কবির হোসেন
প্রকাশ : ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৩৭ এএম
আপডেট : ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:২২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিচারকের বিচার চেয়ে দশ বছর আদালতের বারান্দায় হেনা আক্তার

পাল্টাপাল্টি মামলা
বিচারকের বিচার চেয়ে দশ বছর আদালতের বারান্দায় হেনা আক্তার

ঝালকাঠির নলছিটির বাবা-মাহীন এতিম মেয়ে হেনা আক্তার। বসবাস করেন রাজধানী ঢাকা শহরে। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর দেনমোহর ও ভরণ-পোষণ চেয়ে ঢাকার পারিবারিক আদালতে মামলা করেন। মামলার সূত্র ধরে তার সঙ্গে পরিচয় হয় বিচারক জুয়েল রানার। এরপর জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক থেকে শুরু করে নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছেন ওই নারী।

পাল্টাপাল্টি মামলা দায়েরের ঘটনা ঘটেছে। এসব মামলায় হেনা আক্তার সাত মাসের মতো কারাভোগও করেছেন। দীর্ঘ দশ বছরের বেশি সময় ধরে আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন; কিন্তু হেনা আক্তার দমে যাননি। এখনো মামলায় লড়ছেন। এবার সর্বোচ্চ আদালতে নিজের মামলায় নিজেই লড়তে চান।

গত রোববার আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতির আদালত তাকে তার মামলা পরিচালনার অনুমতিও দিয়েছেন। এখন নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অবিচারের বিচার নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ আদালতে নিজেই শুনানি করবেন তিনি। অন্যদিকে অপর এক অভিযোগের ভিত্তিতে বিচারক জুয়েল রানা ২০১৬ সালে একবার সাময়িক বরখাস্ত হয়েছিলেন। তবে বিচার বিভাগের পট পরিবর্তনের পর তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের তৎপরতায় বিচারক জুয়েল রানা সব অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতি ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনাসহ একাধিক গুরুতর অভিযোগ সত্ত্বেও সুপ্রিম কোর্টের জি এ (জেনারেল অ্যাডিমিনিস্ট্রেশন) কমিটি তাকে সব অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেন। একই সঙ্গে জেলা জজ পদে পদোন্নতির সুপারিশ করেন। বর্তমানে বিচারক জুয়েল রানা খুলনার জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

জানতে চাওয়া হলে বিচারক জুয়েল রানা কালবেলাকে বলেন, ‘এগুলো অনেক আগের অভিযোগ। সবই মিথ্যা অভিযোগ। মিথ্যাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। মানসম্মান নিয়ে টানাটানি করা হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ধর্ষণের অভিযোগ আনার পর বিচারিক তদন্তে সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। হাইকোর্টে তার আবেদন বাতিল করা হয়েছে। এখন সে আপিল বিভাগে গেছে।’ আইনমন্ত্রীকে দিয়ে প্রভাব খাটানোর ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমার পেছনে আসলে একটি পক্ষ লেগে আছে। তারাই এই মেয়েকে দিয়ে এসব করাচ্ছে।’

অন্যদিকে হেনা আক্তার কালবেলাকে বলেন, ‘সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও তার চেম্বারের আইনজীবীদের প্রভাবে জুয়েল রানা সব অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন। এখনো আমি ন্যায় বিচারের আশায় বুক বেঁধে আছি। আশা করছি সর্বোচ্চ আদালতে আমি নিরাশ হব না। আমি চাই, আদালত যথাযথভাবে আমার সব অভিযোগ খতিয়ে দেখুক। তিনি বলেন, ‘ওই বিচারকের বিরুদ্ধে ভালো আইনজীবী না পাওয়ায় আমি নিজেই শুনানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয় হেনা আক্তারের। এরপর ঢাকার পারিবারিক আদালতে দেনমোহর ও ভরণ-পোষণ চেয়ে তার স্বামীর বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। অপর্যাপ্ত কোর্ট ফি দাখিলের অভিযোগ তুলে মামলার বিবাদীপক্ষ আপিল করে। আপিল শুনানিকালে ঢাকার দেউলিয়া আদালতের বিচারক তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ জুয়েল রানার সঙ্গে পরিচয় হয়।

