লন্ডনে এখন তীব্র শীত। গত কয়েক দিন ধরে সকালের দিকে তাপমাত্রা নামছে ২-৩ ডিগ্রিরও নিচে। তুষারপাত না হলেও কনকনে ঠান্ডায় জমে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি। এমন অবস্থার মধ্যেই কয়েকদিন ধরে ভোর হতে না হতেই ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায় লন্ডনের কিংসটন শহরের একটি বাড়িতে। স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে ওই বাড়িতে বাস করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বাড়িটির সাম্প্রতিক ব্যস্ততা যাকে ঘিরে, তিনি তারেক রহমানের মা বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি চেয়ারপারসন। চিকিৎসার জন্য তিনি এখন অবস্থান করছেন লন্ডন ক্লিনিকে। তার সেবা-শুশ্রূষা নিয়েই এখন ব্যস্ততার অন্ত নেই তারেক রহমানের। ভোর থেকে শুরু হয়ে সেই ব্যস্ততায় কাটছে রাতও।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের রোষানলের কারণে সাড়ে সাত বছর মায়ের সান্নিধ্য পাননি তারেক। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দীর্ঘকাল পর মাকে কাছে পেয়ে তাই উচ্ছ্বাসের কমতি নেই তার। দেশের বাইরে থেকেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এখন তারেক রহমান। দিনভর রাজনৈতিক, সামাজিক, কূটনৈতিক এবং সাংগঠনিক ব্যস্ততায় দম ফেলারও ফুরসত নেই তার। কিন্তু মাকে কাছে পেয়ে পুত্র-দায়িত্বে বিন্দুমাত্র ঘাটতি রাখছেন না। সেই ব্যস্ততায় তাকে সঙ্গ জোগাচ্ছেন স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান এবং কন্যা জাইমা রহমান। কিংসটনের বাড়িতে ভোরে ঘুম থেকে উঠে দাদির জন্য স্যুপ, নুডলসসহ নানা খাবার তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন জাইমা। এ কাজে তাকে সাহায্য করেন মা জুবাইদা। রান্না শেষে খাবার ভর্তি হটপট বাবা তারেকের হাতে তুলে দেন জাইমা।
মেয়ের রান্না করা খাবার নিয়ে নিজেই প্রায় ঘণ্টাখানেক গাড়ি চালিয়ে ১৪ মাইল দূরে লন্ডন ক্লিনিকে মায়ের কাছে ছুটে যান তারেক রহমান। মায়ের শিয়রের পাশে বসে পরম যত্নে খাইয়ে দেন সেই খাবার। দীর্ঘ সময় ছেলে ও স্বজনদের এমন আন্তরিক সেবায় আগের চেয়ে কিছুটা প্রাণবন্ত হয়ে উঠছেন খালেদা জিয়াও। মা-ছেলের এই সময়টুকু কেটে যায় তাদের পারিবারিক ও রাজনৈতিক নানা স্মৃতিচারণে। লন্ডনে অবস্থানরত জিয়া পরিবারের ঘনিষ্ঠজনরা জানান, ক্লিনিকে মায়ের পাশে দেখা তারেক রহমান একেবারেই যেন অন্য কেউ। সবকিছুর ঊর্ধ্বে তিনি তখন কেবলই মা-অন্তঃপ্রাণ এক সন্তান।
ঘনিষ্ঠজনরা আরও জানান, চিকিৎসকদের বিধিনিষেধের কারণে নির্দিষ্ট কিছু খাবারের বাইরে কিছু খেতে দেওয়া হচ্ছে না খালেদা জিয়াকে। বাসা থেকে রান্না করে সেসব খাবার প্রতিদিন মায়ের জন্য নিয়ে যান তারেক। এমনকি রান্নাবান্নার বিষয়টিও নাকি তত্ত্বাবধান করেন তিনি।
লন্ডনে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সঙ্গে বলে জানা যায়, খালেদা জিয়া লন্ডন পৌঁছানোর পর তারেক রহমানের রোজকার রুটিনে এসেছে বড় পরিবর্তন। কয়েক বছর ধরে তার প্রতিদিনকার রুটিন ছিল বাংলাদেশ ও বিদেশি গণমাধ্যমের খবর পড়া, দলের নেতাকর্মীদের খোঁজখবর নেওয়া, রাজনীতির দিকনির্দেশনা দেওয়া, বক্তৃতা, ফেসবুক লাইভ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় পার করা। কয়েক মাস ধরে সেই ব্যস্ততা বেড়েছে আরও। তবে মায়ের সেবায় কোনো ব্যস্ততাই বাধা হতে পারছে না তারেকের। মায়ের সঙ্গেই তার সময় কাটছে বেশি।
গত শুক্রবার মায়ের জন্য খাবারের হটপট হাতে নিয়ে তারেকের ক্লিনিকে যাওয়ার একটি ভিডিও এসেছে সামাজিক যেগোযোগমাধ্যমে। এর আগে হিথ্রো বিমানবন্দরে খালেদা জিয়াকে অভ্যর্থনা জানানোর পর নিজেই গাড়ি চালিয়ে তাকে ক্লিনিকে নিয়ে যান তারেক। এসব ভিডিও ভাইরাল হয়েছে মুহূর্তেই। আর মায়ের প্রতি তারেকের আবেগ-ভালোবাসা প্রশংসিত হয়েছে সর্বমহলে। মায়ের প্রতি তার এমন ভালোবাসা তার মানবিকতা আরেকটি পরিচয় বলেই মন্তব্য করছেন সবাই।
