পুঁজিবাজারের শীর্ষ সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাসান তাহের ইমাম। তার বিরুদ্ধে জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি টাকা লুটের অভিযোগ ওঠে। মামলাও দায়ের করেন ভুক্তভোগীরা। এরই মধ্যে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) একটি মামলার তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ৭০০ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে। গত পাঁচ বছরে অনৈতিক ও আইনবহির্ভূতভাবে লেনদেন করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের এই টাকা তিনি আত্মসাৎ করেছেন।
সিআইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, হাসান তাহের শুধু বিনিয়োগকারীদের টাকা আত্মসাৎ করেই ক্ষান্ত হননি, অর্থ পাচার করেছেন বিদেশেও। স্ত্রী-সন্তানদের নামে দেশে-বিদেশে গড়েছেন শত শত কোটি টাকার সম্পদ। তিনি বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিক। তবে তদন্তে সিআইডি বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাতের অভিযোগের প্রমাণ পেলেও হাসান তাহের ইমামের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরদের সঙ্গে সখ্য থাকায় ওই তদন্ত প্রতিবেদন ধামাচাপা পড়ে। এবার নতুন করে তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকের তথ্যমতে, হাসান তাহের ইমামের বিরুদ্ধে তার ব্রোকার হাউস মাল্টি সিকিউরিটিজ লিমিটেডের বিনিয়োগকারীদের কয়েকশ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে নিজের ও স্ত্রী-সন্তানদের নামে দেশে-বিদেশে সম্পদের মালিকানা রয়েছে এমন অভিযোগ জমা পড়ে। কমিশন অভিযোগটি অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সংস্থাটির সহকারী পরিচালক আফিয়া খুতুনকে নিয়োগ দেন। তিনি অনুসন্ধানের স্বার্থে হাসান তাহের ইমাম ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য চেয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), ব্যাংক-বীমা, সিটি করপোরেশন, ভূমি অফিস, সাব-রেজিস্ট্রি অফিসসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছেন।
যেভাবে ৭০০ কোটি টাকা লুট: সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদনে জানা যায়, হাসান তাহের ইমামের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর পল্টন মডেল থানায় প্রতারণা করে শত শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করেন মো. রুহুল আমিন আকন্দ নামে একজন বিনিয়োগকারী। মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, হাসান তাহের ইমাম ছলচাতুরী ও অন্যায় অনিয়মের মাধ্যমে ১২টি মিউচুয়াল ফান্ড ও একটি এসপিভি কোম্পানির বিনিয়োগকারীদের প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এর মধ্যে তার (রুহুল আমিন) ব্যক্তিগত ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ ছাড়া হাসান তাহের ইমাম নিয়মবহির্ভূতভাবে তার নিয়ন্ত্রিত মাল্টি সিকিউরিটজ ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের থেকে বেশি হারে কমিশন নিয়েছেন। ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বিনিয়োগকারীদের থেকে ব্রোকারেজ হাউসের লেনদেন কমিশন বাবদ ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকা বেশি নেওয়া হয়েছে।