হেনা আক্তারের অভিযোগ, তার করুণ কাহিনি শুনে নিজের খাসকামরায় অস্থায়ী স্টেনোগ্রাফার হিসেবে চাকরি দেন বিচারক জুয়েল রানা। হেনাকে দিয়ে মামলার রায় লেখানোর কাজ করান। একপর্যায়ে বাসায় নিয়ে জোরপূর্বক হেনার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেন। এরপর বিয়ের জন্য চাপ দিলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় হেনা আক্তারকে উঠিয়ে নেওয়া হয়। র্যাবের অফিসে নিয়ে ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর তাকে বেধড়ক নির্যাতন করা হয়। দুদিন র্যাবের অফিসে আটক রাখার পর ২০ পিস ইয়াবা দিয়ে আদালতে চালান দেওয়া হয়। কারাগারে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয় হেনা আক্তারকে। ওই ঘটনার পর ২২ দিন জেল খেটে কারামুক্তি পান হেনা।

হেনা আক্তার আরও জানান, ইয়াবার মামলায় খালাস পাওয়ার পর ২০১৭ সালে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে আরও একটি মামলা করা হয়। এই মামলার বাদী হন জুয়েল রানা নিজেই। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মামলায় প্রায় সাড়ে ৬ মাস জেল খেটেছেন হেনা আক্তার। এরপর এ মামলাটি হাইকোর্ট গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি বাতিল ঘোষণা করেছেন। পরে আইন অনুযায়ী দীর্ঘ ৬০ দিন অতিবাহিত হলেও কোনো আপিল না করায় হেনা আক্তার গত বছরের শেষের দিকে অধস্তন আদালতে ৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করেছেন। বর্তমানে মামলাটি ঢাকার আদালতে বিচারাধীন। এদিকে হেনা ক্ষতিপূরণের মামলা করার পর তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মামলা বাতিল করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করেছেন বিচারক জুয়েল রানা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এরই মধ্যে ঢাকার দেউলিয়া আদালতের বিচারক থাকাকালে ২০১৫ সালে বিচারক জুয়েল রানার বিরুদ্ধে দুটি মামলায় দুর্নীতি-অনিয়মের গুরুতর অভিযোগ ওঠে। এ বিষয়ে বিচারক জুয়েল রানার বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতি বরাবর লিখিত অভিযোগ আসে। ওই অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করেন ঢাকার তৎকালীন জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান। আরেকটি অভিযোগের তদন্ত করেন গাজীপুরের তৎকালীন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক সৈয়দ জাহেদ মনসুর। ওই তদন্তেও দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগের সত্যতা মেলে।

তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, তার বিরুদ্ধে দুটি দেওয়ানি আপিল ২৩৮/১২, ২৩৯/১৩, দেউলিয়া (মামলা) মোকদ্দমা নং ১৭/০৩ ও ১৬/২০০০ পরিচালনার ক্ষেত্রে দক্ষতা ও সততা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। একজন অতিরিক্ত জেলা জজ পদমর্যাদার কর্মকর্তা হয়ে আরজি খারিজের বিরুদ্ধে আপিল নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে দীর্ঘ বিচারিক জীবনের অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে ২০১৬ সালের মে মাসে সুপ্রিম কোর্টের জিএ কমিটি বিষয়টি পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন বিচারক জেলা জজ সালেহ উদ্দিন আহমদকে তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়। পাশাপাশি জুয়েল রানাকে সাময়িক বরখাস্ত করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করতে বলা হয়। এর পরই বিচারক জুয়েল রানা রাষ্ট্রপতি বরাবর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। তাতে তিনি তার বিরুদ্ধে করা দুটি অভিযোগের তদন্তে প্রধান বিচারপতি প্রভাব খাটিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন।

পরবর্তী সময়ে ২০১৬ সালের ৩০ জুন প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য, মিথ্যা অভিযোগ ও অসদাচরণের অভিযোগে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. জুয়েল রানাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। একই সঙ্গে তাকে প্রত্যাহার করে মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়। সংযুক্ত করার প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ জুয়েল রানা প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে ঔদ্ধত্যপূর্ণ, শিষ্টাচারবহির্ভূত, অশালীন, অসংযত, মিথ্যা অভিযোগ করেছেন। এ ধরনের অভিযোগ প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে অসদাচরণের শামিল। এরপর বিচার বিভাগের পট পরিবর্তন ঘটে। তৎকালীন আইনমন্ত্রী ও আইন সচিবের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে বিচারপতি এস কে সিনহা দেশত্যাগে বাধ্য হন। অন্যদিকে বিচারক জুয়েল রানা আইনমন্ত্রীকে দিয়ে প্রভাব খাটিয়ে বিভাগীয় মামলা থেকে রেহাই পান এবং জেলা জজ পদে পদোন্নতিও পান।

