েছে। বিএনপি নেতারা মনে করেন, সংবিধানের বাইরে গেলে দেশে অস্থিরতা তৈরি হবে। তাছাড়া ছাত্ররা যে সংবিধান বাতিল করে দেওয়ার কথা বলছে, সেই বাহাত্তরের সংবিধানের আলোকেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠনসহ রাষ্ট্রের সব কিছু পরিচালিত হচ্ছে। অর্থাৎ এই সংবিধানের অধীনে রাষ্ট্রের কাঠামোগত একটা অবস্থান আছে। সুতরাং যারা এটা বাতিলের কথা বলছে, তাদের পেছনে ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। বিএনপির অভিমত, সংবিধান কখনো কবর দেওয়া যায় না। পরিবর্ধন, পরিমার্জন বা সংশোধন হতে পারে। সেটাই হবে সর্বোত্তম পন্থা। বৈঠকে জুলাই বিপ্লবের সম্ভাব্য ঘোষণাপত্র নিয়ে বিএনপির এমন অবস্থান তুলে ধরে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ব্যাপারে সজাগ থাকার আহ্বান জানায় দলটি।
এ ছাড়া বৈঠকের আলোচনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়টিও উঠে আসে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, নতুন দল গঠনে তাদের কোনো আপত্তি নেই। যে কারও নতুন রাজনৈতিক দল করার অধিকার আছে। তবে সরকারি সহযোগিতায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় দল হলে এবং সেটা ‘পতিত’ ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসনের প্ল্যাটফর্ম হলে জনগণ সেটা মানবে না। এ ব্যাপারে সমমনা জোট নেতাদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানায় বিএনপি।
গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বেলা সোয়া ১১টায় শুরু হওয়া বৈঠকটি প্রায় ঘণ্টাব্যাপী চলে। বৈঠকে বিএনপির পক্ষে স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও সেলিমা রহমান উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদের নেতৃত্বে বৈঠকে জাগপার খন্দকার লুৎফর রহমান, গণদলের গোলাম মওলা চৌধুরী, এনডিপির কারি আবু তাহের, এনপিপির মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা, বাংলাদেশ ন্যাপের এমএন শাওন সাদেকী, সাম্যবাদী দলের সৈয়দ নুরুল ইসলাম, বাংলাদেশ মুসলিম লীগের নাসিম খান, ডেমোক্রেটিক লীগের খোকন চন্দ্র দাস, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টির এসএম শাহাদাত প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
জানতে চাইলে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ কালবেলাকে বলেন, নির্বাচিত সংসদ ছাড়া গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে না। তাই দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় দ্রুত একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন প্রয়োজন। তা ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে ভোটাধিকার বঞ্চিত জনগণও এখন ভোট দিতে উন্মুখ। সুতরাং সংস্কারের নামে কালক্ষেপণ করা যাবে না। সরকারকে বলব, নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন। নির্বাচনে যত বিলম্ব হবে, সংকট তত বাড়বে। তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপিসহ আমরা চাই, আগে জাতীয় নির্বাচন, তারপর স্থানীয় সরকার নির্বাচন।’
এদিকে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণে গত বৃহস্পতিবার রাতে এলডিপির মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদের নেতৃত্বে দলটির লিয়াজোঁ কমিটির সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি। সেখানে বিএনপির পক্ষে স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ছিলেন।
জানা যায়, ওই বৈঠকেও জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অবস্থানের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে এলডিপি। দলটির নেতারাও মনে করেন, দেশে নানা ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় দ্রুত জাতীয় নির্বাচন প্রয়োজন। এ দাবিতে বিএনপি কোনো কর্মসূচি নিলে এলডিপির পক্ষ থেকে অতীতের মতো আগামীতেও তা যথাযথভাবে পালনের প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়।
জানতে চাইলে এলডিপির মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ কালবেলাকে বলেন, সংস্কার এক-দুদিনের ব্যাপার নয়, একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিএনপিসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্ররা রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের জন্য ৩১ দফা দিয়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তা বাস্তবায়ন করবে।
তিনি আরও বলেন, সংস্কার এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া একসঙ্গে চলতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারকে বলব, একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে সংস্কার দরকার, সেটা আগে করুন। সেটা করে সর্বাগ্রে সংসদ নির্বাচন দিন। সংসদ নির্বাচন দিলে রাষ্ট্রের একটা স্থিতিশীলতা আসবে। সবকিছু মিলিয়ে বর্তমানে রাষ্ট্র যে একটা স্ট্যাবল পজিশনে রয়েছে, সেটা বলা যায় না। বিভিন্ন জায়গায় নানা রকম চক্রান্ত হচ্ছে। এ সরকারকে দিয়ে রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব নয়। তাই দ্রুত নির্বাচিত সরকার দরকার।