এই অভিযোগের তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমা। বিস্তারিত তদন্ত করে হাসান তাহের ইমামের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পান এই কর্মকর্তা। প্রতিবেদনে বলা হয়, হাসান ইমাম পাবলিক ফান্ড নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র পাঁচ বছরে অনৈতিক ও আইনবহির্ভূতভাবে লেনদেন করে তিনি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ৭০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। বিভিন্নভাবে মিউচুয়াল ফান্ডের নিয়ম ও আইন লঙ্ঘন করে সুবিধা নিয়েছেন। নিজের অনিয়ম ঢাকতে হাসান ইমাম মাল্টি সিকিউরিটিজের সফটওয়্যার ধ্বংস করেছেন। তবে ট্রেড সংক্রান্ত তথ্য এখনো সিডিবিএল, ডিএসই, সিএসই এবং বিএসইসির নজরদারিতে সংরক্ষিত রয়েছে। তদন্তে চিহ্নিত তার প্রধান ট্রেড জালিয়াতির কৌশল হিসেবে হাসান ইমাম জনসাধারণের তহবিল অপব্যবহার করে তার নিয়ন্ত্রিত কোম্পানিগুলোর জন্য অবৈধ মুনাফা অর্জন করেন। জনসাধারণের তহবিল ব্যবহার করে ট্রাস্টি বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ নেন এবং সেটিকে অবৈধ লেনদেনে ব্যবহার করেন। ডিএসই ও সিএসই প্ল্যাটফর্মকে কাজে লাগিয়ে বড় ব্লক ট্রেড জটিল করে তোলেন।
সিআইডির দেওয়া অনুসন্ধান ও তদন্তের ভিত্তিতে বাংলাদেশের পেনাল কোড ১৮৬০ এর আওতায় কোড নং ১০৯, ৪০৮, ৮২০, ৫০৬, ৪৬৭, ৪৬৮ ধারায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হলেও হাসান ইমাম বিগত সরকারের ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় থেকে রয়ে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, হাসান তাহের ইমাম সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির সম্মুখীন করতে বিভিন্ন ধরনের ছক করে প্রতারণা করেন। তিনি তার নিয়ন্ত্রিত ব্রোকারেজ হাউস মাল্টি সিকিউরিটিজকে ব্যবহার করে অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন শত শত কোটি টাকা। ব্যবহার করেছেন তার নিজস্ব ব্যক্তি স্বার্থের বেশ কিছু কোম্পানির অ্যাকাউন্টও। তার মধ্যে রিট করপোরেশন, ভাইকিংস, টার্ন বিল্ডার্স, বিডি এসএমই করপোরেশন, একাশিয়া শ্রিম লিমিটেড, ইনভেস্ট এশিয়া ক্যাপের হিসাব। তার এই সিকিউরিটিজগুলোর মাধ্যমেই জালিয়াতি করে হাতিয়ে নিয়েছেন বিনিয়োগকারীদের শত শত কোটি টাকা।
তদন্ত প্রতিবেদনে জানা গেছে, তার নিয়ন্ত্রিত মিউচুয়াল ফান্ডগুলোতে থাকা বিনিয়োগকারীদের অর্থ লুটপাট ও ফায়দা হাসিলের জন্য বাংলাদেশ জেনারেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানির (বিজিআইসি) বোর্ডে থাকা তার নিকটতম তিন ব্যক্তিকে ব্যবহার করেছেন। উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তার বোন পিমা ইমাম এবং তার দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু কায়সার ইসলাম ও মাহবুবকে বিজিআইসির বোর্ডে নিয়োগ করে বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ নেন।
আলোর মুখ দেখেনি বিএসইসির তদন্ত: পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ২০২৩ সালে কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে হাসান ইমামের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠে আসে। পরবর্তী সময়ে তার বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ২০২৪ সালে তদন্ত কমিটি গঠন করে বিএসইসি। তদন্ত চলাকালীন ফান্ড থেকে টাকা সরিয়ে নেওয়ার কোনো সুযোগ যেন না থাকে, সে লক্ষ্যে বিএসইসির পক্ষ থেকে তার ফান্ডগুলোর সব ব্যাংক হিসাব স্থগিত করার জন্য বিএফআইইউকে চিঠি দেওয়া হয়। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১০ জুন বিএফআইইউ ব্যাংক হিসাব স্থগিতের নির্দেশ দেয়। একই সঙ্গে ওই বছরের ২৫ জুন সকল ফান্ডের বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাবের লেনদেন স্থগিত করে দেয় বিএসইসি। তবে এই তদন্ত কমিটি গঠনের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।