সূত্র জানায়, বিচারপতি এস কে সিনহার পরবর্তী সময়ে প্রধান বিচারপতি হন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। ২০১৮ সালে তার নেতৃত্বে জিএ কমিটির সিদ্ধান্তে বলা হয়, বিচারক জুয়েল রানার বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতির চারটি অভিযোগ, একটি বিভাগীয় মামলা ছাড়া বাকি কর্মজীবন সন্তোষজনক বিবেচনায় তাকে অতিরিক্ত জেলা জজ থেকে জেলা জজ পদে পদোন্নতির সুপারিশ করা হলো। পদোন্নতি পাওয়ার পর প্রভাবশালী এই বিচারককে নারায়ণগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই হেনা আক্তার ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ধর্ষণের অভিযোগে বিচারক জুয়েল রানার বিরুদ্ধে মামলা করেন। ওই বছরের ২৪ জুলাই ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫-এ তরুণীর অভিযোগের বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন। ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমকে (সিএমএম) তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলেন ট্রাইব্যুনাল।

মামলার অভিযোগে হেনা আক্তার উল্লেখ করেন, ‘ধর্ষণের কারণে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় ও দুটি মিথ্যা মামলায় কারাগারে থাকায় মামলা করতে বিলম্ব হয়েছে।’ এ মামলার পর জেলা জজ জুয়েল রানাকে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়। পরে এ অভিযোগের তদন্ত করে কোনো সত্যতা নেই মর্মে ঢাকার সিএমএম আদালত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর প্রতিবেদনটি ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। এই প্রতিবেদনের ওপর নারাজি আবেদন দেন হেনা। কিন্তু তা আমলে না নিয়ে একই বছরের ২২ নভেম্বর তরুণীর অভিযোগ খারিজ করে দেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। এর পর হাইকোর্টে আসেন হেনা। সেখানেও হেরে যাওয়ার পর বর্তমানে আপিল বিভাগে আপিল করেছেন। আর এ মামলার আপিল শুনানির জন্যই গত রোববার তিনি আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতির আদালতে আবেদন করেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি নিয়ে ধোঁয়াশা, সমালোচনার মুখে ট্রাম্প

ধর্ষণের নাটক সাজিয়ে নিজেই ফেঁসে গেলেন নারী

ন্যাটো সম্মেলনে যাবেন না জাপান-কোরিয়ার সরকারপ্রধান

রিউমর স্ক্যানার / মেট্রোরেল দুর্ঘটনার দাবিতে প্রচারিত ভিডিও সর্ম্পকে যা জানা গেল

যুদ্ধবিরতি ঘোষণার মধ্যে ইসরায়েলে চলছে ‘ক্ষেপণাস্ত্র বৃষ্টি’, নিহত ৩

ইরানে আটকে পড়া বিদেশিদের সুখবর দিল কুয়েত

ইসরায়েলে ফের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে ইরান

সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার তরুণীর আত্মহত্যাচেষ্টা

যুদ্ধবিরতি নিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের মুখ খুলতে নিষেধ করলেন নেতানিয়াহু

ট্রাম্পের ঘোষণার পরও ইরাকের ইমাম আলী ঘাঁটিতে হামলা

১০

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের নতুন বার্তা

১১

২৪ জুন : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১২

কাতারের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতিতে রাজি হচ্ছে ইরান : রয়টার্স

১৩

মঙ্গলবার ঢাকার যেসব এলাকায় মার্কেট বন্ধ

১৪

‘যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাইনি, প্রয়োজনও নেই’

১৫

২৪ জুন : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৬

আ.লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী নিয়ে সকালে পোস্ট, বিকেলে গ্রেপ্তার ছাত্রলীগ নেতা

১৭

মায়ের চোখের সামনে সড়কে প্রাণ গেল ৩ বছরের জিহাদের

১৮

দুর্বৃত্তের গুলিতে মোংলা বন্দরের কর্মচারী আহত

১৯

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের নাম দিয়েছেন ট্রাম্প

২০
X