তবে এই মানবিক মনোভাব যে নতুন কোনো ঘটনা, তা কিন্তু নয়–রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে তারেক অনন্য এক মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ। পতিত সরকারের আমলে নির্যাতিত-নিপীড়িত নেতাকর্মী থেকে শুরু করে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের সমর্থকের পাশেও তিনি আছেন বটবৃক্ষের মতো। তিনি সামাজিক আয়োজন থেকে শুরু করে চিকিৎসা ও শিক্ষাগত প্রয়োজন মেটাতে নিজ উদ্যোগে বহু মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় মাদ্রাসা, এতিমখানা, হাসপাতালসহ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এতটাই নীরবে এসব কর্মকাণ্ড তিনি পরিচালনা করে চলেছেন যে, অনেক স্থানীয় নেতাকর্মীও জানতে পারেন না। জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন এবং আমরা বিএনপি পরিবার নামে আরও দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও চলছে তারেক রহমানের মানবিক উদ্যোগ।
জানা গেছে, ২০০৫ সালের কোনো এক শুক্রবার রাতে বনানীর অফিস থেকে বাসায় ফিরছিলেন তারেক রহমান। হঠাৎ দেখতে পান বনানী ১১ নম্বর সড়কের ফুটপাতে একজন অসহায় বৃদ্ধার মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। পাশে ওই বৃদ্ধার মেয়েও দাঁড়িয়ে। এ দৃশ্য দেখে গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত ওই বৃদ্ধাকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। পরে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে দোকান ও ঘর নির্মাণ করে দেন সেই নারীকে। সেই থেকে আর্তমানবতার সেবায় ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত হন তিনি। জুলাই বিপ্লবে আহত কলেজছাত্র ইলহাম সরকারের উন্নত চিকিৎসার জন্য শুরু থেকেই অভিভাবকের মতো পাশে দাঁড়ান তারেক রহমান। তার চিকিৎসার উদ্যোগ নেন। বগুড়ার গাবতলীর একজন গ্রাম্য ডাক্তার এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে হৃদরোগে মারা যাওয়ার পর ওই ব্যক্তির দুই সন্তানসহ তিন শতাধিক পরিবারের শিক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন।
২০১৪ সাল থেকে সারা দেশে ১৪৪ পরিবারকে প্রতি মাসে ভাতাও দিচ্ছেন। এ ছাড়া গুম, খুন হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর মধ্যে তিনজনের বিয়ের আয়োজন করেন। ফেনী, বগুড়া ও সাতক্ষীরায় এই বিয়ের আয়োজন হয়। তারেক রহমান বিভিন্ন এলাকায় অসহায় বেশ কয়েকটি পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দিয়েছেন। তারেক রহমান এসব কাজের অর্থের ব্যবস্থা করে দিলেও স্থানীয় বিএনপি বা অঙ্গসংগঠনের নেতারা তা বাস্তবায়ন করেন। বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও পুলিশের নির্যাতনে হাত-পা হারানো ১২ জনের কৃত্রিম হাত-পা সংযোজনের ব্যবস্থা করেছেন তারেক রহমান। একই সঙ্গে সম্প্রতি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত ও আহতদের ২০০ জনকে সহযোগিতা করেছেন তারেক রহমান।
জানা যায়, লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে যুবদল নেতা ফেরদৌসকে পুলিশ ধরে নিয়ে নির্যাতন করার ১৫ দিন পর কারাগারে মারা যান তিনি। নিহত এই যুবদল নেতার পরিবারকে উপহার হিসেবে একখণ্ড জমি কিনে ঘর নির্মাণ করে দিয়েছেন তারেক রহমান। নিহতের স্ত্রী জেসমিন আক্তার বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একখণ্ড জমি কিনে ঘর করে দেন। এতে করে সন্তানদের নিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়।
জানা গেছে, শুধু মায়ের সেবক বা ভালো সন্তানই নন তারেক রহমান, প্রকৃতি এবং প্রাণী নিয়ে চিন্তা করেন তিনি। বিএনপি আলমে ঢাকায় ১ লাখ নিমগাছ লাগিয়েছিলেন তিনি। ২০২৩ সাল থেকে মিরপুর ও যাত্রাবাড়ীতে ‘বিড়াল বাড়ি’ নামে পরিচিত শতাধিক বিড়ালের খাদ্যের জন্য প্রতি মাসে সহায়তা দিচ্ছেন তিনি।