এ ব্যাপারে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম কালবেলাকে বলেন, এ বিষয়ে হাইকোর্টে মামলা চলছে। বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন থাকায় বিএসইসি তদন্ত চালিয়ে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গুলশানে বান্ধবীর প্লট দখলের অভিযোগে জিডি: হাসান তাহের ইমামের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী তাসলিমা ইসলাম নামে এক নারীর গুলশান অ্যাভিনিউয়ের এনই-ব্লকের ৩/এ নম্বর প্লটটি দখল করার অভিযোগে গুলশান থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। জিডি সূত্রে জানা যায়, তাসলিমা ইসলাম ও তার বড় বোনের মধ্যে পারিবারিক দ্বন্দ্ব থাকায় হাসান তাহের ইমাম রাজউকে তার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে বলে বাড়িটি বিভাজন করে দেবে বলে আগ্রহ জানায়। পরবর্তী সময়ে তাসলিমা রাজি হয়ে গেলে বিভিন্ন ছলচাতুরীর মাধ্যমে বাড়ির সকল কাগজপত্র হাতিয়ে নিয়ে তাতে স্বাক্ষর নিয়ে নেন। তারপর হাসান তাহের ইমাম তার বোন পিমা ইসলামের সঙ্গে একটি অপ্রত্যাহারযোগ্য মোক্তারনামা করিয়ে নেন। এরপর জমিজমা সংক্রান্ত সকল কাগজপত্র ফেরত চাইলে হাসান তাহের ইমাম কোনোদিন জায়গা ফিরে পেতে দেবে না বলে হুমকি দেন এবং প্রভাবশালী বিভিন্ন লোকের নাম করে ভয়ভীতি দেখান। সবশেষ ফোনে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার চেষ্টা করা হলে তিনি হত্যার হুমকি দেন।
এ ব্যাপারে জানতে তাসলিমা ইসলামের মুঠোফোনে কল দেওয়া হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। তবে গুলশান থানার সাবেক উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আমিরুল শেখ কালবেলাকে বলেন, আমি এখন আর গুলশান থানায় কর্মরত নেই। আমার যতটুকু মনে পড়ে এ বিষয়ে অনেক আগে একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছিল। এখন যেহেতু সেই থানায় নেই তাই এ বিষয়ে এর বেশি কিছু বলাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা: সার্বিক বিষয়ে জানতে হাসান ইমামের ব্যবহৃত দুটি মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর খুদেবার্তাও পাঠানো হয়। এর কোনো উত্তর দেননি তিনি। হাসান তাহের ইমামের দুটি নম্বরই তার ব্যক্তিগত সচিব খন্দকার আরিফুল ইসলামের নামে রেজিস্ট্রেশন করা।
এ ব্যাপারে একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের সিইও কালবেলাকে বলেন, বিশ্বের বড় অর্থনীতির সব দেশেই মিউচুয়াল ফান্ড ব্যাপক জনপ্রিয় বিনিয়োগ মাধ্যম। কিন্তু বাংলাদেশে মিউচুয়াল ফান্ড কোনো কালেই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। এই খাতটি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে না পারার পেছনে হাসান তাহের ইমামের মতো কিছু কর্তাব্যক্তি দায়ী। তারা নিজস্ব উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য এ খাতটিকে ব্যবহার করেছেন। বিনিয়োগকারীদের ঠিকমতো লভ্যাংশও দেননি। বিপরীতে নিজেরা অঢেল সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। হাসান তাহের ইমামের মতো আর্থিক খাতের এসব নীরব মাফিয়াকে আইনের আওতায় এনে বিচারের সম্মুখীন না করা গেলে হয়তো বাংলাদেশে মিউচুয়াল ফান্ডের ভবিষ্যৎ বিলীন হয়ে যাবে।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ কালবেলাকে বলেন, যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারকে ধ্বংস করার পেছনে দায়ী, তারা অনেকেই এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। বিগত সময়ে যেসব লুটপাটকারী পুঁজিবাজারকে ধ্বংস করেছে তাদের মতো যেন আর কেউ এমন রাঘববোয়াল হয়ে না উঠতে পারে তাই তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।